‘আগে সকাল-বিকেল বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। এখন আর খেলা সম্ভব না। বাঁ হাতে জোর নেই; গরম সহ্য হয় না। আরও নানান জটিলতা।’ নিজের বাঁ হাত দেখিয়ে কথাগুলো বলছিল জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ কিশোর ইসরাফিল (১৫)। গত বছরের ৪ আগস্ট মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের থানা রোডে তার বাঁ বাহুতে গুলি লেগেছিল। এরপর দেশ-বিদেশে চিকিৎসার পরও সেটি আর পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিক হয়নি।

গত রোববার ইসরাফিলের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়িতে কথা হয়। সে মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা গ্রামের সাইফুল আলমের ছেলে। বর্তমানে মহম্মদপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ছে। সরকারি খরচে হাতের চিকিৎসার জন্য ছয় মাস থাইল্যান্ডে ছিল ইসরাফিল। গত মাসে বাড়িতে ফিরেছে। তবে তার বাঁ হাত আর আগের মতো কাজ করে না।

গত ৪ আগস্টের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই কিশোর জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেবে বলে সে ওই দিন সকালেই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। সকাল নয়টায় পৌঁছে যায় বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মহম্মদপুর আমিনুর রহমান কলেজের সামনে। একপর্যায়ে বেলা একটার পর মিছিল নিয়ে থানার রোডের দিকে যায় আন্দোলনকারীরা। এ সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে ইসরাফিল রাস্তার পাশের একটি খাদে পড়ে যায়। তখন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়।

ইসরাফিলের ভাষ্য, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম একটা হাত নেই, উড়ে গেছে হয়তো। পরে দেখলাম আছে। আমার গুলি লাগার কিছুক্ষণ আগেই সুমন ভাইয়ের গুলি লাগে। সে তো মারাই গেছে। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। এখন আমার হাত ভালোভাবে তুলতে পারি না। নাড়াতে গেলেই ব্যথা হয়। অনেক কিছুই মাকে দিয়ে করাতে হয়।’

ইসরাফিলের বাবা সাইফুল আলমের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মা লাকি খাতুন গৃহিণী। পরিবারের ছয় সদস্যের ভরণপোষণ চালাতে প্রতিদিনই তাঁদের সংগ্রাম করতে হয়। এর মধ্যে হঠাৎ একটি গুলিতে সবকিছু বদলে যায় যেন। ইসরাফিলের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গুলিটি ইসরাফিলের বাঁ বাহুর গোড়ার জয়েন্টে লেগে পিঠের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়। এরপরও হাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না।চিকিৎসকেরা তখন জানিয়েছিলেন আরও অস্ত্রোপচার করতে, যাতে লাগবে কয়েক লাখ টাকা। তবে পরিচিত ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ছেলেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যান। এরপর গত ডিসেম্বরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইসরাফিলকে থাইল্যান্ড পাঠায় সরকার। সেখানে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসা ও একাধিক অস্ত্রোপচার শেষে গত ১৮ জুন দেশে ফেরে ইসরাফিল।

থাইল্যান্ডে চিকিৎসার পর ইসরাফিলের হাত কিছুটা কাজ করছে জানিয়ে সাইফুল আলম বলেন, সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ইসরাফিল যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিনই নিয়মিত থেরাপি ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। এই গ্রামে থেকে তা কীভাবে করবেন, সেটিই তাঁর দুশ্চিন্তা। ইসরাফিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় মা লাকি খাতুনও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেটা ঠিকমতো হাত তুলতে পারে না। এক বছর ধরে শুধু কষ্ট-দৌড়ঝাঁপ। তার চিকিৎসা আর থেরাপির খরচ তাঁদের পক্ষে জোগানো সম্ভব নয়। ইসরাফিলের চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

গত ডিসেম্বরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইসরাফিলকে থাইল্যান্ড পাঠায় সরকার। সেখানে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসা ও একাধিক অস্ত্রোপচার শেষে গত ১৮ জুন দেশে ফেরে ইসরাফিল।

ইসরাফিলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় মহম্মদপুর থানায় একটি মামলার আবেদন করেছিলেন তার বাবা সাইফুল আলম। তবে থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় আলাদা মামলা হয়নি। ওই দিন আন্দোলনে মহম্মদপুরে সুমন শেখ ও আহাদ আলী নামের দুই শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওই ঘটনায় সুমন শেখের বাবা কান্নুর রহমান গত ১৫ আগস্ট মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারসহ ১৭২ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশ বলছে, ওই একই মামলায় ইসরাফিলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটিও তদন্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মুন্সী রাসেল হোসেন গতকাল সোমবার বলেন, যেহেতু একই স্থানে ও ঘটনায় কয়েকজন হতাহত হয়েছেন, তাই একটি মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। ওই মামলায় এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অর্ধশতাধিক আসামি নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁদের কেউ কারাগারে বা আবার কেউ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মহম মদপ র র ইসর ফ ল ইসর ফ ল র য় ইসর ফ ল ঘটন য় সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘তোর পাকা রাস্তা তুই তুইলি লিয়্যা যা’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী–অধ্যুষিত গ্রাম চৈতন্যপুর। গ্রামটির ভেতরে একটি পাকা রাস্তার নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন অবহেলিত জনপদটির বাসিন্দারা। এবার সেই রাস্তা নিয়েই বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। রাস্তাটির কাজ ফেলে কয়েক সপ্তাহ ধরে উধাও হয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তাটিতে বৃষ্টি হলেই জমছে কাদাপানি।

গোদাগাড়ী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি চৈতন্যপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে ১ হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি পাকাকরণের কাজ শুরু হয়। গত পবিত্র কোরবানির ঈদের আগে রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির পর এর ওপর বালু ও রোলার রেখে চলে যান সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। ঈদের দুই সপ্তাহ পরও তাঁরা কাজে আসেননি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অসুবিধা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের ফোন পেয়ে সড়কটির মাঝখান থেকে গাড়ি ও বালু সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে নতুন করে কাজ শুরু হয়নি।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে গ্রামটির কয়েকজন ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ঈদের পর ঠিকাদার আর কাজে হাত দেননি। রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে আর হাঁটাচলা করা যাচ্ছে না। গ্রামটির বাসিন্দা বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় জানান, তাঁরা এমনিতেই অবহেলিত। পাকা রাস্তা হবে ভেবে সবাই বেশ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তাটি যে ভোগান্তির কারণ হবে, তা বুঝতে পারেননি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা কাদা মাড়িয়ে স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। সড়কটি যেন প্রতিদিনের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত সোমবার বিমলের এক স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। বরযাত্রীদের কয়েকজন ওই সড়কে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে জামাকাপড় একেবারে কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। হাঁটুতে বেশ আঘাত পান একজন। এ নিয়ে বিয়েবাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। আক্ষেপ নিয়ে বিমল বলেন, ‘পূর্বপাড়ার পরে খানিকটা জায়গা খুঁইড়ে রাইখিছে। ওইটুকুর নাকি টেন্ডারই হয়নি। এখন দেখেন তো দাদা, গাঁয়ের কৃষকদের কী সমস্যা। এলাকার লোকজন ধান বিক্রি করতে যাইতে পারছে না।’

রাস্তাটি নিয়ে নিজের ভোগান্তির কথা জানান ভ্যানচালক বিল্টু (৪৫)। তিনি বলেন, দুজন পেছন থেকে না ঠেললে তিনি ভ্যান নিয়ে রাস্তা পার হতে পারেন না। গতকাল বিকেলে অনেকক্ষণ রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে স্থানীয় বাসিন্দা নয়ন সরকার ও মাসুম আলীকে পান তিনি। তাঁরা দুজন ঠেলে দেওয়ার পর বিল্টু কাদা থেকে ভ্যানটি টেনে তোলেন। এই ভ্যান ঠেলতে গিয়ে নয়নের ছাতাটি হঠাৎ কাদার মধ্যে পড়ে যায়। খেপে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মুন বুইলসে যে বুলি, এই তোর পাকা রাস্তা তুই তুইলি লিয়্যা যা।’

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের প্রকৌশলী মুনসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ এলাকার মাটিতে এক ফোঁটা বৃষ্টি হলেই দুই ফোঁটা বেঁধে থাকে। কাদায় কোনো কাজ করা যায় না। এ জন্য ঠিকাদার কাজ শুরু করে আর এগোতে পারছেন না। এলাকাবাসীর আগ্রহের কারণেই আগেভাগে কাজ শুরু হয়েছিল। নইলে বর্ষার পরই তাঁরা কাজ শুরু করতেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার কাজ শুরু করা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ