ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং তা থেকে শুরু হওয়া ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক যুদ্ধ দুটি ভয়াবহ সত্যকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃত ও আগ্রাসীভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে অবজ্ঞা করছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল রাষ্ট্র কোনোভাবেই একা টিকে থাকতে সক্ষম নয়।

এই দুটি বিষয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা মনে হলেও বাস্তবে একটি অন্যটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কারণ, যারা সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইসরায়েলকে টিকিয়ে রেখেছে, তারা সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে মধ্যপ্রাচ্য আর সেই বিস্ফোরণপ্রবণ অঞ্চল থাকবে না। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে অস্থিতিশীল হয়ে আছে এই অঞ্চল। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

অতিমাত্রায় সরলীকরণ না করেও বলা যায়, কঠিন বাস্তবতা হলো ইসরায়েল যদি গাজা থেকে সরে যায় এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত ও গণহত্যার শিকার সেই অঞ্চলকে একটু স্থিতিশীল হয়ে উঠার সুযোগ দেয়, তাহলেই পার্থক্য প্রকাশ্য হয়ে আসবে। এই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি নৃশংসতায় ৫৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৭ হাজারে বেশি শিশু ও ও ২৮ হাজারের বেশি নারী রয়েছেন।

গাজার নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হলে নিহত ব্যক্তিদের এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে।

‘যার শক্তি, সেই সঠিক ও ন্যায্য’—আগামী দিনগুলোর রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে এই ঘৃণ্য নীতি সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সামনে এখন সময় এসেছে, তারা যেন সত্যিকারের ভূমিকা নেয়।
ব্লার্ব: ইসরায়েল বহু বছর ধরেই একদল সমর্থক ও উপকারভোগীর সাহায্য নিয়ে চলছে। ওই উপকারভোগীরা এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার একটি ঘাঁটি হিসেবে দেখে থাকে।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষায় বিশ্ব এগিয়ে এলে হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে।

‘যার শক্তি, সেই সঠিক ও ন্যায্য’—আগামী দিনগুলোর রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে এই ঘৃণ্য নীতি সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সামনে এখন সময় এসেছে, তারা যেন সত্যিকারের ভূমিকা নেয়। তারা যেন নিজেদের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণকে সাহায্য করে এবং নিশ্চিত করে যে ইসরায়েল আর তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।

ইসরায়েলের দৃষ্টিতে এই দাবি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, এমনকি চিন্তার বাইরে। বোঝা যায়, তাদের এই নীতি তাদের ঔপনিবেশিক অবস্থানের কারণেই। কেন?

বিখ্যাত গবেষক প্যাট্রিক উলফ বলেছিলেন, ‘আক্রমণ কেবল কোনো ঘটনা নয়, এটি একটি কাঠামো।’ এই গভীর বক্তব্যটি বুঝিয়ে দেয়, ১৯৪৮ সালের নাকবা বা ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইসরায়েলের সব যুদ্ধ ও দখলদারত্ব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি নিরবচ্ছিন্ন শক্তি কাঠামোর অংশ। তাদের এসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

তাই ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের আচরণকে শুধু প্রতিশোধ বলেই মনে করা ভুল, বরং এর পেছনে সুস্পষ্ট কৌশল ছিল।

গাজার বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ড দেখে আমরা হয়তো প্রথমে এই বিষয় বুঝতে পারিনি। কারণ, গাজায় প্রতিদিনের নৃশংসতা ঘটনা থেকে ইসরায়েল যেন এক অদ্ভুত আনন্দ নিচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে।

তবে ইসরায়েল নিজেই তাদের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বলেছে। দেশটির উগ্রবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর বলেছিলেন, ‘আমরা গাজাকে জনশূন্য দ্বীপে পরিণত করব।’

নেতানিয়াহুর এই উম্মত্ত বক্তব্য ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক কাঠামোরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যতক্ষণ না এটিকে থামানো যায়, ততক্ষণ তার থেকে মুক্তি নেই। কিন্তু কে বা কারা ইসরায়েলকে থামাবে?

গাজায় প্রায় ২১ মাসের অসহনীয় গণহত্যা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে এক কঠিন সত্য—ইসরায়েল হচ্ছে আসলে একটি ‘সামন্ত রাষ্ট্র’ (যে রাষ্ট্র অন্য কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত)। এমন রাষ্ট্র নিজে যুদ্ধ করতে পারে না, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, এমনকি নিজ অর্থনীতি চালাতেও পারে না।

ইসরায়েল বহু বছর ধরেই একদল সমর্থক ও উপকারভোগীর সাহায্য নিয়ে চলছে। ওই উপকারভোগীরা এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার একটি ঘাঁটি হিসেবে দেখে থাকে।

২০২২ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি জনগণের সম্পর্ক রক্ত-মাংসের মতো গভীর। আমরা অভিন্ন মূল্যবোধে ঐক্যবদ্ধ।’

বাইডেনের এই তথাকথিত ‘অভিন্ন মূল্যবোধ’ যে গণহত্যাকে সমর্থন করে, সে বিষয়ে প্রশ্ন না তুলেই বাইডেন আসলে স্বীকার করেছিলেন, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেবল রাজনীতির বিষয় নয়, বরং গভীর আদর্শিক ও কৌশলগত বন্ধন।

পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য নেতাও ইসরায়েল সম্পর্কে অন্ধভাবে একই কথা বলে চলেছেন। তবে গাজায় ইসরায়েলের চলমান এই নৃশংস গণহত্যা বহু দেশকে, বিশেষ করে কিছু পশ্চিমা ও বেশির ভাগ অ–পশ্চিমা দেশকে সাহসের সঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য করেছে।

নেতানিয়াহু ও তাঁর চরমপন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো এতটা জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়নি।

স্পেন, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্লোভেনিয়ার মতো দেশ প্রমাণ করেছে, পশ্চিমা ‘বন্ধন’ চিরকাল অটুট থাকে না। তাদের সমর্থন ইসরায়েলের প্রতি একচেটিয়া বা নিরঙ্কুশ নয়।

কেন কিছু দেশ ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস করছে, আবার কিছু দেশ শত অন্যায় সত্ত্বেও চুপ থাকছে? এই বিষয় আসলে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

পশ্চিমাদের সঙ্গে ইসরায়েলের এই কথিত বন্ধন ভেঙে দেওয়া এখন জরুরি। এটি শুধু ন্যায়ের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।

মার্কিন সরকার নিঃশর্তভাবে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা সময় ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে সরব থাকছেন.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ঔপন ব শ ক গণহত য র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে হবে

ছবি: প্রথম আলো

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
  • জনগণের দাবি, একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন : গিয়াসউদ্দিন
  • ‘নির্বাচন হলেই তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন’
  • গাজায় ৪৮ ঘণ্টায় তিন শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
  • জুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ এবং গণমাধ্যম
  • গাজায় গণহত্যায় মাইক্রোসফটসহ ৬০ কোম্পানি
  • গাজায় ‘গণহত্যার অর্থনীতিতে’ লাভবান মাইক্রোসফট-অ্যামাজনসহ আরো যারা
  • জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে হবে
  • গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় সহায়তা করছে মাইক্রোসফটসহ বহু প্রতিষ্ঠান