চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছি বেঙ্গালুরুর ব্রহ্মসান্দ্র শহরেই। সোয়া এক শ কিলোমিটার দূরত্বে ইতিহাস–ঐতিহ্যের রাজ্য মহীশূর। শৈশবে বইয়ে, টিভি সিরিয়ালে পড়া ও দেখা মহীশূরের বাঘখ্যাত টিপু সুলতানের এত কাছে এসে তাঁকে না দেখে ফিরে যাব? অসম্ভব! মনস্থির করেই ফেললাম, পুরো মহীশূর ঘুরে দেখব, এক দিনে যতটুকু সম্ভব। স্থানীয় এক পরিচিতজনের সহায়তায় পরিচয় হলো মো.

তামিম নামের আসামনিবাসী এক যুবকের সঙ্গে। তিনি নিজস্ব গাড়িতে (ছোট কার) চুক্তিতে পর্যটকদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে নিয়ে যান, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। চালক ও ভ্রমণ গাইড বলা যায়।

তামিমকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, তখন সে বলল, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, তাঁর মাজার ও মহীশূরের রাজপ্রাসাদ। রোববার এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকাল ছয়টায় বাসার নিচে তামিম এসে হাজির। (১১ মে) সূর্যের সোনালি আভা সবে ব্রহ্মসান্দ্রর পূর্ব আকাশে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে, আমাদের যাত্রা শুরু হল। বেঙ্গালুরু-মহীশূর এক্সপ্রেস সড়ক বলে দিচ্ছে, এটিকে কেন আইটির শহর বলা হয়। শুধু সড়কের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গেলে এই লেখায় বিরাট আকার ধারণ করবে, তাই আপাতত লোভ সংবরণ করলাম।

আড়াই ঘণ্টায় প্রায় ১২০ কিলোমিটার গতির যাত্রায় ১০টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। ১০টা থেকে দুপুর নাগাদ আমরা ঘুরে ফেললাম টিপু সুলতানের ঐতিহাসিক গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ও গম্বুজে তাঁর সমাধি। সে গল্প পরবর্তী সংখ্যায় নাগরিক সংবাদ বিবেচনা করলে পাঠকেরা পেতে পারেন। কিন্তু যেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, সেটাই এই লেখার চমক। হঠাৎ তামিম বলে উঠল, এখানে একটা গাড়ির জাদুঘর আছে, যাবেন? কী বলো? গাড়ির জাদুঘরও হয় নাকি? আমি হ্যাঁ-না কিছু বলা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে গাড়ি ঘুরিয়ে গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বলল দেখুন, বলুন, ভেতরে যাবেন কি না?

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

চোখে পড়ল একটি বিশাল টায়ার-আকৃতির ভবন। দূর থেকেই মনে হচ্ছিল, যেন অতীত যুগ থেকে একটি ডাক এসেছে। তামিম বলল, ‘এটাই পায়ানা জাদুঘর।’ আমি বললাম, চলো দেখে আসি। সে গাড়ি পার্ক করল।

কন্নড় ভাষায় ‘পায়ানা’ মানে ‘ভ্রমণ’—আর এ নামের পেছনের অর্থ যেন ঠিক মিলে গেল আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তামিম বলল, আপনারা যান, আমি এখানেই আছি। টিকিট কাউন্টারে হাস্যোজ্জ্বল এক নারী আমাদের স্বাগত জানালেন। ৭৫ ভারতীয় মুদ্রায় ২টি টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম এক আশ্চর্য জগতে, যেন সময়ের কপাট খুলে গিয়েছে।

এ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হলেন ধর্মস্থলার ধর্মাধ্যক্ষ ও গাড়িপ্রেমী ডি ভীরেন্দ্র হেগগাড়ে। ২৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ পায়ানা ভিন্টেজ কার মিউজিয়াম অবস্থিত শ্রীরঙ্গপত্তনার নগুবিনাহল্লি এলাকায়। ভেতরে ঢুকেই যেন পড়ে গেলাম এক স্বপ্নলোকের মধ্যে—দুই তলাজুড়ে ৮০টির বেশি দুর্লভ ও রিস্টোর করা গাড়ি, প্রতিটিই একেকটি জীবন্ত ইতিহাস।

প্রথমেই চোখে পড়ল ঝকঝকে কালো রঙের ১৯৬২ সালের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড—এখনো যেন নিজের যুগের গ্ল্যামার ছড়াচ্ছে। এরপর একে একে দেখতে পেলাম ১৯৪৬ সালের ফোর্ড প্রিফেক্ট, ১৯৪৭ সালের ফরাসি সিট্রোয়েন ট্র্যাকশন অ্যাভ্যান্ট এবং প্রিয় ১৯৫৫ সালের শেভরোলেট বেলএয়ার। ভারতীয় ক্ল্যাসিক যেমন হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টার ও অ্যাম্বাসাডরও ছিল, যা ভারতের গাড়ির ইতিহাসের বিবর্তন তুলে ধরেছে।

তবে শুধু ক্ল্যাসিক গাড়িই নয়, এই জাদুঘরে রয়েছে ইতিহাসের গুরুত্ববহ যানবাহনও। যেমন পদ্মবিভূষণ বিজয়ী স্যার সি ভি রমনের ব্যবহৃত স্টুডিবেকার চ্যাম্পিয়ন, আবার ডজ কিংসওয়ে কনভার্টিবল—যা নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি গাড়ি ছিল। রোলস রয়েস বিভাগে ১৯০৪ থেকে ২০২২ সালের বিভিন্ন মডেল প্রদর্শিত হয়েছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত লাল রঙের ডাবল ডেকার বাসের একটি অনুকরণ, যেন শহরের প্রাণস্পন্দনের সাক্ষী।

এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর ইন্টারঅ্যাকটিভিটি। শুধু ছবি তোলার জায়গা নয়, এখানে রয়েছে শেখার সুযোগ। প্রতিটি গাড়ির সামনে আছে বিস্তারিত বিবরণ, কিছু জায়গায় রয়েছে ডিজিটাল কিয়স্ক—যা আপনাকে জানিয়ে দেবে প্রযুক্তি ও ডিজাইনের বিবর্তনের কাহিনি। ওয়ার্কশপ ঘুরে দেখা গেল মেকানিকরা পুরোনো গাড়িগুলোকে নতুন প্রাণ দিচ্ছেন নিখুঁত যত্নে।

প্রতিটি গাড়ি যেন একেকটি চরিত্র—যারা নিজেদের জীবনের গল্প বলছে, সময়ের ধুলামাখা স্মৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পায়ানায় ঘুরে বেড়ানো শুধু চোখের তৃপ্তি নয়, মন ও ইতিহাসের সঙ্গে একটি গভীর সংযোগ গড়ে তোলে।

আপনিও যদি কোনো দিন মহীশূরের পথে যান, তবে একটিবার থেমে যান পায়ানায়। সময়ের চাকা ঘোরে কীভাবে, তা নিজের চোখে দেখুন—একটি গাড়ি, একটি গল্প, এক ইতিহাস একই সঙ্গে।

লেখক: শিক্ষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ দ ঘর

এছাড়াও পড়ুন:

নড়াইলে একটি কেন্দ্রে ভুল সেটে পরীক্ষা গ্রহণ

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা শহরের লক্ষ্মীপাশা আদর্শ মহিলা কলেজ কেন্দ্রে এইচএসসি বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষায় ৪র্থ সেটের পরিবর্তে ২য় সেটের প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা শেষে বিষয়টি জানাজানি হলে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষক ও পরীক্ষার্থী কলেজ কেন্দ্রে এসে ভিড় জমায় এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র সচিব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন।

এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র সচিবসহ দুইজন কে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি ও কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাবোর্ড। পাশাপাশি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পরীক্ষা নেয়া প্রশ্নপত্রে খাতা মূল্যায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী রবিবার (২৯ জুন) সকাল ১০টা হতে বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় ৫৬০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষায় বোর্ডের নির্দেশনা ছিল ৪ নং সেটে পরীক্ষা গ্রহণের। কিন্তু ভুলবশতঃ লক্ষ্মীপাশা আদর্শ মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ২ নং সেটে পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীরা বাইরে এলে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা হলে তারা প্রশ্ন মেলায়। তখন সেটের ভিন্নতার কারণে বিভ্রান্তিতে পড়ে। একপর্যায়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যাচাই-বাছাই করে জানতে পারেন লক্ষ্মীপাশা আদর্শ মহিলা কলেজের প্রশ্নের সেট পবির্তন হয়েছে। এ ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কলেজে এসে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে বেকায়দায় পড়েন। এ সময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন অভিভাবকরা।

আরো পড়ুন:

চাকসু নির্বাচনসহ ৭ দাবিতে চবিতে ছাত্রশিবিরের সংবাদ সম্মেলন

আন্দোলন নিয়ে ‘হতবাক’ শহীদ আবু সাঈদের পরিবার

লোহাগড়া সরকারি আদর্শ কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, ‘‘ভুল সেটে পরীক্ষা নেয়ার ঘটনা পরীক্ষা শেষ হলে কিছুক্ষণ পর জানতে পারি। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমাদের উত্তরপত্রের বিষয়ে কী হবে, তা নিয়েও আমরা চিন্তিত।’’

এ বিষয়ে কেন্দ্র সচিব ও লক্ষ্মীপাশা আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজল কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রিয়াদ জানান, লক্ষ্মীপাশা আদর্শ মহিলা কলেজের কেন্দ্র সচিবের দায়িত্বে ছিলেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজল কুমার বিশ্বাস এবং ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কৃষি অফিসার রফিকুল ইসলাম। তাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়ে যশোর শিক্ষাবোর্ড কে জানানো হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাবোর্ড যশোরের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ প্রফেসর আব্দুল মতিন বলেন, ‘‘পরীক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করে যে সেটে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, ওই সেটের প্রশ্ন দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার জন্য  সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজল কুমার বিশ্বাস ও ট্যাগ অফিসার লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কৃষি অফিসার রফিকুল ইসলাম কে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আগামীতে যাতে ভালোভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই ব্যাপারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।’’
 

ঢাকা/শরিফুল/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ