অগ্নিদুর্ঘটনা হইতে চট্টগ্রাম নগরীর সুরক্ষায় পৌনে দুইশত ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ তথা সড়কের ধারে কৃত্রিম জলস্তম্ভ স্থাপন করা হইলেও একটিতেও পানি মিলে নাই। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হাইড্রেন্ট খুলিয়া কুষ্ঠ রোগীর শরীর ধুইবার সৌভাগ্য হইয়াছিল বটে, কিন্তু চট্টগ্রাম নগরবাসীর এক দিনের জন্যও সেই সৌভাগ্য হয় নাই।
অথচ ছয় বৎসর যাবৎ এই সকল যন্ত্র স্থাপিত হইয়াছিল নগরীর অগ্নিনিরাপত্তায়, যথায় চট্টগ্রাম ওয়াসার গচ্চা গিয়াছে চার কোটি টাকা। বুধবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সহজে অগ্নিনির্বাপণে এই সকল ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ স্থাপন করা হইলেও ব্যবহারের পূর্বেই অচল হইয়া পড়িয়াছে। এমনকি ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনির্বাপণে গিয়া ঐ সকল যন্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হইয়াছে। ইহাতে স্পষ্ট, কারিগরি ত্রুটি-সংবলিত প্রকল্পটির গোড়াতেই গলদ রহিয়াছে।
প্রশ্ন হইল, চট্টগ্রামে এই সকল যন্ত্র স্থাপনকালে কেন উহার যথার্থতা নিরূপণ করা হয় নাই? বিভিন্ন দেশের নমুনা লইয়া এই প্রকল্প গ্রহণ করা হইলেও দেখা যাইতেছে, ঐ সকল যন্ত্রের পানির লাইন ওয়াসার বসতবাড়িতে সরবরাহে ব্যবহৃত মূল পানির লাইনের সহিত যুক্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অথচ বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, এই প্রকার ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নাই। হাইড্রেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে পৃথক নকশার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল বলিয়াও বিশেষজ্ঞরা মত দিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত পানির চাপের পরিমাণ লইয়াও সমস্যা রহিয়াছে। এই প্রকার ত্রুটি লইয়া বাস্তবায়িত প্রকল্পের পরিণতি যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে। খনার বচন রহিয়াছে– ‘থেকে বলদ না বয় হাল, তার দুঃখ সর্বকাল’। চট্টগ্রাম নগরীর হাইড্রেন্টের গোড়ায় জলজ গলদ সেই বচনেরই সার্থক বাস্তবায়ন করিয়াছে!
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বৎসর ২০ সহস্রাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যথায় হতাহত মানুষের সংখ্যাও স্বল্প নহে। চট্টগ্রামে প্রতি বৎসর অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ভস্মীভূত হয়। চট্টগ্রাম জেলায় গত পাঁচ বৎসরে ছোট-বড় মিলাইয়া সাত সহস্রাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়াছে। আমরা জানি, পানির উৎসের অভাবেই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি অধিক হয়। চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত পুকুর কিংবা জলাধার না থাকিবার কারণে অগ্নিনির্বাপণে গিয়া হিমশিম খাইতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। তন্নিমিত্তেই ফায়ার সার্ভিসের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করিয়াছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। এই সকল যন্ত্র স্থাপন করা হইলেও কারিগরি ও পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে উহা ‘অকেজো’ প্রকল্পে পরিণত হইয়াছে। অথচ ফায়ার হাইড্রেন্ট প্রকল্পটির যথার্থ বাস্তবায়ন হইলে পানি সংকট সহজে দূর হইত, যাহাতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণও হ্রাস করা সম্ভব হইত।
সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল শর্টসার্কিট হইতে নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে একটি ভবনের তৃতীয় তলায় খেলনার গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটিলে পানি সংকটের কারণে উহা নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের হিমশিম খাইতে হয়। ঐ সময় হাইড্রেন্টে চেষ্টা করিয়াও লাভ হয় নাই। আমরা মনে করি, বিশেষজ্ঞ পর্ষদ গঠন করিয়া শুরুতেই এই প্রকল্পের ত্রুটি উন্মোচন করিতে হইবে এবং তৎপরামর্শ অনুযায়ী ঐ সকল যন্ত্র ব্যবহারোপযোগী করিবার চেষ্টা প্রয়োজন।
যাহাদের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের নামে সরকারের অর্থ গচ্চা গিয়াছে, তাহাদেরও জবাবদিহি জরুরি। ইহার সহিত অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থাও শক্তিশালী করা জরুরি। অগ্নিকাণ্ডের স্থানীয় কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগী হওয়া এবং জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবনগুলিতে জরুরি নির্গমন পথ থাকা জরুরি। শুধু নিয়ম মানিয়া ভবন নির্মাণ ও আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকিলেই হয় না, সেইগুলির যথাযথ ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিকাণ্ড ঘটিলে উহা নির্বাপণের সম্ভাব্য ব্যবস্থাপনাও দরকার। এই ক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট প্রকল্পের ব্যর্থতা সম্মুখে রাখিয়াই ব্যবস্থা লইতে হইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র ব যবস থ ব যবহ র অন য য় হইয় ছ নগর র হইল ও
এছাড়াও পড়ুন:
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অশনিসংকেত
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য উদ্ধৃত করিয়া সোমবার সমকাল জানাইয়াছে, ২০১৯-২০ অর্থবৎসরে উপজেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২৬ সহস্রাধিক হেক্টর, যাহা ২০২৫ সালে দাঁড়াইয়াছে ২৩ সহস্র হেক্টর অপেক্ষা কিছু বেশি। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বৎসরে নাসিরনগর উপজেলায় আবাদযোগ্য জমি হ্রাস পাইয়াছে প্রায় তিন সহস্র হেক্টর। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারণ ইহার সরাসরি ফল হইবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং প্রধান খাদ্যশস্য চাউলসহ প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের জন্য বিদেশমুখাপেক্ষিতা বৃদ্ধি। এক কথায় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ইহা এক প্রকার অশনিসংকেত বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। প্রসঙ্গত, কৃষিজমি হ্রাসের সমস্যা নাসিরনগরেই সীমাবদ্ধ নহে। সমগ্র দেশেই বিবিধ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাইতেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের কৃষি শুমারি-২০১৯ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, প্রতিবৎসর দেশে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাইতেছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হারে। উক্ত শুমারিমতে, ২০০৮ সালে দেশে নিট আবাদি জমি ছিল ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৯৭ সহস্র হেক্টর। ২০১৯ সালে উহা হ্রাস পাইয়া দাঁড়ায় ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ৮১ সহস্র হেক্টরে। তৎসহিত ন্যায্যমূল্য হইতে ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত হইবার কারণে কৃষকদের মধ্যে বিশেষত ধান উৎপাদনে উৎসাহের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাইতেছে। বহু তরুণ উদ্যোক্তা কৃষিতে যুক্ত হইয়াছেন সত্য। তবে উহাদের প্রায় সকলেই মৎস্য বা অন্য কোনো অর্থকরী ফসলের চাষ করিতেছেন। কেহ কেহ রপ্তানির কথা বিবেচনায় লইয়া আলু, ভুট্টা, গম ও টমেটোর ন্যায় ফসল চাষে যুক্ত। রবিশস্যের জমিতে তিল বা সরিষা চাষ হইতেছে। এই অবস্থায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন যে ক্রমশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িতেছে, তাহা সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা যায়। ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাইতেছে, উচ্চফলনশীল বীজ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে ধানসহ বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন গত কয়েক দশকে বৃদ্ধি পাইলেও প্রতি বৎসর খাদ্যপণ্য আমদানিও বৃদ্ধি পাইতেছে। ফলস্বরূপ বিশ্ববাজারে চাউল বা অন্য কৃষিপণ্যের বাজার অস্থির হইলে তাহা আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কৃষিজমি বিদ্যমান হারে হ্রাস পাইতে থাকিলে ভবিষ্যতে একরপ্রতি ফসল উৎপাদন দুই গুণ বা তিন গুণ বৃদ্ধি পাইলেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হইবে না।
প্রতিবেদনমতে, নাসিরনগরে ফসলি জমি হ্রাসের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে আছে জলবাযু পরিবর্তন, নদীভাঙন, যত্রতত্র ইটভাটা, সরকারি বিভিন্ন আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প, আবাসন সংকট ও বাণিজ্যিক পুকুর খনন। এই কারণসমূহ সমগ্র দেশেই বিদ্যমান। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এই সমস্যাকে জটিল করিয়া তুলিতেছে। দুঃখজনক হইল, সমস্যাটি নীতিনির্ধারকদের খুব একটা ভাবাইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। কৃষিজমি রক্ষায় আইন ও সরকারি বিধিবিধান রহিয়াছে। কিন্তু কোনোটারই কার্যকর কোনো প্রয়োগ নাই। তিন ফসলি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধে গত কয়েক বৎসরে আমরা সরকারের শীর্ষমহলে যতটা বাগাড়ম্বর দেখিয়াছি, তদনুযায়ী কোনো কাজ হইতে দেখা যায় নাই। বর্তমানেও যদি একই ঔদাসীন্য বজায় থাকে, তাহা হইলে আমাদের হতাশার কোনো শেষ থাকিবে না।
আমরা জানি, বিশেষত করোনাকালে যখন শিল্পোৎপাদন ও সেবা খাত প্রায় স্থবির হইয়া পড়িয়াছিল, তখনও কৃষি এই দেশকে রক্ষা করিয়াছে। অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে হ্রাস পাইলেও এখনও তাহা উল্লেখযোগ্য। কর্মসংস্থানের দিক দিয়াও কৃষির সম্ভাবনা উপেক্ষণীয় নহে। কৃষিজমি রক্ষার বিষয়টি তাই এই সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি। সম্পূর্ণ কৃষি খাত লইয়া একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। তাহারই অংশ হিসাবে আবাদি জমি সংরক্ষণের বিষয়টি স্পষ্ট হইতে পারে। সরকার অবিলম্বে এই লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হইবে, ইহাই আমাদের প্রত্যাশা।