কাফকার পৃথিবী ও তার লুকানো বিদ্রুপ
Published: 3rd, July 2025 GMT
ফ্রানৎস কাফকাকে নিয়ে সবচেয়ে মোক্ষম ভাস্কর্যটি আছে প্রাগের ওল্ড টাউন আর ইহুদি কোয়ার্টারের একদম মাঝামাঝি জায়গায়। মাথাবিহীন একটা দেহের কাঁধে বসে আছেন মাথাওয়ালা কাফকা। ক্লান্ত চোখ। ডান হাতের তর্জনী কিছু নির্দেশ করছে।
ইয়ারোস্লাভ রোনার এই ভাস্কর্যটির অবস্থান খেয়াল করার মতো, যা একসঙ্গে ধারণ করেছে কাফকার দ্বৈততা ও দ্বিধার মনস্তত্ত্ব; পরিবার ও সমাজের প্রতি এক রকমের দায়বদ্ধতার বিপরীতে তার বিচ্ছিন্নতার ভারী বোধ। রোনা নির্মিত ভাস্কর্যটির কাছেই এক ধারে আছে স্প্যানিশ সিনেগগ, যেমন আরেক পাশে চার্চ অব দ্য হোলি স্পিরিট। দুটি কথোপকথন নামে লেখকের একটি ছোটগল্প থেকে অনুপ্রাণিত এই ভাস্কর্য আসলে তার নায়কদের নিয়ে আমাদের প্রচল ধারণাকেই ইশারা করে: সমাজ ও সিস্টেমের ইঁদুরধরা কলে ফেঁসে যাওয়া ভঙ্গুর সব মানুষ, যাদের জগৎ ধূসর ও মাথায় ব্যাপক যন্ত্রণা দৃশ্যত মাথাকেই গায়েব করে দিয়েছে, আবার চাকুরে জীবন তাকে দিয়েছে দায়িত্ব, নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য মাথা না থাকুক, সমাজের আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাই তাদের আরেকটি সত্তার অনুগত মাথা বহাল না থাকলে চলে না।
আমাদের অতি সিরিয়াস পাঠে, অতি পাঠে, অতিরিক্ত গবেষণায় কাফকা হয়তো প্রায় ছিবড়ে হয়ে গেছেন। তবু তিনি আজও প্রাসঙ্গিকতা হারাননি। বরং এই মিম কালচার ও গুজবের পৃথিবীতে আমাদের গ্লানি শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে যেই কালো কৌতুক ও অবিরাম বিদ্রুপের স্রোত—প্রায় একশ বছর ধরে পঠিত হতে থাকা জার্মানভাষী লেখক হয়তো তার লেখায় ডেডপ্যান কমেডির আবরণে ভারিক্কি কিছু নয়, বরং লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন জীবন নিয়ে আরও গভীর বিদ্রুপের ইশারা। একটু ভিন্নপাঠের চেষ্টা করলে তা ধরা যেতে পারে, যে, কাফকা হয়তো অত সিরিয়াসও নন, তার অস্বস্তিকর লেখাগুলো এক ধরনের রম্যই, জীবনের উপায়হীনতার প্রতি ছুড়ে দেওয়া বাঁকা হাসি।
মানুষ সিস্টেমের নিষ্পেষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নানান উপায়ে লড়াই করে। প্রতিবাদ, সমালোচনা, গোষ্ঠীগত লড়াই। কিন্তু যখন সে উপায়ও তার থাকে না, সে করে আত্মবিদ্রুপ। যেমন, এখানে বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে মানুষ নিজেও এক সময় বর্ণবাদিতে পরিণত হয়ে যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে আবিষ্কার করে সে নিজেই আর ভিন্নমত সহ্য করার অবস্থায় নেই; ব্যর্থতা ঢাকতে তখন সেও আত্মবিদ্রুপের বর্ম গায়ে তোলে। উন্মুক্ত পুঁজি ও তার মেকানিজম এমন একটা নাজুক জায়গায় নিয়ে মানুষকে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে ভালো ও মন্দের প্রভেদকে একটা অকার্যকর ধারণা মনে হয়, সকলেই যার যার জায়গা থেকে নিজেকে ভিকটিম মনে করতে পারে। জীবন নানান উপায়ে তাকে ট্র্যাজিকমেডির দিকেই ঠেলছে প্রতিনিয়ত। যেন বা কাফকায়েস্ক জগতেরই আরও একটা কানাগলিতে সে উপায়হীন ঢুকে পড়ছে।
প্রাগে কাফকার স্ট্যাচু.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ স কর য
এছাড়াও পড়ুন:
এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)