হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য ফরজ। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং সমতা, ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষার একটি মাধ্যম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হজযাত্রা বহু বছর ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে হজযাত্রার সংখ্যা কমছে। এই নিবন্ধে হজের শিক্ষা এবং বাংলাদেশে হজযাত্রার বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো।

হজের শিক্ষা

হজ মানুষকে গভীর জীবনবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। এর প্রতিটি আচার মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বহন করে:

সমতা ও ভ্রাতৃত্ব: হজ মানুষের মধ্যে বর্ণ, শ্রেণি, পেশা বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ভেদাভেদ দূর করে। রাজা থেকে দরিদ্র—সবাই একই সাদা ইহরাম পরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাওয়াফ করেন। এটি মানবতার সমতা ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়।

শৃঙ্খলা: কাবা শরিফের চারপাশে সুশৃঙ্খলভাবে তাওয়াফ করা জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব বোঝায়।

মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই: জামরাতে শয়তানের প্রতীকে পাথর নিক্ষেপ অশুভ শক্তি ও মন্দ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।

আনুগত্য: হাজরে আসওয়াদ চুম্বন আল্লাহর প্রতি অবিচল ভক্তি ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।

ধৈর্য ও অধ্যবসায়: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড় (সাঈ) হজরত হাজেরা (আ.

)-এর ধৈর্য ও কষ্ট সহ্য করার ঘটনার স্মরণে পালিত হয়। এটি জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধৈর্যের শিক্ষা দেয়।

আল্লাহর সন্তুষ্টি: হজের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এটি লোকদেখানো বা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নয়। যাঁরা ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ উপাধি ব্যবহার করে প্রতিপত্তি অর্জনের চেষ্টা করেন, তাঁরা হজের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হন। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তাদের গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)

হজ শুধু বাহ্যিক আচার নয়, এটি হৃদয়ের বিশুদ্ধতা ও আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতার প্রকাশ।

বাংলাদেশে হজযাত্রার বর্তমান প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য হজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত দুই দশকে হজযাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিবন্ধন কমেছে। নিচে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান ও এর বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।

আরও পড়ুনমক্কার জমজম কূপের উৎপত্তি০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

হজযাত্রীর পরিসংখ্যান (২০০৯-২০২৪)

বছর    হজযাত্রীর সংখ্যা জন

২০০৯ ৫৮,৬২৮

২০১০  ৯১,৩৮৪

২০১১  ১,০৭,৩৭২

২০১২  ১,১২,৬৮০

২০১৩ ৮৯,১৯০

২০১৪  ৯৮,৬৮৩

২০১৫  ১,০৬,২৩৮

২০১৬  ১,০১,৭৫৮

২০১৭  ১,২৭,১৯৮

২০১৮  ১,২৬,৭৯৮

২০১৯  ১,২৬,১২৩

২০২২  ৬০,০০০

২০২৩ ১,২৬,১২৩

২০২৪  ৮৩,১৪৯

উপর্যুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, ২০১৭-২০১৯ এই সময়ে হজযাত্রীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল, যা বাংলাদেশের কোটা (১,২৭,১৯৮) পূরণের ইঙ্গিত দেয়। ২০২০-২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে হজ সীমিত ছিল এবং বাংলাদেশ থেকে কেউ অংশ নিতে পারেননি। ২০২২ সালে করোনার পর কোটা কমে ৬০,০০০-এ নেমে আসে। ২০২৪ সালে হজযাত্রীর সংখ্যা ৮৩,১৪৯, যা কোটার তুলনায় প্রায় ৩৫% কম। এটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির ফলাফল।

পেশাভিত্তিক ও লিঙ্গভিত্তিক হজযাত্রী (২০১৯)

পেশাভিত্তিক হজযাত্রীর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ব্যবসায়ী ৪০ শতাংশ, গৃহিণী ৩৪ শতাংশ, চাকরিজীবী ৯ শতাংশ, কৃষিজীবী ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য হজযাত্রীর হার ১১ শতাংশ। একইভাবে লিঙ্গভিত্তিক হজযাত্রীদের তথ্যে পাওয়া যায়, পুরুষ যাত্রী যেখাকে ৬৩, নারী সেখানে ৩৭ শতাংশ।

অর্থাৎ, হজযাত্রীদের বৃহত্তম অংশ ব্যবসায়ী ও গৃহিণী। গৃহিণীদের উচ্চ অংশগ্রহণ নারীদের ধর্মীয় উৎসাহ ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। নারীদের ৩৭ শতাংশ অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য, যা সমাজে নারীদের ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধির প্রমাণ।

আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

হজের খরচ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

হজের খরচ মূলত ডলার নির্ভর এবং বেশির ভাগ খরচ সৌদি আরবে হয়। খরচের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ছিল ৫,০০০ ডলার (প্রায় ৫ লাখ টাকা, ডলারের দাম ১০০ টাকা), আর ২০২৪ সালে ৬,০০০ ডলার (প্রায় ৭.৫ লাখ টাকা, ডলারের দাম ১২৫ টাকা)।

খরচ বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথমত ডলারের মূল্যবৃদ্ধি: ডলারের দাম ২৫% বেড়েছে, যা হজের খরচকে মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত সৌদি আরবে খরচ বৃদ্ধি: হারাম শরিফের কাছের হোটেল ভাঙার কারণে বাড়িভাড়া, মোয়াল্লেম ফি এবং সার্ভিস চার্জ বেড়েছে এবং তৃতীয়ত বিমানভাড়া: হজের জন্য বিমানভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি (২০২৩-এ ১.৯৮ লাখ টাকা)।

হজ নিবন্ধন কমার কারণ

ধীরে ধীরে হজযাত্রী নিবন্ধনের সংখ্যা কমার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত অর্থনৈতিক চাপ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ডলারের উচ্চ মূল্য হজকে অনেকের জন্য অপ্রাপ্য করে তুলেছে।

দ্বিতীয়ত সৌদি আরবে ব্যয় বৃদ্ধি: বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচের বৃদ্ধি হজযাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং ওমরাহর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি: ওমরাহর খরচ (১-১.৫ লাখ টাকা) হজের তুলনায় অনেক কম। ফলে ২০২৩-এ ওমরাহ পালনকারীর সংখ্যা সোয়া লাখ থেকে আড়াই লাখে উন্নীত হয়েছে।

হজের শিক্ষা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটের সমন্বয়

হজের শিক্ষা সমতা ও তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ দেখায়। তবে বাংলাদেশে হজের ক্রমবর্ধমান খরচ এই ইবাদতকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কঠিন করে তুলেছে। হজের সমতার শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এটি অবশ্যই সাশ্রয়ী ও সবার জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত:

•        বিমানভাড়া নিয়ন্ত্রণ: হজের জন্য বিমানভাড়া কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।

•        সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা: বাড়িভাড়া ও সার্ভিস চার্জ কমানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা।

হজ একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা মানুষকে সমতা, ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশে হজযাত্রা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই ইবাদতকে অনেকের জন্য কঠিন করে তুলেছে। হজের শিক্ষা বাস্তবায়ন ও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সরকার, হজ এজেন্সি এবং সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার এই পবিত্র সুযোগ যেন সবার জন্য সহজলভ্য হয়, সেই প্রত্যাশা।

সূত্র: ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ

আরও পড়ুনহজযাত্রীদের টিকা গ্রহণে লাগবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট০৮ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হজয ত র র স খ য হজয ত র দ র হজ র শ ক ষ ক জ বন র র জন য ন বন ধ র একট র খরচ ওমর হ

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য: সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও কিছু কথা

গত বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক’ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হয়েছে। উপর্যুক্ত বিষয়ের ওপর এটিই প্রথম দেশজভাবে সম্পন্ন করা প্রতিবেদন। মোটাদাগে প্রতিবেদনটির তিনটি উপসংহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, বাংলাদেশের প্রতি চারজন মানুষের একজন এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্য স্থিত। দুই, এ দেশে আয়-দারিদ্র্যের চেয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার বেশি। তিন, আমাদের দেশে বহুমাত্রিক বঞ্চনার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক ব্যবধান রয়েছে।

প্রথাগতভাবে দারিদ্র্যের আলোচনায় আয়-দারিদ্র্য বিষয়টিই প্রাধান্য পায় বিশ্লেষণাত্মক দিক থেকে এবং পরিমাপেও। কিন্তু এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে দারিদ্র্য বিষয়টি একরৈখিক কিংবা একমাত্রিক নয়। আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোতেও বঞ্চনা থাকতে পারে; যেমন শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পুষ্টিতে, সুপেয় পানির ক্ষেত্রে কিংবা কর্মনিয়োজনে। আয়ের ঘাটতি সব সময় এসব বঞ্চনাকে প্রতিফলিত করে না। যেমন একজন ব্যক্তি অত্যন্ত ধনশালী হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি অশিক্ষিত হন, তাহলে আয়-দারিদ্র্যে তিনি দরিদ্র নন, কিন্তু শিক্ষা মাত্রিকতায় তিনি বঞ্চনার শিকার। কিন্তু কোন মাত্রিকতায় বঞ্চনা সবচেয়ে তীব্র বা চরম, তা বস্তুনিষ্ঠ অনপেক্ষভাবে নির্ধারণ করা যায় না, বিষয়টি আপেক্ষিক এবং সেই সঙ্গে মানসজাত। একেক মানুষের কাছে একেক ধরনের বঞ্চনা অগ্রাধিকার পায়।

সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে মানব উন্নয়ন শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলের ওপর নির্ভর করে না, সেই সঙ্গে তার কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্য ইত্যাদির ওপরও নির্ভর করে। বস্তুগত কুশল অর্জন করার পরও একজন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না-ও থাকতে পারে। অথবা একজন ব্যক্তিগত কুশল অর্জনকারী মানুষকে যদি শুধু তার গাত্রবর্ণের কারণে বিভিন্ন সামাজিক স্থানে প্রবেশাধিকার দেওয়া না হয়, কিংবা সামাজিক নানান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করতে দেওয়া হয়, তাহলে সেসব ঘাটতিও মানুষকে বঞ্চিত করে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে মানব-দারিদ্র্য একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক।

বহুমাত্রিক এই দারিদ্র্যের পরিমাপের জন্য ২০১০ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ প্রচেষ্টায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য একটি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানুষের জীবনযাত্রা মানের ১১টি মাত্রিকতা নিয়ে (যেমন, পুষ্টি, বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) এই সমন্বিত সূচকটি গড়ে উঠেছে। এ সূচকটি সম্পর্কে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য।

প্রথমত, এ সূচকটি দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য একরৈখিক কোনো পরিমাপ নয়। এটি বঞ্চনার অন্য দিকগুলোও ধর্তব্যের মধ্যে আনে এবং তাই এটি বহুমাত্রিক। দ্বিতীয়ত, যেহেতু বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে আয় অন্তর্ভুক্ত নয়, সুতরাং এটি মূলত আয়বহির্ভূত দারিদ্র্যের ওপরই নজর দেয়। তাই আয়-দারিদ্র্যের আপাতন বুঝতে হলে আলাদা করে আয়-দারিদ্র্যের পরিমাপের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। তৃতীয়ত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকও শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলকেই আমলে আনে, কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্যের ব্যাপারটি সে সূচকের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এটি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের একটি তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। চতুর্থত, দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক সর্বাঙ্গীণ সঠিক একটি পরিমাপ, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। এই পরিমাপের ত্রুটিগুলো বিভিন্ন গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চমত, এই সূচকের পরিমার্জনা ও পরিশীলনের জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়ন কেন্দ্র প্রায় প্রতিবছরই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ১০০টির বেশি দেশের জন্য এ সূচকটি তৈরি করা হয়। এই সূচকের পরিমাপের ফলাফল বাৎসরিক বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়। এ বছরের বৈশ্বিক প্রতিবেদনটি কয়েক মাস আগে প্রকাশিত হয়েছে। এর বিষয়বস্তু ছিল সংঘাত ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য। উপর্যুক্ত প্রতিবেদন ফলাফলে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ৬৩০ কোটির মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ (১৭ শতাংশ) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এই ১১০ কোটি বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষের ৯৬ কোটি মানুষই (৮৪ শতাংশই) আবার গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে বহুমাত্রিক দরিদ্রদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু-কিশোর অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৫৪ কোটি শিশু-কিশোর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সুতরাং বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ গ্রামীণ ও তারুণ্য মাত্রিকতা আছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন পরিকল্পনা কমিশনের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের ফলাফলের দিক তাকাই, তখন দেখি যে ২০১৯ সালে এ দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ছিল ২৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারজন লোকের মধ্যে একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। অনপেক্ষ সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের চার কোটি লোক ২০১৯ সালে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেছিল। সামগ্রিক এ সংখ্যার পটভূমিতে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ:

এক, দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের অনপেক্ষ আপাতন কমেছে; ২০১৩ সালে সাড়ে ৬ কোটি লোক থেকে ২০১৯ সালের ৪ কোটি লোক। দুই, বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার (২৪ শতাংশ) আয়-দারিদ্র্যের হারের (১৯ শতাংশ) চেয়ে বেশি। সুতরাং আয়ের ঘাটতি দিয়ে এ দেশের মানুষের সব বঞ্চনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তিন, গ্রামবাংলায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন (২৭ শতাংশ) শহুরে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের (১৩ শতাংশ) দ্বিগুণের বেশি। চার, অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশ, যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার ২১ শতাংশ। পাঁচ, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে (৩৮ শতাংশ)। ছয়, বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার (২৪ শতাংশ) বৈশ্বিক হার (১৭ শতাংশ) ও দক্ষিণ এশিয়ার হারের (২১ শতাংশের) চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে যেসব বঞ্চনা এই দারিদ্র্যকে ঘনীভূত করেছে, তার শীর্ষে রয়েছে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি। তারপর শিক্ষার সময়কাল, আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন, পুষ্টি ইত্যাদি। দেশের ২১ শতাংশ মানুষের আবাসন নিতান্ত নিচু মানের। দেশের প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন আবাসন, আন্তর্যোগ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দিক থেকে বঞ্চনার শিকার।

এখন সংগত প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য কমানোর জন্য করণীয় কী? প্রথমত, শুধু আয়-দারিদ্র্য হ্রাস করা থেকে নীতিমালার লক্ষ্য আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোর ওপর নিবদ্ধ করতে হবে। সুতরাং কৌশলের দিক থেকে শুদ্ধ প্রবৃদ্ধিচালিত নীতিমালার পরিবর্তে সামাজিক সেবাবৃদ্ধির কৌশলের ওপর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, আবাসন, পুষ্টি, শিক্ষা ইত্যাদি যে মাত্রিকতাগুলো বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে ঘনীভূত করে, নীতি-কৌশল ও সম্পদ সেখানে কেন্দ্রীভূত করা দরকার। বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাস করতে হলে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের ওপর জোর দিতে হবে। তৃতীয়ত, জনগোষ্ঠীর দিক থেকে ও অঞ্চলের দিক থেকে যেসব গোষ্ঠী বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার (যেমন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের জনগোষ্ঠী) এবং যেসব অঞ্চলে এই দারিদ্র্য ব্যাপক ও গভীর (যেমন সিলেট বিভাগ) এর ওপর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। পিছিয়ে পড়া জেলাকে (যেমন বান্দরবান) নীতিমালা ও সম্পদ বণ্টনে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চতুর্থত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের নানান মাত্রিকতার ওপর উপাত্ত সংগ্রহকে জোরদার করা প্রয়োজন। আরও বেশি ও বিশ্বাসযোগ্য উপাত্ত যদি লভ্য হয়, তাহলে তা নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে সহায়ক হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও প্রকৃতি বোঝার জন্য এবং লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থার কার্যকারিতার জন্য সঠিক উপাত্তের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পঞ্চমত, একটি যথাযথ মূল্যায়ন কাঠামো গড়া প্রয়োজন, যাতে বিভিন্ন সময়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনে গৃহীত নীতিমালা এবং বরাদ্দকৃত সম্পদের বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা যায়। বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনের জন্য একটি সমন্বিত প্রয়াসের বিকল্প নেই।

সেলিম জাহান

ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং

দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কাশ্মীর নিয়ে লেখা বইয়ে ভারতের কেন এত ভয় 
  • স্বাধীনতা দিবসে শতক হাঁকানো একমাত্র ভারতীয় কোহলি
  • বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য: সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও কিছু কথা