নির্বাচন সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে নামসর্বস্ব অনেক রাজনৈতিক দল। এসব দলের কোনোটির নেই কার্যকরী কমিটি; কোনোটি আছে শুধুই কাগজ-কলমে। আবার কোনো দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তো দূরের কথা, সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ৬৫টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক দলই গঠিত হয়েছে গত বছর ৫ আগস্টের পর। এসব দলের অফিস ও ঠিকানা, সাংগঠনিক কার্যক্রম খুঁজে বের করা এবং নথি-সংবলিত সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির কাছে আবেদন করে নিবন্ধন পায়নি ৮৭টি দল। তারাও তাদের আবেদন পুনর্মূল্যায়নের জন্য ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫৫টি।

অন্যদিকে, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ৪৬টি দল নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ এপ্রিল আগামী ২২ জুন পর্যন্ত দুই মাস সময় বাড়ায় ইসি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন নিয়ে পরিকল্পনা করবে ইসি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ৯ মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) নতুন ২৪টি রাজনৈতিক দল। এ সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইসি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে পাঁচটি দল। এগুলো হচ্ছে– এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজিপি)। 

গত ২৫ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করেছে জনতা পার্টি বাংলাদেশ। এ দলের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও মহাসচিব সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি (বিএনজিপি)। নতুন এ দলের আহ্বায়ক মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর। তবে এত কম সময়ে দুই ডজন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন দল গঠনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন দল গঠন করতে দেখা গেছে। আর আগামী নির্বাচনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। তাদের ভাষ্য, নির্বাচন এলেই ব্যাঙের ছাতার মতো এমন অনেক রাজনৈতিক দল গজিয়ে ওঠে।

তবে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশকে আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত করা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই তা স্বার্থ ও ক্ষমতাচর্চার একটি রূপ বলে মত বিশ্লেষকদের। একই সঙ্গে ভোটের সময় জোট-রাজনীতিও এই প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে বলে মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড.

বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, এখন দেখছি বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এগুলো নানা কারণে হতে পারে। তবে নাম ফোটানো, ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা বা নিজেদের আলোচনায় আসার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলে তা ইতিবাচক হবে না। দল গঠন করলে দেশ ও জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগির জন্যও এসব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।   
তবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন নিবন্ধন পায়, সে ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে রাখতে হবে বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান।   

এ পর্যন্ত ৫৫টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পেয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। 
এদিকে ‘নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি’, ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’, ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’, ‘জনতার কথা বলে’, ‘সমতা পার্টি’– এ ধরনের বাহারি নামের অনেক দল রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয়নি।

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. নুর ইসলাম শিকদার। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার একটি সুপার মার্কেটের দোতলায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল। ঝড়ের কারণে দলের সাইনবোর্ড উড়ে গেছে। নতুন করে সাইনবোর্ড বানাতে দিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রস্তুত করবেন বলে জানান নুর ইসলাম।

আরেক আবেদনকারী বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশকে বেকারমুক্ত করতে এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছি। এবারই প্রথম নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে সারাদেশে তাঁর দলের আটটি জেলা ও ৭২টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে।

বাংলাদেশের জাস্টিস পার্টি (বাজাপা) চেয়ারম্যান সৈয়দ জাভেদ মো. সালেহউদ্দিন বলেন, আগে দুইবার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলেও নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। আমাদের আট থেকে ১০টি উপজেলায় দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। তবে সেটি কোন কোন জেলায়, তা তিনি জানেন না। 

বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল, বাংলাদেশ মুক্তি পরিষদ ও জাস্টিস পার্টির মতো নিবন্ধনের জন্য ইসির দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারেনি এমন অনেক দল। এনসিপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এনসিপি কার্যক্রম শুরু করেছে মাত্র দুই মাস। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ওইভাবে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। এখন পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন হয়নি। চূড়ান্ত হয়নি দলের গঠনতন্ত্র ও ইশতেহার। এগুলো চূড়ান্ত হলেই নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করা হবে। তবে দলের যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দলীয় ফোরামে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।  
অবশ্য নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, আমরা জেনেছি, নিবন্ধনের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। আমরা দুই মাস সময় বাড়িয়েছি। পরবর্তী সময়ে কী করা হবে– দুই মাস পর সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। যদি আইন পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে ওইভাবেই নিষ্পত্তি করে দেওয়া হবে। 

ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধিত হতে হয়। এ নিবন্ধন পেতে কিছু শর্ত পূরণ করার বিধান আছে। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এসব শর্ত কিছুটা সহজ করার সুপারিশ করেছে। তবে সে সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। আগের শর্তেই নিবন্ধন চায় ইসি।

জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য কিছু শর্তের উল্লেখ আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে– দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর অফিস, অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন (মহানগর) থানায় কার্যালয় এবং প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে।
এর বাইরে নিবন্ধনের জন্য দলের গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিধান রয়েছে। যেমন– কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা, সব পর্যায়ের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ সদস্যপদ নারীদের জন্য নির্ধারিত রাখা এবং পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা শ্রমিক ও অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না থাকা ইত্যাদি।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল মাত্র দুটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)।

এদিকে ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামে দলের নিবন্ধন চেয়ে ইসির কাছে আবেদন করেছেন মাওলানা মাহমুদ আব্বাস, ‘সমতা পার্টি’র নিবন্ধনে হানিফ বাংলাদেশি, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন আন্দোলন’-এর নামে আলাল হোসেন খন্দকার, ‘বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক দল’-এর আবেদনে লায়ন নূর ইসলাম, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস বাংলাদেশ (এনসিবি)’-এর ছাবের আহাম্মদ (কাজী ছাব্বীর), ‘বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি’র নামে মুহাম্মদ মুজ্জামেল হক, ‘তৃণমূল জাতীয় পার্টি’র এএএম শামীম, ‘বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি’র কেএম আবু হানিফ হৃদয়, ‘সর্বজন বিপ্লবী দল’-এর প্রকৌশলী ইনামুল হক এবং ‘মৌলিক বাংলা’ নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন ছাদেক আহমেদ (সজীব)।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে আমাদের একটা যাচাই-বাছাই তালিকা রয়েছে। নিবন্ধনের আগে আমরা দেখব, নতুন আবেদনকারী দলগুলো তাদের শর্ত পূরণ করেছে কিনা।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দল র ক ন ব যবস থ দল গঠন গঠন কর দলগ ল গঠন ক উপজ ল এনস প সদস য ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

ইসিতে নিবন্ধন পেতে তৎপর নামসর্বস্ব ৬৫ রাজনৈতিক দল

নির্বাচন সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে নামসর্বস্ব অনেক রাজনৈতিক দল। এসব দলের কোনোটির নেই কার্যকরী কমিটি; কোনোটি আছে শুধুই কাগজ-কলমে। আবার কোনো দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তো দূরের কথা, সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ৬৫টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক দলই গঠিত হয়েছে গত বছর ৫ আগস্টের পর। এসব দলের অফিস ও ঠিকানা, সাংগঠনিক কার্যক্রম খুঁজে বের করা এবং নথি-সংবলিত সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির কাছে আবেদন করে নিবন্ধন পায়নি ৮৭টি দল। তারাও তাদের আবেদন পুনর্মূল্যায়নের জন্য ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫৫টি।

অন্যদিকে, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ৪৬টি দল নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ এপ্রিল আগামী ২২ জুন পর্যন্ত দুই মাস সময় বাড়ায় ইসি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন নিয়ে পরিকল্পনা করবে ইসি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ৯ মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) নতুন ২৪টি রাজনৈতিক দল। এ সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইসি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে পাঁচটি দল। এগুলো হচ্ছে– এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজিপি)। 

গত ২৫ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করেছে জনতা পার্টি বাংলাদেশ। এ দলের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও মহাসচিব সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি (বিএনজিপি)। নতুন এ দলের আহ্বায়ক মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর। তবে এত কম সময়ে দুই ডজন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন দল গঠনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন দল গঠন করতে দেখা গেছে। আর আগামী নির্বাচনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। তাদের ভাষ্য, নির্বাচন এলেই ব্যাঙের ছাতার মতো এমন অনেক রাজনৈতিক দল গজিয়ে ওঠে।

তবে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশকে আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত করা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই তা স্বার্থ ও ক্ষমতাচর্চার একটি রূপ বলে মত বিশ্লেষকদের। একই সঙ্গে ভোটের সময় জোট-রাজনীতিও এই প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে বলে মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, এখন দেখছি বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এগুলো নানা কারণে হতে পারে। তবে নাম ফোটানো, ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা বা নিজেদের আলোচনায় আসার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলে তা ইতিবাচক হবে না। দল গঠন করলে দেশ ও জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগির জন্যও এসব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।   
তবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন নিবন্ধন পায়, সে ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে রাখতে হবে বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান।   

এ পর্যন্ত ৫৫টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পেয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। 
এদিকে ‘নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি’, ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’, ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’, ‘জনতার কথা বলে’, ‘সমতা পার্টি’– এ ধরনের বাহারি নামের অনেক দল রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয়নি।

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. নুর ইসলাম শিকদার। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার একটি সুপার মার্কেটের দোতলায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল। ঝড়ের কারণে দলের সাইনবোর্ড উড়ে গেছে। নতুন করে সাইনবোর্ড বানাতে দিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রস্তুত করবেন বলে জানান নুর ইসলাম।

আরেক আবেদনকারী বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশকে বেকারমুক্ত করতে এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছি। এবারই প্রথম নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে সারাদেশে তাঁর দলের আটটি জেলা ও ৭২টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে।

বাংলাদেশের জাস্টিস পার্টি (বাজাপা) চেয়ারম্যান সৈয়দ জাভেদ মো. সালেহউদ্দিন বলেন, আগে দুইবার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলেও নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। আমাদের আট থেকে ১০টি উপজেলায় দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। তবে সেটি কোন কোন জেলায়, তা তিনি জানেন না। 

বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল, বাংলাদেশ মুক্তি পরিষদ ও জাস্টিস পার্টির মতো নিবন্ধনের জন্য ইসির দেওয়া শর্ত পূরণ করতে পারেনি এমন অনেক দল। এনসিপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এনসিপি কার্যক্রম শুরু করেছে মাত্র দুই মাস। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ওইভাবে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। এখন পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন হয়নি। চূড়ান্ত হয়নি দলের গঠনতন্ত্র ও ইশতেহার। এগুলো চূড়ান্ত হলেই নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করা হবে। তবে দলের যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দলীয় ফোরামে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।  
অবশ্য নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, আমরা জেনেছি, নিবন্ধনের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। আমরা দুই মাস সময় বাড়িয়েছি। পরবর্তী সময়ে কী করা হবে– দুই মাস পর সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। যদি আইন পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে ওইভাবেই নিষ্পত্তি করে দেওয়া হবে। 

ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধিত হতে হয়। এ নিবন্ধন পেতে কিছু শর্ত পূরণ করার বিধান আছে। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এসব শর্ত কিছুটা সহজ করার সুপারিশ করেছে। তবে সে সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। আগের শর্তেই নিবন্ধন চায় ইসি।

জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য কিছু শর্তের উল্লেখ আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে– দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর অফিস, অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন (মহানগর) থানায় কার্যালয় এবং প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে।
এর বাইরে নিবন্ধনের জন্য দলের গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিধান রয়েছে। যেমন– কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা, সব পর্যায়ের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ সদস্যপদ নারীদের জন্য নির্ধারিত রাখা এবং পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা শ্রমিক ও অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না থাকা ইত্যাদি।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল মাত্র দুটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)।

এদিকে ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামে দলের নিবন্ধন চেয়ে ইসির কাছে আবেদন করেছেন মাওলানা মাহমুদ আব্বাস, ‘সমতা পার্টি’র নিবন্ধনে হানিফ বাংলাদেশি, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন আন্দোলন’-এর নামে আলাল হোসেন খন্দকার, ‘বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক দল’-এর আবেদনে লায়ন নূর ইসলাম, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস বাংলাদেশ (এনসিবি)’-এর ছাবের আহাম্মদ (কাজী ছাব্বীর), ‘বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি’র নামে মুহাম্মদ মুজ্জামেল হক, ‘তৃণমূল জাতীয় পার্টি’র এএএম শামীম, ‘বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি’র কেএম আবু হানিফ হৃদয়, ‘সর্বজন বিপ্লবী দল’-এর প্রকৌশলী ইনামুল হক এবং ‘মৌলিক বাংলা’ নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন ছাদেক আহমেদ (সজীব)।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে আমাদের একটা যাচাই-বাছাই তালিকা রয়েছে। নিবন্ধনের আগে আমরা দেখব, নতুন আবেদনকারী দলগুলো তাদের শর্ত পূরণ করেছে কিনা।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ