দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন নৈতিক পরীক্ষায় দিল্লি
Published: 27th, October 2025 GMT
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা অনেকেই জানেন, এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একধরনের ঝড়। সেটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কাবুল। তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সম্প্রতি (১০-১৬ অক্টোবর) নয়াদিল্লি সফর নিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব অবস্থা এটিই।
এ সফরের সর্বশেষ খবর হলো কাবুলে ২১ অক্টোবর থেকে ভারত তার দূতাবাস পুনরায় খুলে দিয়েছে। চার বছর ধরে ভারতের এই দূতাবাস বন্ধ ছিল। ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড পামারস্টনের একটি উক্তি আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তব রাজনীতিতে যেন নতুন করে প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, ‘রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ।’
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের উষ্ণতা এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
যে তালেবানকে একসময় ভারত ‘চরমপন্থী গোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর সমালোচনা করেছিল, আজ সেই সরকারের সঙ্গেই নয়াদিল্লি নতুন সেতুবন্ধের পথে হাঁটছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এই হঠাৎ উষ্ণতা? আর এই কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা কি টেকসই হবে?
২.ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের শিকড় বেশ পুরোনো। প্রাচীনকাল থেকে কাবুল, কান্দাহার ও হেরাতের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল নিবিড়। মোগল সাম্রাজ্যের উত্থানেও আফগান বংশীয় শাসকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কাবুল ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক ছিল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত দখলের সময়েও ভারত ছিল আফগান সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সংসদ ভবন নির্মাণ, সড়ক প্রকল্প, হাসপাতাল, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো—প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্পে ভারতের সম্পৃক্ততা ছিল বিশাল।
তবে ১৯৯৬ সালে তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় এলে সেই সম্পর্কের পুরো চিত্র পাল্টে যায়। কট্টর ইসলামি ব্যাখ্যা, নারীর অধিকারবিরোধী নীতি ও পাকিস্তানঘেঁষা কূটনীতি ভারতকে দূরে সরিয়ে দেয়। বিশেষত ১৯৯৯ সালের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস অপহরণকাণ্ডে তালেবানের ভূমিকা ভারতীয় জনমনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুনআমরা ভারতের হয়ে পাকিস্তানের আর পাকিস্তানের হয়ে ভারতের পক্ষে লড়ব না২৬ অক্টোবর ২০২৫৩.২০২১ সালে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলে তালেবান পুনরায় কাবুল দখল করে। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে, আর ভারত তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাস বন্ধ করে নিজ নাগরিকদের সরিয়ে নেয়।
তবে কূটনীতিতে শূন্যতা কখনো স্থায়ী হয় না। সময়ের সঙ্গে দেখা যায়, তালেবান তাদের শাসনকে তুলনামূলকভাবে ‘বাস্তববাদী’ রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তারা উপলব্ধি করেছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। ফলে ধীরে ধীরে ভারতের মতো দেশগুলোকেও কৌশলগতভাবে কাছে টানতে শুরু করে তারা।
চীন, রাশিয়া, ইরান, কাতার, তুর্কমেনিস্তান—এসব দেশই তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এ অবস্থায় ভারতও বুঝেছে, আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য ঠিক হবে না।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক শান্তনু মুখার্জি বলেছেন, ‘তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক কেবল কৌশলগত নয়, নৈতিক পরীক্ষাও বটে। ভারত যদি তার মূল্যবোধ হারায়, তবে সে নিজের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিও হারাবে।’৪.ভারতের এই কৌশলগত পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তান। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ইসলামাবাদ ভেবেছিল, আফগানিস্তান তাদের ‘কৌশলগত গভীরতা’ হিসেবেই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা।
ডুরান্ড লাইন নিয়ে সীমান্ত সংঘর্ষ, বাণিজ্যপথ বন্ধ, এমনকি কূটনৈতিক বিবাদ—সবই বেড়েছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির প্রকাশ্যে তালেবানকে ‘সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়দাতা’ আখ্যা দিয়েছেন। তালেবানও পাল্টা সুরে ইসলামাবাদকে ‘অন্য দেশের এজেন্ট’ বলে অভিহিত করেছে।
এ অবস্থায় নয়াদিল্লি বুঝে নিয়েছে, ইসলামাবাদ-কাবুল দূরত্ব ভারতের জন্য এক নতুন কৌশলগত জানালা খুলে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রভাব সীমিত হলে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা বাড়বে।
আরও পড়ুনপাকিস্তান-আফগান উত্তেজনায় ডুরান্ড লাইন কেন আলোচনায়২৩ অক্টোবর ২০২৫৫.তালেবান নেতৃত্বের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ার দেওবন্দি ধারার অনুসারী। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে বহু আফগান আলেম শিক্ষা নিয়েছেন। দেওবন্দি মতবাদই তালেবানের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক ধর্মীয় সেতুবন্ধ এখন ভারতের জন্য এক নরম কূটনীতির (সফট ডিপ্লোমেসি) সুযোগ তৈরি করছে।
যদিও ভারতের নীতিগত আদর্শ গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, তবু বাস্তবতা বলছে, ‘ধর্মীয় আত্মীয়তার রাজনীতি’ও এখন কার্যকর হাতিয়ার।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন ক টন ত ক ক শলগত র জন ত ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘বন্দরের মাশুল বাড়ানোর এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই’
চট্টগ্রাম বন্দর বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করে। তারপরও বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর তুলে দেওয়ার আগে তাদের মুনাফা নিশ্চিতের জন্য সরকার বন্দরের মাশুল ৪১ শতাংশ বাড়িয়েছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু বর্তমান সরকার তড়িঘড়ি করে, কারও মতামতের তোয়াক্কা না করে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা না দেওয়ার দাবিতে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ সমাবেশে এমন মন্তব্য করেছেন শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবীরা। আজ শনিবার বেলা ১১টায় নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বাদামতলী মোড়ে ‘বন্দর রক্ষায় চট্টগ্রামের শ্রমিক-ছাত্র-পেশাজীবী-নাগরিকবৃন্দ’–এর ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
গণমুক্তি ইউনিয়নের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজা মিঞার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি খোরশেদ আলম, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) যুগ্ম সমন্বয়ক রিজওয়ানুর রহমান, বাসদ (মার্ক্সবাদী) জেলা সমন্বয়ক শফি উদ্দিন কবির, বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সেক্রেটারি ইব্রাহিম খোকন, ডক শ্রমিক দলের সেক্রেটারি আখতারউদ্দিন সেলিম, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন সেক্রেটারি জাহিদউদ্দিন, গণ অধিকার চর্চা কেন্দ্রের মশিউর রহমান খান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও নিউমুরিং টার্মিনাল ও লালদিয়য়ার চর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। বিনা প্রতিরোধে এ চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বন্দর এলাকায় এক মাসের জন্য সভা–সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিনা দরপত্রে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিউমুরিং টার্মিনাল তুলে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। গণ–অভ্যুত্থানের পরও বর্তমান সরকার কেন আওয়ামী লীগের এ চক্রান্ত বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, তার জবাব দিতে হবে।
বন্দরের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তারা বলেন, ‘অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে একাধিক বন্দর নেই। দেশের বেশির ভাগ আমদানি–রপ্তানি যে বন্দর দিয়ে হয়, সে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানির কাছে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানগত কারণে এর সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব-নিরাপত্তার কৌশলগত প্রশ্নও যুক্ত। এ কারণেই আমরা দাবি তুলেছি, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কৌশলগত জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের দেওয়া যাবে না, বেসরকারীকরণও করা যাবে না। জাতীয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালনা করতে হবে।’
গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি সত্যজিৎ বিশ্বাসের সঞ্চালনায় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার পরিষদের প্রকৌশলী সিঞ্চন ভৌমিক, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন সেক্রেটারি জাহেদুন্নবী কনক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নেতা সাইফুর রুদ্র, বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল সভাপতি হুমাযুন কবির, আবদুল্লাহ আল মামুন, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল সভাপতি ধ্রুব বড়ুয়া, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নগর দপ্তর সম্পাদক লাবণী আকতার।