আমেরিকাকে হটিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে চলে আসবে চীন
Published: 9th, July 2025 GMT
এখন আর এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে আসছে। এই পিছু হটার সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত মূলত স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়েছে। আর এতে মূল ভূমিকা রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি।
আমেরিকার এই পিছু হটার ধারা একসময় স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে যদি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে, তাহলে বিশ্বে নতুন নেতৃত্বের ভূমিকায় আসবে চীন।
সম্প্রতি চীন তাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। এতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তা ধারণা’ তুলে ধরা হয়েছে। এই নথিতে দেখা যায়, দেশটির নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু প্রতিরক্ষা বা সামরিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকসহ সব দিক একসঙ্গে জড়িয়ে আছে।
শ্বেতপত্রটিতে দেখা যাচ্ছে, চীন বলেছে, তাদের জাতীয় নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হলো রাজনৈতিক নিরাপত্তা। সহজ করে বললে, সিপিসির নেতৃত্বই তাদের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। এই নেতৃত্বই চীনকে একটি অস্থির বিশ্বে স্থিতিশীলতার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
চীনের দাবি, বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলোই দায়ী। বিশেষ করে নানা দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রই এর জন্য বহুলাংশে দায়ী।
চীনের এই কথা পুরোপুরি অমূলক নয়। কারণ, আমেরিকা নিজে যেভাবে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে সরে আসছে, তা অনেকটা দ্বিধান্বিত ও বিশৃঙ্খল।
ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এই বিশৃঙ্খলার শুরু হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক দশক ধরে চলে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল নীতিগুলোকে খারিজ করতে থাকেন। তিনি প্রথম থেকেই খেয়ালখুশিমতো বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এটিও বিশ্বে অস্থিরতা তৈরির একটি বড় কারণ। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা চালানো এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ।
অবশ্য ট্রাম্পের প্রশাসনের দাবি, এই হামলা ছিল সাহসী একটি কাজ, যার লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক হুমকি শেষ করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনা। তাদের দাবি, এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ নয় বরং এটি একবারের একটি পদক্ষেপ।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই হামলা ট্রাম্পের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বা নৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করে দিয়েছে। কারণ, বিশ্বজুড়ে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে অহংকারী ও দ্বিচারী হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বিষয়গুলো ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তারা মনে করছে, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশ্বজুড়ে বন্ধুত্ব গড়ার দরকার নেই; বরং শক্তিশালী সামরিক শক্তি, সাইবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং নিজেদের অর্থনীতিকে রক্ষা করা দরকার। এই অর্থনৈতিক রক্ষার মধ্যে রয়েছে চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক বসানো, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং উন্নত প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।
এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার কূটনীতি কমিয়ে দিয়েছে এবং গরিব দেশগুলোতে সাহায্যও অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। অথচ শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকার প্রভাব বিস্তারে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে চীন। দেশটি এখন নিজেকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে নির্ভরযোগ্য একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছে। দেশটি এখন বহুপক্ষীয় সহযোগিতার পক্ষের শক্তি, গরিব দেশগুলোর পক্ষে বিনিয়োগকারী ও রক্ষক এবং ন্যায়ের পক্ষের এক শান্তি-প্রত্যাশী দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাচ্ছে।
এশিয়ার ৯টি দেশের সঙ্গে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগিতাপূর্ণ প্রতিবেশী চুক্তি’ স্বাক্ষর করে চীন এই ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। এ ছাড়া তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতাও বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গেও বিভিন্ন সহযোগিতা রয়েছে।
চীন এখন আরও বড় পরিসরে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ’ (জিএসআই) প্রচার করছে। ২০২২ সালে চালু হওয়া এই উদ্যোগ পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে জটিল ও একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা সমস্যাগুলো নিয়ে এমনভাবে কাজ করা, যাতে সব পক্ষ লাভবান হয়। মানে, সবাই লাভবান হয়, এমন সমাধান খুঁজে বের করা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ১২০টির বেশি দেশ এই উদ্যোগে সমর্থন জানিয়েছে।
এর পাশাপাশি চীন তাদের ‘সফট পাওয়ার’ বা সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন তারা বিভিন্ন দেশে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট খুলেছে, আফ্রিকান ইউনিয়নের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপে বসছে, আর বাণিজ্য, ঋণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
চলতি বছরের মে মাসে চীন লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের জন্য ৯ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণসহায়তা ঘোষণা করেছে। এর বাইরেও চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) নামের বিশাল প্রকল্পের আওতায় আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।
এই জিএসআই, বিআরআই ও অন্য প্রকল্পগুলো মিলে চীন ‘ভবিষ্যতের জন্য একটি অভিন্ন বৈশ্বিক সম্প্রদায়’ গড়ার ভিত্তি তৈরি করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও সব সময় নৈতিক উচ্চতার দাবি তুললেও বাস্তবে তা মেলে না। চীনের বক্তব্য হলো, চীন হচ্ছে এমন এক ন্যায়পরায়ণ, স্থিতিশীল ও আধিপত্যবিমুখ শক্তি, যা বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু চীনের এই ন্যায়ের ও বহুপক্ষীয়তার কথামালাকে তার দেশের ভেতরের দমনমূলক নীতি ও আঞ্চলিক আগ্রাসী অবস্থান মিথ্যে করে দেয়। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিকীকরণ চীনের উচ্চ নৈতিকতার দাবিকে ম্লান করে দেয়।
চীন বলছে, তারা কেবল নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তারা একের পর এক সীমান্ত দাবি আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করছে। তাইওয়ানের বেলায় সিপিসি বলেছে, তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করতে তারা শক্তি প্রয়োগ না করার কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না এবং এর জন্য তারা প্রয়োজনে ‘যেকোনো ব্যবস্থা’ নিতে প্রস্তুত।
এই ধরনের হুমকি কার্যকর করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার চেয়েও অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যুক্তরাষ্ট্র অন্তত দাবি করেছিল, তারা একটি আশঙ্কাজনক হুমকি প্রতিহত করার জন্যই ইরানে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু তাইওয়ান তো চীন বা তার আশপাশের কারও জন্যই কোনো হুমকি নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—এই দুই দেশের বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ধরন একেবারেই আলাদা। যুক্তরাষ্ট্র আগে (ট্রাম্পের আমলের আগে পর্যন্ত) বলত, তারা একটি নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হুমকি দমন করে, মাঝেমধ্যে সামরিক হস্তক্ষেপও করে।
কিন্তু ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র সেই নীতি থেকে সরে এসে বিশ্বকে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এতে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি বিকল্প আন্তর্জাতিক কাঠামো হিসেবে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আনা পলাসিও স্পেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমানে তিনি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র সহয গ ত ব যবস থ আম র ক র জন য শ ষ কর
এছাড়াও পড়ুন:
বগুড়ায় বৃদ্ধ শ্বশুর ও পুত্রবধূর হাত বাঁধা-গলায় ফাঁস দেওয়া লাশ উদ্ধার
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় আফতাব হোসেন (৭০) নামে এক বৃদ্ধ ও তার পুত্রবধূ মোছা. রিভার (২৮) মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার সকালে উপজেলার জিয়ানগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীমণ্ডপ গ্রাম থেকে তাদের হাত বাঁধা এবং গলায় ফাঁস দেওয়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত আফতাব হোসেন লক্ষ্মীমণ্ডপ গ্রামের মৃত পানা উল্লাহা প্রামাণিকের ছেলে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক। এবং মোছা. রিভা আফতাব হোসেনের ছেলে সৌদি আরব প্রবাসী শাহজাহানের স্ত্রী।
নিহতের স্বজনরা জানান, আফতাব হোসেনের দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে শাহজাহান বেশ কয়েক বছর আগে সৌদি আরব চলে যান। তার স্ত্রী রিভা এক ছেলে নীরব এবং মেয়ে মালিহাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন। আফতাব হোসেনের ছোট ছেলে ঢাকায় থাকেন।
স্বজনরা বলেন, মঙ্গলবার রাতে আফতব হোসেন বাড়িতে তার ঘরে এবং পুত্রবধূ তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মালিহাকে নিয়ে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। বুধবার সকালে মালিহা তার পাশে হাত বাঁধা এবং গলায় ফাঁস অবস্থায় তার মাকে পড়ে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির লোকজনকে খবর দেয়। পরে এলাকাবাসী এসে ঘরের বাইরে রিভার শ্বশুর আফতাব হোসেনকেও হাত বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। দুজনকে মৃত দেখার পর তারা পুলিশকে খবর দেন।
নিহতের স্বজনরা আরও জানান, রিভার ঘরের আসবাবপত্রগুলো তছনছ করা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে। স্বজনদের কেউ কেউ বলছেন, আফতাব হোসেনের সঙ্গে জমি-জমা নিয়ে এলাকাবাসীর বিরোধ চলছিল।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার( অপরাধ) হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান সমকালকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে পূর্ব শত্রুতা, পারিবারিক বিরোধ কিংবা চুরির উদ্দেশ্যে হামলার সম্ভাব্য সব দিক বিবেচনায় তদন্ত চলছে। মরদেহ উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।