বিদেশি পণ্যের কদর বাঙালিদের কাছে খুব যে বেশি, তার উত্তম নমুনা কচুরিপানা ও রিকশা। বাংলাদেশে কচুরিপানা আসে ১৮৮৪ সালে। এর আগে এ দেশে কচুরিপানা ছিল না। ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে জর্জ মরগান নামে এক ব্যবসায়ী ব্রাজিল থেকে ঢাকায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। এর পর খালবিল, জমি, জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালে এক কৃষি প্রতিবেদনে সারাবাংলায় ২০ শতাংশ জমি কচুরিপানায় ছেয়ে গিয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয়; ১৯৩৭ সালে আইন পরিষদ নির্বাচনে শেরেবাংলা এ.
দ্বিতীয় যে বিদেশি জিনিসটির বাংলাদেশে অতি দ্রুত বিস্তার হয়, তা হলো রিকশা। ঢাকায় রিকশার আগমন ১৯৪০ সালে। কলকাতায় এসেছিল ১৯০০ সালে। বিবিসি এক রিপোর্টে লিখেছে, ১৯৪১ সালে ঢাকায় রিকশা ছিল মাত্র ৩৭টি। ১৯৪৭ সালে ১৮১টি। ১৯৯৪ সালে রিকশা নিবন্ধন শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৫৭২-এ। ২০১৮ সালে বিলস নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় রিকশা ছিল ১১ লাখ। রিকশা-সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ছিল ২৭ লাখ। এখন নিশ্চয় তা বেড়েছে।
ঢাকায় রিকশা চলে দুই শিফটে; দিনে ও রাতে। বেশির ভাগ চালক রিকশা চালান ১৫ দিন। বাকি ১৫ দিন অলস কাটান। সেই হিসাবে চালক সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ এবং ঢাকায় রিকশা চালানো পেশার ওপর নির্ভর জনসংখ্যা আধা কোটির কম নয়, অনুমান করি। রিকশা চালানোই সম্ভবত ঢাকার প্রধানতম পেশা। কৃষির পর সারাদেশে এটিই সম্ভবত বৃহত্তম একক পেশা হতে পারে বৈ কি!
যদিও এসব নিয়ে সরকারি পর্যায়ে খুব একটা উপাত্ত নেই। রিকশা নিয়ে এত কথার কারণ, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত ও পদচালিত রিকশার বাহুল্য। এ নিয়ে গলিতে গলিতে অভিযান, বিশৃঙ্খলা, ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বুয়েটের মতো খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠে রিকশার মডেল নিয়ে অঢেল গবেষণাও নাকি হচ্ছে। কিছুদিন আগে শাহবাগে রিকশা জমাট কর্মসূচির ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
রিকশা আসার পরে আগাছার মতো বেড়েছে; জংলার মতো নগরে ছড়িয়েছে। রিকশা ঢাকার গতি মন্থর করেছে সত্য। অন্যদিকে যুক্তি আছে, রিকশা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমুন্নত রেখেছে। হিসাবটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। গড়ে ৬০-৭০ কিলোমিটার হিসাবে ১১ লাখ রিকশা প্রতিদিন সম্মিলিতভাবে ৬ কোটি ৬০ লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। এই পথ ডিজেলচালিত একটি গাড়িতে পাড়ি দিতে প্রায় ৬৬ লাখ লিটার তেল লাগত, যার বাজারমূল্য দৈনিক প্রায় ৭০ কোটি টাকা। বছরে ২৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা! ডলারের হিসাবে প্রায় ২০০ কোটির বেশি। এ তো শুধু ঢাকা শহরের হিসাব। পুরো দেশের হিসাব আরও বড়। এই হিসাব গড়পড়তা ও আনুমানিক!
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকায় ইলেকট্রিক-ব্যাটারি রিকশা চলার ঘোষণা দিয়েছিল। এ জন্য কোনো সমীক্ষা তারা চালিয়েছিল কিনা, নজরে আসেনি। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে শুরু করলে হিসাবটা ঠিক উল্টে যাবে।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো, রিকশা নিয়ে গবেষণা নেই। ঢাকার যে বিশাল জনচাপ, তাতেও রিকশার দায় আছে। রিকশা শ্রমিক ও তার পরিবার-স্বজন মিলে আধাকোটির বেশি লোক ঢাকা ও আশপাশে থাকে। রিকশায় আয় বেশি। কৃষি শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশ রিকশায় মাইগ্রেট হয়েছে। এর ফলে কৃষি খাত শ্রমিক সংকটে ভুগছে।
হাজার হাজার হেক্টর জমি খালি পড়ে আছে। যেগুলো চাষাবাদ হচ্ছে, তাও শ্রমিক সংকটে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে যেতে পারছে না। আমাদের পেঁয়াজ সংকট, চাল সংকট, তেল সংকট প্রকট। পেঁয়াজ-আলু-সরিষা উৎপাদনের জন্য কৃষিজমির অভাব নেই। শ্রমিক সংকট প্রকট। শ্রমিক যা পাওয়া যায়, তাদের শ্রমমূল্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ায় কৃষক পড়ছে বিপদে। কৃষির চেয়ে রিকশা চালানোই বেশি আরামের ও অর্থকরী।
রাষ্ট্রে পর্যাপ্ত জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও খাতওয়ারি সুষম শ্রম বণ্টনের অভাবে বাংলাদেশে উৎপাদনশীলতা কমেছে বা কাম্য অবস্থায় নেই। ঢাকায় কোনো ওয়ার্ডে কতটি রিকশা থাকা দরকার কিংবা কৃষিতে কোন মৌসুমে কত শ্রমিক থাকা দরকার, সে উপাত্ত থাকা জরুরি। রবিশস্যের মৌসুমে কৃষিতে যে শ্রমিক থাকা দরকার, তারা তখন ঢাকায় অটোরিকশার মতো আরামদায়ক যান চালানোর জন্য জড়ো হচ্ছেন।
রাষ্ট্রের উচিত শ্রম মাইগ্রেশন কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, কতটা– তা দেখা এবং খাতগুলোতে ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখা। তা করা গেলে এ বছর আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়লেও পরের বছরগুলোতে এমন হবে না বোধ করি। মহানগরও হবে শান্তিময়।
মনোয়ার রুবেল: প্রাবন্ধিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইশরাকের নামাজের সময়সূচি ও বিধান
ইশরাকের নামাজ ইসলামে একটি নফল নামাজ, যা ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের কিছু সময় পরে আদায় করা হয়। এটি সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা (ঐচ্ছিক সুন্নত) হিসেবে বিবেচিত এবং এর ফজিলত অনেক।
মহানবী (সা.) এই নামাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশেষ পুরস্কার অর্জন করতে পারেন।
ইশরাকের নামাজের সময়সূচিইশরাকের নামাজের সময় ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হয় এবং সূর্যোদয়ের পর শেষ হয়। নিচে এর সময়সূচি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:
শুরুর সময় : ইশরাকের নামাজ সূর্যোদয়ের প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর থেকে শুরু হয়, যখন সূর্য সম্পূর্ণভাবে দিগন্তের উপরে উঠে যায়। এই সময়টি সাধারণত ফজরের নামাজের সময় শেষ হওয়ার পর থেকে শুরু হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ, সাইয়্যিদ সাবিক, পৃষ্ঠা: ১৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১৮)
ধরা যাক, ফজরের সময় ঢাকায় সকাল ৪:৩০ এ শুরু হয় এবং সূর্যোদয় ৫:৪৫ এ। তাহলে ইশরাকের নামাজ সকাল ৬:০০ থেকে শুরু করা যায়।
শেষ সময়: ইশরাকের নামাজ জোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে পড়তে হয়। সাধারণত সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত এই নামাজ পড়া যায়। তবে, সর্বোত্তম সময় হলো সূর্যোদয়ের ১৫-৩০ মিনিট পর, যখন সূর্যের আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ে। (আল-লুলু ওয়াল মারজান, পৃষ্ঠা: ১৮৬, দারুল ইফতা প্রকাশনী, ২০০৫)
আরও পড়ুনইশরাকের নামাজ: সকালের আলোয় আল্লাহর নৈকট্য ০৪ জুলাই ২০২৫সময় নির্ধারণের নীতিইশরাকের সময় স্থানভেদে ভিন্ন হয়, কারণ সূর্যোদয়ের সময় ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য স্থানীয় নামাজের সময়সূচি অনুসরণ করা উচিত। সূর্যোদয়ের ঠিক সময়ে নামাজ পড়া মাকরুহ, তাই সূর্য সম্পূর্ণভাবে ওঠার পর পড়া উচিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮১)
ইশরাকের নামাজের বিধানরাকাত সংখ্যা: ইশরাকের নামাজ সর্বনিম্ন ২ রাকাত পড়া হয়। তবে, ৪ বা ততোধিক রাকাতও পড়া যায়, কারণ এটি নফল নামাজ।
প্রকৃতি: এটি সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা, অর্থাৎ ঐচ্ছিক সুন্নত। তবে নবীজি (সা.) এটি পড়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।
নিয়ত: ইশরাকের নামাজের নিয়ত করা হয়, যেমন: “আমি ইশরাকের দুই রাকাত নফল নামাজ আল্লাহর জন্য আদায় করছি।” (ফাতাওয়া নূর আলা আদ-দারব, শাইখ ইবনে উসাইমিন, পৃষ্ঠা: ২০৮, দারুল ইফতা প্রকাশনী, ১৯৯৮)
ইশরাকের নামাজের ফজিলতইশরাকের নামাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে। আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাআতে পড়ে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে বসে থাকে এবং তারপর দুই রাকাত (ইশরাক) নামাজ পড়ে, তার জন্য একটি হজ্জ ও উমরাহর সওয়াব রয়েছে।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস:: ৫৮৬)
আরও পড়ুননামাজ আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির একটি ধাপ১৭ জুলাই ২০২৫ব্যবহারিক পরামর্শফজরের পর প্রস্তুতি: ফজরের নামাজের পর মসজিদে বা বাড়িতে জিকির করে সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করা। এটি হাদিসে উল্লিখিত ফজিলত অর্জনের সুযোগ দেয়।
সময়ের পরিকল্পনা: সকালের ব্যস্ততার মধ্যে ইশরাকের জন্য ৫-১০ মিনিট সময় রাখা। সকাল ৬:০০-৬:৩০ এর মধ্যে এটি পড়া সুবিধাজনক।
শিশুদের শিক্ষা: পরিবারে শিশুদের ইশরাকের নামাজ শেখানো, যাতে তারা এই সুন্নাহর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে।
মানসিক প্রস্তুতি: ইশরাকের নামাজ পড়ার আগে আয়াতুল কুরসি বা সুরা ইখলাস পড়ে মনকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করা।
সতর্কতামাকরুহ সময় এড়ানো: সূর্যোদয়ের ঠিক সময়ে নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকা, কারণ এটি নিষিদ্ধ সময়। সূর্য সম্পূর্ণ উঠে যাওয়ার পর পড়া উচিত।
নিয়তের স্পষ্টতা: ইশরাকের নিয়ত স্পষ্টভাবে করা, যাতে এটি নফল হিসেবে গণ্য হয়।
নিয়মিততা: ইশরাকের নামাজ নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করা উচিত, বিশেষ করে সপ্তাহে কয়েকবার, যাতে সুন্নাহর পুরস্কার পাওয়া যায়। কারণ, আমল ধারাবাহিকভাবে করাও একটি সুন্নাত।
ইশরাকের নামাজের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন এবং এটি দিনের শুরুতে আধ্যাত্মিক শক্তি যোগায়। হাদিসে উল্লেখ আছে, ইশরাকের নামাজ একটি হজ্জ ও উমরাহর সমান পুরস্কার বয়ে আনে। এছাড়া, এটি মানসিক শান্তি ও দিনের কাজে বরকত আনে। (আল-ফিকহুল মুয়াসসার, মুহাম্মদ ইবনে সালিহ, পৃষ্ঠা: ১৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১৫)
আরও পড়ুনজীবনকে ছন্দে ফেরাবে ‘ধীর নামাজ’২৪ মে ২০২৫