জাতীয় দলের সাবেক পেস বোলিং কোচ চম্পকা রমানায়েকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিং বিপর্যয় দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বাসেই করতে পারছেন না এভাকে কোনো দল হারতে পারে। শ্রীলঙ্কান সাবেক এ ফাস্ট বোলার মনে করেন, ব্যাটাররা বোলারকে রিড করে খেলেনি। ইনিংস বড় করার চেষ্টা করেনি সেট ব্যাটার। সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে একই ভুল না করার অনুরোধ বিসিবির সাবেক এইচপি কোচের। সাবেক শিষ্যদের ব্যাটে ভালো কিছু দেখতে চান তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের নানা দিক উঠে এসেছে চম্পকার সাক্ষাৎকারে। বৃহস্পতিবার কলম্বোয় তার একান্ত সাক্ষাৎকার নেন সেকান্দার আলী।
  
সমকাল: বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে?

চম্পকা: অবশ্যই মনে পড়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। লম্বা সময় কাজ করেছি বিসিবিতে। জাতীয় দলের বোলিং কোচ হিসেবে ২০০৮ সালে নিযোগ পেয়েছিলাম। চুক্তি শেষে এইচপিতে কাজ শুরু করি। আমার ছেলেরাই এখন শ্রীলঙ্কায় খেলছে। তাসকিন আহমেদ, নাজমুল হোসেন শান্ত, তানজিদ হাসান তামিমরা তো আমার হাত দিয়ে এসেছে। আমার কাছে শান্তকে খুব প্রতিভাবান মনে হয়েছে। তাকে দেখলাম নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে। কেন ছেড়েছে জানি না। আমি বলব, তার মতো একজন অধিনায়ক প্রয়োজন বাংলাদেশের। 

সমকাল: তাহলে আপনার ছেলেদের গত ম্যাচে এত খারাপ ব্যাটিং করা নিয়ে কি বলবেন?

চম্পকা: কখনও কখনও এটা হয়। খেলোয়াড়রা হয়তো কল্পনা করতে পারেনি এরকম কিছু হতে পারে। ১০০ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানোর পর ক্রিজে যে ছিল তাকে ইনিংস এগিয়ে নিতে হতো। কারণ একবার উইকেট পড়তে থাকলে থামতে চায় না। এই জিনিসটা সর্বদা ব্যাটারদের মাথায় রাখতে হবে। উইকেট যখন পড়া শুরু হয়েছে তখন কামিন্দু ও হাসারাঙ্গাকে খেলতে পারেনি। সোজা বলেও ব্যাট নিতে পারেনি। আমার কাছে মনে হয়েছে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল। তা না হলে ৫ রানে উইকেট পড়ে না। আমি বলব, তানজিদের উচিত ছিল ইনিংস বড় করা। কারণ সে খুবই প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার। স্কিল আছে, মনযোগ দিয়ে খেললেই হতো। ব্যাটিং পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। পরিস্থিতি বুঝে খেলতে হতো। পিচ কিন্তু খারাপ ছিল না।
    
সমকাল: ভুলটা কোথায় হয়েছে?

চম্পকা: হাসারাঙ্গা সব সময় লাইন লেন্থ ধরে বল করে। বেশিরভাগ গুগলি ডেলিভারি দেয়। সামনে ব্যাট এনে খেলতে হতো তাকে। পেছনে গেলেই বল প্যাডে আঘাত করে। বাংলাদেশের ব্যাটাররা ওখানে ভুল করেছে। এই ম্যাচ থেকে না শিখে থাকলে পরের ম্যাচেও ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে হাসারাঙ্গার কাছে আবারও বিট হবে। শ্রীলঙ্কান এই লেগ স্পিনারের কাছে বহুবার এভাবে পরাস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। 

সমকাল: প্রেমাদাসায় পরের ম্যাচে কি করলে ভালো করা সম্ভব হবে?

চম্পকা: বাংলাদেশের বোলিং বরাবরই ভালো। ৫০ ওভারের ম্যাচে ২৮০ বা ৩০০ রান করতে হবে জিততে। খুব খারাপ উইকেট হলে আলাদা কথা। প্রেমাদাসার উইকেট অতটা খারাপ না। আমি বলব, ব্যাটিংয়ে জুটি গড়ে খেলার চেষ্টা করতে হবে। ১০০ বা ৮০ রানের জুটি হলে বড় সংগ্রহ দাঁড়াবে। আমি বুঝতে পারি সিনিয়ররা চলে যাওয়ায় বাংলাদেশ কিছুটা সংগ্রাম করছে। কিন্তু শান্ত, মিরাজরা তো এখন সিনিয়র। যে কোনো পরিস্থিতিতে দলকে এগিয়ে নিতে তাদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
 
সমকাল: কোচ হিসেবে বাংলাদেশে আপনার কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে?

চম্পকা: আমি খুশি ছিলাম। বিসিবির কাছ থেকে সব ধরনের সমর্থন পেয়েছি। সমস্যা হয়েছে ওখানে একইরকম উইকেটে খেলা হয়। ছেলেদের উচিত ভিন্ন ভিন্ন উইকেটে খেলা। আমি অনেকবার বলার পরও পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বেড়েই উঠে একইরকমের উইকেটে খেলে। ফলে ভিন্ন কন্ডিশনে গিয়ে ভালো করতে পারে না। এছাড়া এইচপির প্রোগ্রাম শুধু প্র্যাকটিসে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। পাঁচ ছয়মাস টানা প্র্যাকটিস করলেই উন্নতি হয় না। এজন্য বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে হতো। এশিয়ার বাইরে ম্যাচ খেলা সম্ভব হলে ছেলেরা বুঝতে পারত কি শিখেছে এবং বিপরীত কন্ডিশনে কিভাবে খেলতে হয়। ম্যানেজমেন্টকে বলেও এটা বুঝাতে পারিনি। এছাড়া আর কোনো অভিযোগ নেই আমার। সেদিক থেকে বলব খুব ভালো ছিলাম ওখানে।
 
সমকাল: বিসিবি থেকে আবার ডাক পেলে যাবেন?

চম্পকা: আমি জানি না নতুন করে ডাকা হবে কিনা। তেমন কোনো প্রস্তাব পেলে খণ্ডকালীন সময়ের জন্য যুক্ত হতে পারি। কারণ আমি এখন ইংল্যান্ডে থাকি। পরামর্শক কোচ হিসেবে কাজ করতে পারি। পূর্ণ সময়ের জন্য হলে করা সম্ভব হবে না।

সমকাল: চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বরখাস্ত করার খবর দেখেছেন?

চম্পকা: এরকমটা শুধু হাথুরুসিংহের সঙ্গে করা হয়নি। আগেও অনেক কোচকে এভাবে বিদায় করা হয়েছে। বেশিরভাগ কোচই কষ্ট নিয়ে ছেড়ে গেছে। যেটা ক্রিকেট বোর্ড বা দেশের জন্য ভালো না। বিশ্বের কাছে এই বার্তা কিন্তু খুব দ্রুত পৌঁছে গেছে। আমরা দেখেছি বাংলাদেশে বড় কোচরা কাজ করতে আগ্রহী হয়নি। আপনি নিয়োগ দেওয়ার পর মেয়াদপূর্ণ হলে বিদায় করে দাও। মাঝপথে চুক্তি বাতিল করা ভালো কিছু না। আমি আশা করব বিসিবি বর্তমান কর্মকর্তারা বিষয়টি অনুধাবন করবেন। সত্যি বলতে আমার সঙ্গে কোনো তিক্ততা ছিল না। কোচদের সম্মান দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোচরা বোর্ডের কাছে সম্মানিত না হলে খেলোয়াড়রা মানবে কেন?

সমকাল: মাহেলা, সাঙ্গাকারা, মুরালিধরনরা অবসর নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কা সংগ্রাম করছিল। এখন কি সেটেল মনে করেন?

চম্পকা: বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কাকেও ট্র্যাানজেকশনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এখন সেটেলে। টেস্টে বেশ কয়েকজন ভালো ব্যাটার উঠে এসেছে। ওয়ানডে দলটি বেশ ভালো করছে। পরিকল্পিতভাবে গেলে বাংলাদেশও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। 

সমকাল: বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামো নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
 
চম্পকা: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট লিগ কিন্তু খারাপ না। ৮ দলের লিগে ভালোই খেলা হয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটই হলো উন্নয়নের সোপান। এখানে খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলা হওয়া উচিত। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে ছেলেরা লড়াই করতে শিখবে না। জাতীয় দলে দুই তিন বছর খেলে হারিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করতে হলে প্রথম শ্রেণি, এ দল এবং এইচপির কার্যক্রম ভালো হতে হবে। ওখান থেকেই জাতীয় দলের জন্য সেরাদের প্রস্তুত করা হয়। জাতীয় দল হলো মনস্তাত্ত্বিক। অভিযোগ করার সুযোগ নেই। দেশের জন্য ভালো খেলাই কাজ। জাতীয় দলে স্মার্ট দেখাতে হবে। স্কিল আছে, সেগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে কাজে লাগাতে হবে। ব্যাটারকে বুঝতে হবে দলের জন্য তার উইকেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সমস্যা হলো মেন্টাল স্কিল ভালো না। এখানে উন্নতি করতে হবে। এটা কোচের কাজ না। নিজেকে নিজে তৈরি করতে হবে। কোচ মাঠে প্র্যাকটিস করাবে, স্কিল দেখাবে, গেম প্ল্যান দেবে, কিন্তু ২২ গজে গিয়ে কোন বলটা কিভাবে খেলবে সে সিদ্ধান্ত ব্যাটারের।
 
সমকাল: জাতীয় দলে খেলার সময় রাজনীতি করতে দেখেছেন বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে?

চম্পকা: (হাসি) বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও সম্ভব না (হাসি.

.)। মিনিস্টার ও এমপিরা ক্রিকেট খেলছে (হাসি)। রাজনীতি এবং খেলা একসঙ্গে চালিয়েছে তারা (মাশরাফি, সাকিব) এটা ভালো না। এমপি যখন খেলবে কোচ তাকে কি পরিকল্পনা দেবে। কারণ সে তো ক্ষমতাবান।
 
সমকাল: আপনি কি মনে করেন সাকিবের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ইমেজ হারিয়েছে?

চম্পকা: অবশ্যই। সে খেলোয়াড়, ক্রিকেটে মনযোগ দেওয়া উচিত ছিল তার। দেশকে ক্রিকেট দিয়ে সেরা করা উচিত ছিল। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর রাজনীতি করার সুযোগ তো ছিলই। তার  মতো একজন ক্রিকেটারের উচিত হয়নি খেলা চলাকালে রাজনীতিতে জড়ানো। এখন তো সে দেশেই ফিরতে পারছে না।

সমকাল: আপনি তো অনেক পেস বোলার নিয়ে কাজ করেছেন। নাহিদ রানাকে তো দেখেননি। সে দ্রুতগতির একজন বোলার। সফল হতে তাকে কি করা উচিত মনে করেন?

চম্পকা: তাকে আমি এইচপিতে পাইনি। তালিকায় থাকলেও ইনজুরির কারণে ক্যাম্পে ছিল না। তাই তার ব্যাপারে খুব বেশি বলা সম্ভব হবে না। কারণ তার সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোও দেখা হয়নি। সে তরুণ একজন বোলার। শুধু পেস না কৌশল দিয়ে ব্যাটারদের পরাস্ত করতে শিখতে হবে তাকে। পেস দিয়ে সব সময় সফল হতে পারবে না। কাটার, ইয়র্কার, ইনসুইং, আউট সুইং শিখতে হবে। তার সঙ্গে কোচদের কথা বলতে হবে। প্রতিটি দেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় দল র উইক ট র জন য র জন ত ক জ কর সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।

নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

প্রামাণিক উৎস

মহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।

সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।

হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্‌হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।

এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।

এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতি

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)

সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮

রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)

তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদা

মহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।

আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)

আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)

পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।

তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা

‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)

তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।

তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)

হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথা

মহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।

মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্রান্সজুড়ে কৃচ্ছ্রতা বিরোধী বিক্ষোভ
  • চিমামান্দা এনগোজি আদিচির নারীবাদ
  • ভোররাতে রণক্ষেত্র: নরসিংদীতে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ ৫
  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে