সীমান্ত পেরিয়ে আসছে মাদক আর পশু, যাচ্ছে জ্বালানি, খাদ্য
Published: 11th, May 2025 GMT
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৭১ কিলোমিটার অর্থাৎ ৮০ শতাংশ এলাকা দেশটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণে। অধিকৃত অঞ্চলে এখনো কয়েকটি আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই চলছে। কিন্তু এর মধ্যেও মাদক ও পশু চোরাচালান থেমে নেই। ইয়াবার উৎপাদনও বন্ধ হচ্ছে না; বরং দিনদিন বেড়ে চলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে চলমান অর্থসংকট থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে মাদক এবং পশু চালান অব্যাহত রেখেছে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে রাখাইন রাজ্যে নেওয়া হচ্ছে চাল, ডাল, তেল, দুধ-চিনি, তরকারি, ভোজ্যতেল, জ্বালানি, ইউরিয়া সারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী।
মাঝেমধ্যে ইয়াবার বড় চালান, ইউরিয়া সার, পশুসহ কারবারিরা ধরা পড়লেও অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে পশু ও ইয়াবা চোরাচালান বেশি ঘটছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির স্থলসীমান্ত দিয়ে। একই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানি মিয়ানমারে পাঠানো হচ্ছে।
গত শুক্রবার সরেজমিন অনুসন্ধান, স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বস্তাভর্তি ৩ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। যদিও এ সময় পাচারকারীদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন অর রশীদ জানান, মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে আনা ইয়াবা চালানটি গভীর রাতে দুজন কাঁধে নিয়ে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে খালাসের চেষ্টা করছিলেন। তখন কোস্টগার্ডের সদস্যরা দুই ব্যক্তিকে থামার সংকেত দিলে ইয়াবাভর্তি বস্তা ফেলে তাঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। জব্দ করা ইয়াবার মূল্য ১৬ কোটি টাকা।
কেবল মাদক নয়, পশু পাচারও অব্যাহত আছে। ৬ মে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আনা ১৫৫টি গরু ও মহিষ চট্টগ্রামে পাচারের সময় কক্সবাজারের ঈদগাঁও বাজার থেকে জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা।
ঈদগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান বলেন, চোরাই পথে আনা পশুর বিপরীতে বৈধ কাগজপত্র না থাকায় জব্দ করা হয়। নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি মো.
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত-লড়াই শুরু হয়। টানা ১১ মাসের যুদ্ধের পর সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের তিনটি শহরসহ (মংডু, বুচিডং ও রাচিডং) ৮০ শতাংশ এলাকার দখলে নেওয়ার কথা ঘোষণা দেয়। কিন্তু সংঘাত শুরুর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে মাদক ও পশু চোরাচালান বন্ধ হয়নি। তবে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চোরাচালান বেড়েছে দশ গুণ। বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী, জ্বালানি ও ইউরিয়া সার সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে সশস্ত্র গোষ্ঠী।
সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যেও মাদক-পশু চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না জানিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী ও জেলা জামায়াতের আমির নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনাও ঘটছে। তাতে বাংলাদেশ সীমান্তের উপজেলাসমূহের লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি চোরাচালান ঘটলেও ধরা পড়ে খুবই সামান্য।
চোরাচালান বন্ধ হয়নিসম্প্রতি রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মংডু টাউনশিপসহ পুরো রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নেই। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মংডুসহ তিনটি শহরে শক্তিশালী জেনারেটর চালিয়ে সরকারি দপ্তর-আদালত, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ব্যবসাকেন্দ্র, বিপণিবিতান পরিচালিত হয়ে আসছে। জেনারেটর চালানোর জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সংগ্রহ করা হয় টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে। সংঘাত শুরুর পর থেকে মংডুর সঙ্গে রাজধানী সিথুয়ের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহযোগিতায় টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে নৌ ও স্থলপথে জ্বালানি, সার ও খাদ্যপণ্য সরবরাহ দিচ্ছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। গৃহযুদ্ধের মধ্যেও মিয়ানমারের কারাখানাগুলো সচল রেখে বাড়ানো হয় ইয়াবার উৎপাদন। মিয়ানমারের কারখানায় উৎপাদিত শতভাগ ইয়াবা চালান ঢোকে বাংলাদেশে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৯ মে কক্সবাজার সৈকতের একটি তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠক। ওই বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সে দেশের মংডু ১ নম্বর বিজিপি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থিন কো কো। আর বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বিজিবি কক্সবাজার সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল খন্দকার ফরিদ হাসান। বৈঠকে বিজিবি কর্মকর্তা মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে তোলা ৩৭ ইয়াবা কারখানা উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছিলেন।
বৈঠক শেষে কর্নেল খন্দকার ফরিদ হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে স্থাপিত ইয়াবা কারখানাগুলো উচ্ছেদ এবং ইয়াবা উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হলেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাতে আগ্রহ দেখায়নি।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, নানা সংকটের কারণে আরাকান আর্মি মাদক ও পশু চোরাচালান বন্ধ করছে না। বর্তমানে সীমান্তের ২২-২৫টি চোরাই পয়েন্ট দিয়ে রাতের বেলায় মাদক ঢুকছে।
বিজিবি কক্সবাজার অঞ্চলের (রিজিয়ন) কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এম ইমরুল হাসান বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মাদক ও পশু চোরাচালান রোধের পাশাপাশি মিয়ানমার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ র চ ল ন বন ধ সশস ত র গ ষ ঠ র খ ইন র জ য আর ক ন আর ম কর মকর ত কম ন ড র সরক র উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধ সড়ক যেন মরণফাঁদ
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ৬৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়কটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অনেক গর্ত। এসব গর্তের পাশ দিয়ে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন পথচারী ও যানবাহন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের দাবি জানানো হলেও সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধের দুই পাশে জায়গায় জায়গায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও সড়কের পিচ উঠে গেছে, কোথাও আবার গর্তের গভীরতা এত বেশি যে, ছোট যানবাহন উল্টে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে দুর্ঘটনায় কলেজছাত্রের মৃত্যু, ট্রাকে আগুন
সিলেটে বাস-প্রাইভেটকার সংঘর্ষ, বাবা-মেয়ে নিহত
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও, এর ওপরে নির্মিত পাকা সড়কটি সওজ বিভাগের আওতাধীন। এ সড়কটি ব্যবহার করে মতলব উত্তর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ঢাকা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর যানবাহন চলাচল করে।
স্থানীয় অটোরিকশা চালক রোবেল হোসেন বলেন, “নির্মাণের দুই-তিন বছর যেতে না যেতেই সড়কের দুই পাশে অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রতিদিন গাড়ি চালাতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে। একটু অসাবধান হলেই ঘটবে দুর্ঘটনা।”
মোটরসাইকেল চালক আনোয়ার হোসেন বলেন, “দিনে কোনোভাবে পার হওয়া যায়, কিন্তু রাতের পরিস্থিতি থাকে ভয়ঙ্কর। কারণ, অনেক সময় দূর থেকে গর্ত দেখা যায় না। এই সড়কে খুব ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।”
পিকআপ ভ্যানের চালক আব্দুর রহমান বলেন, “কয়েক বছর না যেতেই রাস্তা গর্তে ভরে গেছে। রাতের বেলায় গর্তগুলো বোঝা যায় না, তাই সব সময় আতঙ্ক নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।”
কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বলেন, “বেড়িবাঁধ সড়কটি এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি। এখন গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত মেরামতের জন্য আমরা একাধিকবার জানিয়েছি।”
মতলব উত্তর প্রেস ক্লাবের সভাপতি বোরহান উদ্দিন ডালিম বলেন, “এই বেড়িবাঁধ শুধু মতলব নয়, পুরো অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান সড়ক। তাই সওজ বিভাগের উদাসীনতা জনজীবনে ঝুঁকি তৈরি করছে। বর্ষার আগেই এই সড়কটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার জরুরি।”
চাঁদপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “অতিবৃষ্টির কারণে গর্ত তৈরি হয়েছে। আমরা সড়কটি মেরামতের ব্যবস্থা নিয়েছি।”
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, মতলব ব্রিজ থেকে বেড়িবাঁধের পূর্ব অংশে সংস্কার কাজের জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। পশ্চিম অংশ এখনও ঠিকাদারের দায়িত্বে আছে, তাদেরকেও মেরামতের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (চঃ দাঃ) সেলিম শাহেদ বলেন, “বেড়িবাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও এর ওপরে থাকা পাকা সড়ক সওজ বিভাগের দায়িত্বে। বেড়িবাঁধের যদি কোথাও ক্ষতি হয়, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেই; সড়ক সংস্কার কাজ সওজ বিভাগকেই করতে হয়।”
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, “বেড়িবাঁধ সড়কের বিভিন্ন স্থানে গর্ত দেখা গেছে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।”
ঢাকা/অমরেশ/মাসুদ