প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক ছোট দ্বীপের নাম রাপা নুই, যা ইস্টার আইল্যান্ড নামেই বেশি পরিচিত। এই দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী পাথরের ভাস্কর্য ‘মোয়াই’ এখন সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে। জলোচ্ছ্বাস, আগুন, ভারী বৃষ্টিপাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রায় হাজার বছরের পুরোনো এই ভাস্কর্যগুলো। প্রশ্ন উঠেছে, শেষ পর্যন্ত কি হারিয়ে যাবে রাপা নুইয়ের এই অমূল্য ঐতিহ্য?

দ্বীপটির প্রাচীন এক আগ্নেয়গিরির খোলা মুখে এখনও দেখা মেলে অসম্পূর্ণ মোয়াই ভাস্কর্যের। সেখানে পাথর কেটে গড়ে তোলা হয়েছে বহু ভাস্কর্য, যেগুলোর মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া ভ্রুকুটি আর খাড়া নাক। মূলত ১১০০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দ্বীপটির প্রাচীন পলিনেশীয় জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে তৈরি করেছিল এসব ভাস্কর্য।

বর্তমানে দ্বীপটিতে এমন প্রায় এক হাজার মোয়াই রয়েছে; যার মধ্যে ২০০টির মতো ভাস্কর্য রাখা আছে পাথরের ভিত্তির ওপর, যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘আহু’। এসব ভাস্কর্যের বেশির ভাগই তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। দূর থেকে শক্তপোক্ত মনে হলেও এগুলো মূলত আগ্নেয় ছাই দিয়ে তৈরি নরম ‘টাফ’ পাথরের; যা বৃষ্টি, বাতাস ও লবণাক্ত জলীয় বাষ্পে সহজেই ক্ষয়ে যায়।

রাপা নুইয়ের স্থানীয় পর্যটনকর্মী মারিয়া টুকি বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন, একদিন মোয়াই আবার সাগরে ফিরে যাবে।’ দীর্ঘদিন ধরে এই ক্ষয় চললেও সাম্প্রতিক দশকে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে গেছে।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় মাঝে মাঝে দ্বীপটিতে হয় প্রবল বর্ষণ, যা পাথরের গায়ে শক্ত আঘাত হানে। সমুদ্রের লবণাক্ত জলীয় বাষ্প ফাপা পাথরের ভেতরে ঢুকে স্ফটিক তৈরি করে, ফলে ভেতর থেকে ভাস্কর্যটি ফেটে যেতে থাকে। এছাড়া ২০২২ সালের অক্টোবরে এক ভয়াবহ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৮০টি মোয়াই।

এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় ‘মাউ হেনুয়া’ কমিউনিটি ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। থ্রিডি স্ক্যানিং, ড্রোন ম্যাপিং, রাসায়নিকের প্রলেপের মতো সব চেষ্টাই চলছে ক্ষয়রোধে।

রাপা নুই দ্বীপের নির্মাণাধীন নতুন একটি জাদুঘরে কিছু মোয়াই স্থাপন করার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে দ্বিধায় পড়েছেন দ্বীপবাসীরা। একপক্ষ চান ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষিত হোক। অন্যপক্ষ মনে করেন, তাদের প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ডেল সিম্পসন জুনিয়র বলেন, ‘পলিনেশীয় সংস্কৃতিতে অনেক পুরোনো শিল্পকর্ম ইচ্ছা করেই ধ্বংস করা হয়, এটি তাদের জীবনচক্রের অংশ।’

তবে অনেক রাপা নুইবাসী মনে করেন, মোয়াই শুধু পাথরের ভাস্কর্য নয়, এগুলো পলিনেশীয় মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। একইসঙ্গে দ্বীপটির বর্তমান অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিও মোয়াইঘনিষ্ঠ পর্যটন।

তাই রাপা নুইয়ের বাসিন্দারা আজ এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি, মাটিতে মিশে যাওয়াই কি হবে মোয়াইয়ের নিয়তি? নাকি আরও শত শত বছর পরেও দাঁড়িয়ে থাকবে এই রহস্যময় পাথরের মানুষগুলো। নীরব অভিভাবকের মতো পাহারা দেবে দ্বীপের ইতিহাস ও অস্তিত্বকে। সূত্র: বিবিসি, ভাষান্তর- আসিফ মাহমুদ

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ স কর য ভ স কর য

এছাড়াও পড়ুন:

পশ্চিমা শক্তিকে চাপে রাখার কৌশলে ইরান

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে তেহরান। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শন সীমিত করার বিল অনুমোদনের মাধ্যমে এই চাপ অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়; আইএইএর বিরুদ্ধে বিল অনুমোদনের পরও সংস্থাটির কর্মকর্তাদের তেহরান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তেহরান পশ্চিমা শক্তিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এপির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।  

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ওই বিলটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সুরক্ষা চুক্তির অধীনে আইএইএর সঙ্গে সমস্ত সহযোগিতা অবিলম্বে স্থগিত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পারমাণবিক স্থাপনা ও বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কিছু নির্দেশনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এ আদেশ কার্যকর থাকবে।

আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধের সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষেপেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ইরানের। অথচ তারা আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অগ্রহণযোগ্য। 

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সার এক্স পোস্টে বলেন, ‘আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে ইরান। দেশটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক বাধ্যবাধকতা ও প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেছে।’ 

অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে মনে করা হয়। তারাও আইএইএর প্রবেশাধিকার দেয়নি। গত ১৩ জুন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে হামলা চালালে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়।   

এদিকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে গেছে। ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি। পরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁস হওয়া তথ্যে বলা হয়েছিল, পারমাণবিক স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। ইরান কয়েক মাসের জন্য কর্মসূচিতে ফিরতে পারে। এই বক্তব্য ট্রাম্প প্রশাসন অস্বীকার করে। তারা জোর দিয়ে জানায়, হামলায় স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তখনও এ বক্তব্যের পক্ষে নথি ছিল না। 
সর্বশেষ গত বুধবার প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পার্নেল এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘মার্কিন হামলা ইরানের কর্মসূচি দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ধ্বংস করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে।’ এবারও পার্নেল তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করেননি। বরং তিনি আবারও বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা মূল্যায়নে এমনটাই ‘ধারণা’ করা হচ্ছে।   

এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সিবিএস নিউজের একটি সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেহরান এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। তবে আলোচনা এত তাড়াতাড়ি পুনরায় শুরু হবে, তা তিনি মনে করেন না। অন্যদিকে কূটনীতির দরজা কখনোই বন্ধ হবে না বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। 

এদিকে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট বলেন, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত বন্দিদের মুক্তির ওপর নির্ভর করছে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দুই ফরাসি নাগরিক সিসিল কোহলার ও জ্যাক প্যারিসকে আটক করে ইরান। 

ইরান ও সিরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে গোপন আলোচনা করেছে ইসরায়েল। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর তেলআবিব বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে।  

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম মুসাভি। তিনি বলেন, যদি শত্রুরা ইরানের বিরুদ্ধে আবার কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তাদেরকে আরও ‘বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া’ মোকাবিলা করতে হবে।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ