হজের শিক্ষা ও বাংলাদেশে হজযাত্রার বর্তমান প্রেক্ষাপট
Published: 15th, May 2025 GMT
হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য ফরজ। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং সমতা, ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষার একটি মাধ্যম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হজযাত্রা বহু বছর ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে হজযাত্রার সংখ্যা কমছে। এই নিবন্ধে হজের শিক্ষা এবং বাংলাদেশে হজযাত্রার বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো।
হজের শিক্ষা
হজ মানুষকে গভীর জীবনবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। এর প্রতিটি আচার মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বহন করে:
সমতা ও ভ্রাতৃত্ব: হজ মানুষের মধ্যে বর্ণ, শ্রেণি, পেশা বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ভেদাভেদ দূর করে। রাজা থেকে দরিদ্র—সবাই একই সাদা ইহরাম পরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাওয়াফ করেন। এটি মানবতার সমতা ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়।
শৃঙ্খলা: কাবা শরিফের চারপাশে সুশৃঙ্খলভাবে তাওয়াফ করা জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব বোঝায়।
মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই: জামরাতে শয়তানের প্রতীকে পাথর নিক্ষেপ অশুভ শক্তি ও মন্দ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।
আনুগত্য: হাজরে আসওয়াদ চুম্বন আল্লাহর প্রতি অবিচল ভক্তি ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
ধৈর্য ও অধ্যবসায়: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড় (সাঈ) হজরত হাজেরা (আ.
আল্লাহর সন্তুষ্টি: হজের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এটি লোকদেখানো বা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নয়। যাঁরা ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ উপাধি ব্যবহার করে প্রতিপত্তি অর্জনের চেষ্টা করেন, তাঁরা হজের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হন। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তাদের গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
হজ শুধু বাহ্যিক আচার নয়, এটি হৃদয়ের বিশুদ্ধতা ও আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতার প্রকাশ।
বাংলাদেশে হজযাত্রার বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য হজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত দুই দশকে হজযাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিবন্ধন কমেছে। নিচে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান ও এর বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।
আরও পড়ুনমক্কার জমজম কূপের উৎপত্তি০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫হজযাত্রীর পরিসংখ্যান (২০০৯-২০২৪)
বছর হজযাত্রীর সংখ্যা জন
২০০৯ ৫৮,৬২৮
২০১০ ৯১,৩৮৪
২০১১ ১,০৭,৩৭২
২০১২ ১,১২,৬৮০
২০১৩ ৮৯,১৯০
২০১৪ ৯৮,৬৮৩
২০১৫ ১,০৬,২৩৮
২০১৬ ১,০১,৭৫৮
২০১৭ ১,২৭,১৯৮
২০১৮ ১,২৬,৭৯৮
২০১৯ ১,২৬,১২৩
২০২২ ৬০,০০০
২০২৩ ১,২৬,১২৩
২০২৪ ৮৩,১৪৯
উপর্যুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, ২০১৭-২০১৯ এই সময়ে হজযাত্রীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল, যা বাংলাদেশের কোটা (১,২৭,১৯৮) পূরণের ইঙ্গিত দেয়। ২০২০-২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে হজ সীমিত ছিল এবং বাংলাদেশ থেকে কেউ অংশ নিতে পারেননি। ২০২২ সালে করোনার পর কোটা কমে ৬০,০০০-এ নেমে আসে। ২০২৪ সালে হজযাত্রীর সংখ্যা ৮৩,১৪৯, যা কোটার তুলনায় প্রায় ৩৫% কম। এটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ব্যয় বৃদ্ধির ফলাফল।
পেশাভিত্তিক ও লিঙ্গভিত্তিক হজযাত্রী (২০১৯)
পেশাভিত্তিক হজযাত্রীর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ব্যবসায়ী ৪০ শতাংশ, গৃহিণী ৩৪ শতাংশ, চাকরিজীবী ৯ শতাংশ, কৃষিজীবী ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য হজযাত্রীর হার ১১ শতাংশ। একইভাবে লিঙ্গভিত্তিক হজযাত্রীদের তথ্যে পাওয়া যায়, পুরুষ যাত্রী যেখাকে ৬৩, নারী সেখানে ৩৭ শতাংশ।
অর্থাৎ, হজযাত্রীদের বৃহত্তম অংশ ব্যবসায়ী ও গৃহিণী। গৃহিণীদের উচ্চ অংশগ্রহণ নারীদের ধর্মীয় উৎসাহ ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। নারীদের ৩৭ শতাংশ অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য, যা সমাজে নারীদের ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধির প্রমাণ।
আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫হজের খরচ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
হজের খরচ মূলত ডলার নির্ভর এবং বেশির ভাগ খরচ সৌদি আরবে হয়। খরচের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ছিল ৫,০০০ ডলার (প্রায় ৫ লাখ টাকা, ডলারের দাম ১০০ টাকা), আর ২০২৪ সালে ৬,০০০ ডলার (প্রায় ৭.৫ লাখ টাকা, ডলারের দাম ১২৫ টাকা)।
খরচ বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথমত ডলারের মূল্যবৃদ্ধি: ডলারের দাম ২৫% বেড়েছে, যা হজের খরচকে মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত সৌদি আরবে খরচ বৃদ্ধি: হারাম শরিফের কাছের হোটেল ভাঙার কারণে বাড়িভাড়া, মোয়াল্লেম ফি এবং সার্ভিস চার্জ বেড়েছে এবং তৃতীয়ত বিমানভাড়া: হজের জন্য বিমানভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি (২০২৩-এ ১.৯৮ লাখ টাকা)।
হজ নিবন্ধন কমার কারণ
ধীরে ধীরে হজযাত্রী নিবন্ধনের সংখ্যা কমার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত অর্থনৈতিক চাপ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ডলারের উচ্চ মূল্য হজকে অনেকের জন্য অপ্রাপ্য করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত সৌদি আরবে ব্যয় বৃদ্ধি: বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচের বৃদ্ধি হজযাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং ওমরাহর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি: ওমরাহর খরচ (১-১.৫ লাখ টাকা) হজের তুলনায় অনেক কম। ফলে ২০২৩-এ ওমরাহ পালনকারীর সংখ্যা সোয়া লাখ থেকে আড়াই লাখে উন্নীত হয়েছে।
হজের শিক্ষা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটের সমন্বয়
হজের শিক্ষা সমতা ও তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ দেখায়। তবে বাংলাদেশে হজের ক্রমবর্ধমান খরচ এই ইবাদতকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কঠিন করে তুলেছে। হজের সমতার শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এটি অবশ্যই সাশ্রয়ী ও সবার জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত:
• বিমানভাড়া নিয়ন্ত্রণ: হজের জন্য বিমানভাড়া কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।
• সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা: বাড়িভাড়া ও সার্ভিস চার্জ কমানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা।
হজ একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা মানুষকে সমতা, ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশে হজযাত্রা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই ইবাদতকে অনেকের জন্য কঠিন করে তুলেছে। হজের শিক্ষা বাস্তবায়ন ও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সরকার, হজ এজেন্সি এবং সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার এই পবিত্র সুযোগ যেন সবার জন্য সহজলভ্য হয়, সেই প্রত্যাশা।
সূত্র: ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ
আরও পড়ুনহজযাত্রীদের টিকা গ্রহণে লাগবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট০৮ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হজয ত র র স খ য হজয ত র দ র হজ র শ ক ষ ক জ বন র র জন য ন বন ধ র একট র খরচ ওমর হ
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ ম্যাচকে মনে করানোর দিনে বুমরার ৫ উইকেট
২০১৯ সালের নভেম্বরে ইডেন গার্ডেনে দিবারাত্রির টেস্ট খেলেছিল ভারত–বাংলাদেশ। সেটিই ছিল ভারতের প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট, বাংলাদেশেরও। এরপর গত ছয় বছরে কলকাতার বিখ্যাত মাঠটিতে আর টেস্ট হয়নি। ইডেনের টেস্ট–খরা কেটেছে আজ ভারত–দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ দিয়ে। অর্ধযুগ বিরতির কারণেই কিনা কে জানে, প্রথম দিনে খেলা দেখতে মাঠে গিয়েছেন ৩৬ হাজার ৫১৩ দর্শক।
দিনটা তাঁদের মন্দ যায়নি। টসে জেতা দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫৯ রানে অলআউট করেছে ভারত। এরপর দিনের শেষ দিকে ভারত ২০ ওভার ব্যাট করে শুধু যশস্বী জয়সোয়ালের উইকেটটাই হারিয়েছে। দিন শেষে দর্শকেরা সঙ্গে নিয়ে গেছেন যশপ্রীত বুমরার ৫ উইকেট দেখার আনন্দ।
দুই টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে টসে জিতে ব্যাট করতে নামা প্রোটিয়াদের শুরুটা ভালোই হয়েছিল। প্রথম ১০ ওভারেই ৫৭ রান তুলে ফেলেছিলেন দুই ওপেনার এইডেন মার্করাম ও রায়ান রিকেলটন। ১১তম ওভারে রিকেলটনকে বোল্ড করে ভারতকে উদ্যাপনের প্রথম উপলক্ষ এনে দেন বুমরা। ২২ বলে ২৩ রান করা রিকেলটন বুমরার ঘণ্টায় ১৪০.৭ কিলোমিটার গতির ডেলিভারি ঠিকঠাক বুঝেই উঠতে পারেননি।
প্রথম স্পেলে টানা ৭ ওভার করা বুমরা শেষটিতে তুলে নেন মার্করামকেও। ১ ছক্কা ৫ চারে ৪৮ বলে ৩১ রান করা মার্করাম ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে ঋষভ পন্তের হাতে। ৫ রানের মধ্যে বুমরা দুই ওপেনারকে তুলে নেওয়ার পর ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে যায় ভারতের হাতে।
কুলদীপ যাদব এসে টেম্বা বাভুমাকে ফেরানোর পর টনি ডি জর্জি ও উইয়ান মুল্ডার কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের ৪৩ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিও ভেঙে দেন কুলদীপ। এরপর আর কেউই দাঁড়াতে পারেননি।
১১৪ থেকে ১৫৯—৪৫ রানের মধ্যে শেষ ৭ উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এর মধ্যে শেষ উইকেট হিসেবে কেশব মহারাজকে এলবিডব্লু করে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন বুমরা। টেস্টে এটি তাঁর ১৬তম বার ইনিংসে ৫ উইকেট। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ইশান্ত শর্মার পর ভারতের মাটিতে টেস্টের প্রথম দিনে কোনো পেসার ৫ উইকেট পেলেন এই প্রথম। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি হয়েছিল গোলাপি বলে।
লাল বল বিবেচনায় নিলে ভারতে টেস্টের প্রথম দিনে ফাস্ট বোলারদের ৫ উইকেট নেওয়ার সর্বশেষ ঘটনা ২০০৮ সালে আহমেদাবাদে দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইনের।
বুমরার ৫ উইকেট নেওয়ার দিনে বল হাতে ভালো করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার পেসাররাও। কাগিসো রাবাদা চোটের কারণে ছিটকে পড়লেও মার্কো ইয়ানসেন, করবিন বশ ও মুল্ডাররা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন। ২০ ওভার ব্যাট করে ভারত তুলতে পেরেছে মাত্র ৩৭ রান। এর মধ্যে ইয়ানসেনের বলে বোল্ড হয়ে ফিরেছেন জয়সোয়াল। ৫৯ বলে ১৩ রান করা লোকেশ রাহুলের সঙ্গে ৩৮ বলে ৬ রান নিয়ে অপরাজিত নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নামা ওয়াশিংটন সুন্দর।
সব মিলিয়ে ইডেনে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনে ৭৫ ওভারে দুই দল মিলিয়ে উঠেছে ১৯৬ রান, উইকেট পড়েছে ১১টি। ইডেনে টেস্টের প্রথম দিনে এর চেয়ে বেশি উইকেট পড়েছিল শুধু ২০১৯ সালের বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচেই (১৩টি)।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৫৫ ওভারে ১৫৯ (মার্করাম ৩১, মুল্ডার ২৪, ডি জর্জি ২৪, রিকেলটন ২৩; বুমরা ৫/২৭, কুলদীপ ২/৩৬)।
ভারত প্রথম ইনিংস: ২০ ওভারে ৩৭/১ (রাহুল ১৩*, জয়সোয়াল ১২; ইয়ানসেন ১/১১)।