গভর্নর বললেন, ‘বেশির ভাগ ধান কৃষকের কাছে’, ভিন্নমত বিভাগীয় কমিশনারের
Published: 3rd, July 2025 GMT
ধান কৃষকের কাছে নাকি চালকলমালিকের কাছে আছে, তা নিয়ে বিপরীতমুখী বক্তব্য উঠে এসেছে এক সভায়। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহীর একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সভায় এই বক্তব্য উঠে আসে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে রাজশাহী অঞ্চলের বিজ্ঞ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনের মতামত-পরামর্শ সংগ্রহে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল।
মতবিনিময় সভার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষে মুক্ত আলোচনা শুরুর পর কুষ্টিয়ার এক চালকলমালিক চালের প্রসঙ্গ তোলেন। এ সময় অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেশির ভাগ ধান এখনো কৃষকের কাছেই আছে। তবে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ বলেন, ধান বড় বড় কোম্পানি আগেই কিনে নিয়ে গুদামজাত করছে। বাজারে চালের দাম বাড়বে নাকি কমবে, সেটা কোম্পানিগুলো ঠিক করছে।
মুক্ত আলোচনা শুরুর পর কুষ্টিয়ার এক চালকলমালিক বলেন, এখন ধানের দাম বেশি অথচ কৃষকের কাছে কোনো ধান নেই। তাঁর কথার সূত্র ধরে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এ বছর মোটামুটিভাবে ধানগুলো শুকানো হয়ে গেছে। আমার ধারণা, বেশির ভাগ ধান এখন কৃষকের কাছেই আছে। আমি একটা গবেষণা শুরু করে দিয়েছি। গ্রামে গ্রামে আমার লোক গিয়ে জরিপ করছে। বেশির ভাগ ধান কৃষকের কাছে আছে। এর সুবিধা কৃষকই পাবেন। যে জিনিসটা হয়েছে সেটা হচ্ছে, গত ২০ বছর ধরে হচ্ছে, মৌসুম আসলে ধানের দাম কমে যেত এবং পরে অনেক বেড়ে যেত। সেটার পরিমাণটা কিন্তু এখন দিন দিন কমে আসছে।’
চালকলমালিকদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ‘আপনারা মিলমালিকেরা কিনে ফেলেন অনেকটা। আপনারা যদি না কেনেন, তাহলে বাজারদর আরও কমে যাবে। আমাদের দেখতে হবে, মিলমালিকেরা কতখানি কিনেছে। চাল তো কোথাও যায়নি। চাল তো বাজারেই আসবে। চাল বাংলাদেশেই খাওয়া হবে। এই চাল আপনারাই আবার ভাঙাবেন। অন্য কেউ করবে না। কারণ, ধানটা কিন্তু চাল বানাতে হবে। কোথা থেকে করবে, আপনাদের কাছে না আসলে। আসতেই হবে, আজ হোক আর কাল হবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কথাটা হলো চাল দেশেই আছে। বিষয়টা হলো চালের দাম কেন বাড়ছে, সেটা আমাদের কাছে এখনো রহস্য। চালের দামটা এতখানি বাড়াটা হয়তো উচিত হয়নি বা উচিতের তো ইস্যু না। এটা হয়েছে। এটাই সত্য। কারণটা আপনাদের কাছ থেকে শোনার জন্যই আমি পার্শিয়ালি এখানে আসছি। উত্তরটা হচ্ছে, কার কাছে চালটা আছে। আপনি বলবেন, আপনার কাছে নাই। কৃষক বলবে, আমার কাছে নাই। তাহলে থাকবে কার কাছে? তাহলে আমাদের কাছে, ভোক্তার কাছে আছে? ভোক্তারা তো এক বছরের চাল কিনবে না। ভোক্তার কাছে তো এক মাসের, ১৫ দিনের বা ১০ দিনের চাল থাকতে পারে। থাকতেই হবে কারও কাছে। হয় আপনাদের কাছে, না হয় কৃষকের কাছে। এটা তো আর আমাকে বোঝানোর দরকার নেই। আমাকে বুঝতে হবে কেন বিষয়টা ধরা যাচ্ছে না।’
গভর্নর আরও বলেন, ‘কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। এই বছরের মতো ধানের উচ্চমূল্য কৃষক কোনো দিন পায়নি। গত বছরের চাইতেও বেশি। গত বছরও বেশি ছিল। সত্যি কথা বলতে আমি আমার গ্রামে খোঁজ নিয়েছি। অনেকেই বলছে, ধান বিক্রি করি নাই। গত বছর দেখেছি, পরে দাম বাড়ছে। এবার ধরে রাখছি। শুকাইয়ে ফেলছি ধান। গোলাই রাইখে দিছি। পরে ছাড়ব। এরা কিন্তু সাধারণ কৃষক। হাজার মণওয়ালা, ৫০০ মণওয়ালার কথা বলছি না। ৫০ মণ ধান যার আছে তার কথা বলছি।’
এবার ফ্লোর নিয়ে কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাল খাচ্ছি রশিদ, এরফান—মানে ওই কোম্পানির চাল খাচ্ছি। এলাকায় আমার লোকেরা বলেছে, বড় বড় কোম্পানিরা চাল ধান কিনে ফেলে। তারপর সরকার যখন খাদ্যগুদামে চাল কেনে, সমস্ত লোকেরা যুক্তি দেয়, বাজারের চেয়ে এত কম দিচ্ছে কেন? তারপর সরকার কিনতে পারবে না। এক টাকা বাড়াও। এই দাম কেজিপ্রতি এক টাকা বেড়ে গেল। ওনারা আবার দেড় টাকা বাড়াইল। এখন এভাবেই বড় বড় কোম্পানির সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে।’
গভর্নরের উদ্দেশে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘স্যার যেটা বলেছেন, কৃষকের কাছে ধান আছে। তাদের সংরক্ষণ ক্যাপাসিটি বেড়েছে, এটা সত্য। আবার ইতিমধ্যে ধান বড়রা কিনে তাদের বড় বড় ক্যাপাসিটিতে নিয়ে গেছে, এটাও সত্য। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মডেলে পুরো বাজার তাদের দখলে চলে যাচ্ছে। ওরা যেদিন ইচ্ছা করবে, যেমন ঈদের পরদিন হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ছে। আমাদের খাদ্য উপদেষ্টা মহোদয় ফোন দিয়েছে যে কেন এক টাকা, দুই টাকা বাড়ল?’ তিনি বলেন, ‘ওদের (ব্যবসায়ীদের) ইচ্ছা, ওরা আজকে দাম বাড়াবে, কালকে একটু কমাবে আবার বাড়াবে। এই যে বড় বড় কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে। এতে ঝামেলা হতে পারে, স্যার। এই অঞ্চলে যারা গুদামজাত করার লাইসেন্সপ্রাপ্ত, তারা তো আছেই। লাইসেন্সবিহীন যারা, তারাও কিন্তু বিভিন্নভাবে গুদামজাত করছে। এখন মিলার ভাই যে বললেন, যে উনি জানেন না। উনি যদি না জানেন তাহলে জানবেনটা কে? ওনারাই তো মিলার সমিতি, ওনারাই তো বড় মিলার, মাঝারি মিলার, ছোট মিলার। কৃষকের কাছে কিন্তু আসলে ধান নাই। স্যার, আপনার সঙ্গে সবিনয়ে একটু দ্বিমত করি। ধান কিন্তু ওনারা নিয়ে গেছে। এখন ওনাদের মধ্যে হিসাব-নিকাশে কেউ বাড়াবে, কেউ কমাবে। এখন কুষ্টিয়ায় একটা সেন্টার, নওগাঁয় একটা সেন্টার। জানি না যে কীভাবে তারা তাদের এই পুরো ব্যবসাটা নিয়ন্ত্রণ করে।’
বিভাগীয় কমিশনারের কথার মধ্যেই গভর্নর বলেন, ‘আপনারা একটা শক্ত এস্টিমেট করেন না, কার গুদামে কত আছে? সেটা উৎপাদনের তুলনায় কতখানি।’ বিভাগীয় কমিশনার তৎক্ষণাৎ সেই তথ্য দিতে না পারলেও বলেন, ‘ওইখানে কৃষি বিভাগ বলে যে আমাদের এই বছরে এত হেক্টরের টার্গেটে এত হয়েছে। আবার খাদ্য বিভাগ বলে যে এত পাই নাই। বাকিটা গেল কোথায়?’ তিনি বলেন, বাস্তবের সঙ্গে ডেটায় একটা গ্যাপ আছে, স্যার। বড় মিলারদের যদি কারও এক হাজার মেট্রিক টনের ক্যাপাসিটি থাকে, নিশ্চিত তারা ডাবল রাখে ভেতরে। আবার এদের কোনো জরিমানা বা তদারকির আওতায় আনেন, তাইলে সারা দেশ অচল করে দেবে। দাম বাড়াইয়ে দেবে একদিনে দেড় টাকা করে। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হচ্ছে।’
এবার গভর্নর বলেন, ‘বাজারকে হস্তক্ষেপ করতে যাবেন না। লাভ হবে না। আমাকে বাজার মনিটরিং করতে হবে। অর্থাৎ চালটা কোথায় আছে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। কেন সেটা এর হাতে আছে, ওর হাতে নাই। বা দুজনের হাতেই আছে বা কম আছে। সেটার ভিত্তিতে আমাকে বাজারকে দেখতে হবে।’
ফের মাইক নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘ঈদের পর বড় কিছু হয়েছে? হঠাৎ করে চালের দাম দুই টাকা বাড়ল কেন? কী যুক্তি—এটা আমরা জানি না।’ গভর্নর বলেন, ‘এটা হতেই পারে। আপনি ধানের দাম দেখেন, ধানের দামও বাড়ল। বাড়ল কেন, কোনো ব্যাখ্যা পাবেন না। কথা হইল, ধানের দাম বাড়ছে, চালের দাম বাড়বে। ধানের দামের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্ক। এখন ধানের দামটা আগে বাড়ছে না, চালের দামটা আগে বাড়ছে, এইটা আগে দেখেন। সেইটা বুঝতে হবে। আমি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। চালের দাম কখনোই ধানের দাম না বাড়া পর্যন্ত বাড়বে না। আমার ধারণা। এটা বাড়াতে পারবে না। ধান সস্তা রেখে চালকে বাড়িয়ে দিলে কোনো লাভ হবে না। আলটিমেটলি সেটা বাজারে আসবেই না।’
সভার মূল পর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো.
নির্বাহী পরিচালক মো. এজাজুল ইসলাম অনুষ্ঠানে মুদ্রানীতিবিষয়ক দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র উপস্থাপন করেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বড় বড় ক ম প ন আম দ র র বল ন বছর র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
ধার–অনুদান নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না: অর্থ উপদেষ্টা
নিজস্ব আয় না থাকলে ধার করে বা অনুদান নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নিজস্ব সম্পদ না থাকলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতে সরকার কাজ করবে কীভাবে। ধার করলে কত রকমের সুদ দিতে হয়। আবার খরচের বেলায় স্বাচ্ছন্দ্যও থাকে না।
আজ বুধবার সকালে রাজস্ব ভবনে জাতীয় ভ্যাট দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দুঃখজনক বিষয় হলো, অনেক সময় জনগণ ভ্যাট দিলেও তা সরকারি কোষাগারে পৌঁছায় না। সরকারি কোষাগারে যেন তা পৌঁছায়, সে জন্য পদ্ধতি সহজ করতে হবে। ভ্যাট রাজস্ব আয়ের শক্তিশালী আধুনিক পদ্ধতি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভ্যাটের উপকারিতা
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ভ্যাট চালুর প্রথম দিকে ৯৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এই ভ্যাটের মাধ্যমেই সরকারের আয় বেড়েছে। সেটা না হলে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মতো অনেক ভাতা চালু করা যেত না।
ছোট ব্যবসায়ীদের ভ্যাট দেওয়ার জন্য আলাদা সফটওয়্যার চালু করা হবে বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সরকারি খরচে এই সফটওয়্যার চালু করা হবে। সেখানে প্রবেশ করে ছোট ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে পারবেন। তাঁদের আলাদা কিছু করতে হবে না। ছোটদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় না করলে বড়দের ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার কমে যাওয়ার বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার ছিল ১০ শতাংশ; এখন তা ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।’ জিডিপির হিসাবের পরিবর্তনের কারণে এই অবনমন হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘জিডিপির এমন কোনো অংশ থাকতে পারে, যেখানে আমরা পৌঁছাতে পারছি না। এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। আমাদের কর আহরণ কিন্তু প্রতিবছর বাড়ছে—প্রবৃদ্ধি আছে ১৫ শতাংশ হারে।’ এবার বছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সেমিনারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সচিব ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।