কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠন বাছাই কমিটির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বৃহৎ আমদানিকারক শিল্পমালিকদের অনেকেরই অভিযোগ, গেল কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়ন তাঁদের অনেককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

অন্যদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ধরে রাখায় প্রবাসী ও রপ্তানিকারকেরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার কথা বলে আসছিল।

এটি করে ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কাও অনেক উপকার পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও কৃতিত্ব দিতে হয়। আমাদের জন্য স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতে কিছুটা বাগ্‌বিতণ্ডা হলেও শেষমেশ বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারভিত্তিক বিনিময়ব্যবস্থায় কাজ করতে রাজি হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিনিময় হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ প্রভাব বা ‘মোরালসুয়েশনের’ বাইরে গিয়ে ডলারের দাম কোথায় পৌঁছাতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও অনেকেই বলছেন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে তারল্য বৃদ্ধি পেলে এটি ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে; এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো ডলারের দাম সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে কমেও যেতে পারে। যদিও আমাদের মতো দেশে দুর্নীতিসঞ্জাত মুদ্রা পাচার বা উচ্চ শুল্ক বা করের কারণে ট্রেড আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের শঙ্কা থেকেই যায়।

সম্প্রতি বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানগুলো রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি কমিয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দেশের ব্যাংকগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী ডলার কিনতে পারছেন না। অ্যাগ্রিগেটররা ডলার ধরে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে বলে বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। অতীতেও সময়ভেদে এ রকম হয়েছে।

অ্যাগ্রিগেটর হলো সেসব বড় মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছোট এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে রেমিট্যান্স বা আন্তদেশীয় লেনদেনের অর্থ সংগ্রহ করে। কয়েক বছরে দেশের রেমিট্যান্সের বাজারে অ্যাগ্রিগেটররা নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নির্ধারণ করা ডলার দরেই ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কিনতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আইএমএফের ঋণ চুক্তির শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সম্প্রতি ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরুতে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, ১২২ টাকা ৫০ পয়সার বেশি দরে কেউ রেমিট্যান্স কিনবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও একই ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, দেশের কিছু ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান ডলারের বাড়তি দর দাবি করছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের কারণে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে মানি ট্রান্সফার ও অ্যাগ্রিগেটর হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ডলার ধরে রেখে তারা সামনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের রয়েছে বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে কাজের এক কার্যকর অভিজ্ঞতা। অনেক সংস্কারে তারা আমাদের সফলতা এনে দিয়েছে। সেই ধারা থেকে পিছপা হওয়া উচিত হবে না। তবে সেই সঙ্গে আমাদের নিজেদের, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও মনোযোগ দিতে হবে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রা ও বাজার ব্যবস্থাপনায়।

তবে সম্প্রতি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির অভিজ্ঞতায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৎপর থাকলে এটি এড়ানোও সম্ভব। বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে ডলারের দর স্থিতিশীল। ডলারপ্রতি ৩০-৫০ পয়সা ওঠানামা করছিল। মানি ট্রান্সফার কোম্পানিগুলো চাইলেও ডলার ধরে রাখার সুযোগ নেই। তারা বাজারের রেট গ্রহণকারী।

ব্যাংকগুলো বাড়তি দরে ডলার কিনতে না চাইলে তারা বিক্রি করবে কোথায়? এখন এস আলমের মালিকানাধীন ছয়টি ব্যাংকের অন্যায় দাপট আর নেই। তারাই মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে অনেকটা কার্টেল বা অ্যাগ্রিগেটরের ভূমিকা পালন করতেন। প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বাইরে রেখে দিয়ে পাচার বা আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের কাজে ব্যবহার করত। তারাই বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের আগাম ঋণ দিত আর বেশি দামে তাদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করত। এখন এটি বন্ধ হয়েছে, তাই রেমিট্যান্স বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভালো সময়ে এসে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়েছে। আকুর পেমেন্টসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের যেসব বৈদেশিক দায় বকেয়া ছিল, এরই মধ্যে সেগুলোর বেশির ভাগ পরিশোধ করা হয়েছে। এখন আর জরুরি কোনো দায় পরিশোধের চাপ নেই।

অন্যদিকে আসন্ন কোরবানি ঈদ উপলক্ষে বাড়তি রেমিট্যান্স দেশে আসবে। বাড়তি দরে ডলার কিনতে হবে, এমন কোনো প্রয়োজনীয়তা ব্যাংকের থাকবে না। তবে তাদের কোনোভাবেই পুরোনো চাপাচাপির কায়দায় যাওয়া যাবে না।

আমরা জানি, বাংলাদেশের ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে রেমিট্যান্স। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে ২ হাজার ৫৩৬ কোটি বা ২৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে আসে। ৫-৭ বছর আগেও রেমিট্যান্সের বাজার ছিল ছোট মানি এক্সচেঞ্জনির্ভর। এসব মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংক ডলার সংগ্রহ করত।

কিন্তু এখন রেমিট্যান্সের বাজার অ্যাগ্রিগেটরনির্ভর হয়ে উঠেছে। ছোট মানি এক্সচেঞ্জগুলো ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি না করে অ্যাগ্রিগেটরদের দিচ্ছে। তারা সংগৃহীত রেমিট্যান্স দর-কষাকষির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বেশি মূল্যে বিক্রি করছে। অ্যাগ্রিগেটরদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। অভিযোগ রয়েছে, অনেকটা এ কারণেই বর্তমানে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স-প্রবাহে শীর্ষ উৎসের নাম যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নামে দেখানো প্রবাসী আয়ের বড় অংশ সংগ্রহ করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।

একইভাবে বেশ কিছু রেমিট্যান্স দেখানো হচ্ছে যুক্তরাজ্যের রেমিট্যান্স হিসেবে। এমনিভাবে অনেক অর্থ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তাই অ্যাগ্রিগেটরদের কারণে রেমিট্যান্সের উৎস দেশের পরিসংখ্যানও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না।

রেমিট্যান্সের বাজার এখন অ্যাগ্রিগেটর বা পাইকারেরা নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানের মালিকানা যে দেশের, তাদের মাধ্যমে আসা অর্থও ওই দেশের হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী আয় এত বেশি দেখাচ্ছে। অ্যাগ্রিগেটরদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উৎস দেশ নির্ণয় করাও খুবই কঠিন।

আরও পড়ুনডলারের জোর কমে গেলে কার লাভ, কার ক্ষতি০৬ মে ২০২৫

রেমিট্যান্সের বাজার এখন অ্যাগ্রিগেটর বা পাইকারেরা নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানের মালিকানা যে দেশের, তাদের মাধ্যমে আসা অর্থও ওই দেশের হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী আয় এত বেশি দেখাচ্ছে। অ্যাগ্রিগেটরদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উৎস দেশ নির্ণয় করাও খুবই কঠিন। বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও (খুচরা বাজার) ডলারের দর ছিল অনেকটাই স্থিতিশীল। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায়। আর ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১২৩ টাকায় ডলার লেনদেন হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক একযোগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারলে, সঠিক সময়ে বা প্রক্রিয়ায় বাজার হস্তক্ষেপ করতে পারলে অনেক দামে ডলার কেনার আশঙ্কা ম্লান হয়ে যাবে। এ কাজে তারা দেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক ব্যাংকের ট্রেজারিগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারে। এমনকি আইএমএফের সহায়তা চাইতে পারে। প্রয়োজনে ‘স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’-এর আকার বাড়ানো লাগতে পারে।

বাংলাদেশের রয়েছে বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে কাজের এক কার্যকর অভিজ্ঞতা। অনেক সংস্কারে তারা আমাদের সফলতা এনে দিয়েছে। সেই ধারা থেকে পিছপা হওয়া উচিত হবে না। তবে সেই সঙ্গে আমাদের নিজেদের, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও মনোযোগ দিতে হবে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রা ও বাজার ব্যবস্থাপনায়।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অ য গ র গ টরদ র ব জ র র ওপর ছ ড় প রব স আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

গরিব পাচ্ছে বিদ্যুৎ ভর্তুকির ছিটেফোঁটা, লাভবান ধনীরা

বিদ্যুতের ভর্তুকি বছরে ৬২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তবে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এর বড় অংশ ধনীরা ভোগ করছেন। বিপরীতে গরিবরা ছিটেফোঁটা পাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া ভর্তুকির মাত্র ১২ শতাংশের সুবিধাভোগী সবচেয়ে গরিবরা। বিপরীতে ৩২ শতাংশের সমপরিমাণ (এক-তৃতীয়াংশ) পাচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ গ্রাহক, যার পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। বৈষম্যমূলক কাঠামোর কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি করছে।

আইএমএফের কারিগরি সহায়তা-সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি ভর্তুকি কমাতে কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি দাম বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। প্রয়োজনে সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছে আইএমএফ। গত ৩০ জুন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ভর্তুকি সংস্কার শীর্ষক এ প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভর্তুকির সুফল মূলত ধনীরা পান। কারণ, তারাই বিদ্যুৎ-জ্বালানি বেশি ভোগ করেন। এ জন্য দাতাগোষ্ঠী ভর্তুকি থেকে বের হতে চাপ দেয়। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা– সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁর পরামর্শ, একদিকে ভর্তুকি কমাতে হবে, অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বাড়াতে হবে। তাহলে ভর্তুকিশূন্য হলেও প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্তরা ভিন্ন নামে ক্ষতিপূরণ পাবেন।

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি
২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। গত ১৬ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৭৮০। অথচ দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা না থাকলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্র বানিয়েছিল। ফলে উৎপাদন না করেও কেন্দ্র মালিকরা প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা সরকার থেকে পেয়েছে, যার প্রভাবে বেড়েছে বিদ্যুতের খরচ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিডিবির বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট কিনতে লেগেছে ১১ টাকা ৭৪ পয়সা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৬ টাকা ১৮ পয়সা। মাত্র পাঁচ  বছরে খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। এ চাপ সামলাতে তৎকালীন সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।

২০০৯ সালে বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। এখন হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। এর পরও উৎপাদন খরচের সঙ্গে খুচরা দামের সমতা হয়নি। লোকসান কমাতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকি ছিল ৭ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এর পর থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ হাজার ৮০০, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৫১১, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৪০০ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি ৬২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ-গ্যাস মিলে ভর্তুকি ছিল জিডিপির ১.৩২ শতাংশ। তবে ২০২৩-২৪-এ তা কিছুটা কমে ১.১০ শতাংশ হলেও বাজেটের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে।
আইএমএফ তিন ধাপে ভর্তুকি সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে প্রাথমিক (লাইফলাইন) গ্রাহকদের দাম অপরিবর্তিত রেখে ধনীদের জন্য ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এতে ২.১ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি শহরে ১০ এবং গ্রামের জন্য ৫ শতাংশ দাম বাড়াতে হবে। এতে ৬.১ শতাংশ ভর্তুকি হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে।
মধ্য মেয়াদে সরাসরি ভর্তুকি তুলে দিয়ে সর্বনিম্ন ৬০ শতাংশ পরিবারকে মাসে ৪৮৮ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এতে ৬৪ শতাংশ ভর্তুকি কমানো সম্ভব। আর দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ মূল্যকে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাভোগীদের তালিকার সঙ্গে যুক্ত করে প্রকৃত দরিদ্রদের ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ এসেছে। এতে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি সাশ্রয় সম্ভব।
পাশাপাশি আইএমএফ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ তথ্য ব্যবস্থাপনা একীভূত, অকার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সরকারকে সংস্কারের রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে বলেছে।

দাম বাড়ার চাপে সরকারের নারাজি
আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির শর্ত হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার। পাশাপাশি প্রতিবছর চারবার করে দাম বাড়িয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়েনি।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, অনেক চাপ সত্ত্বেও তারা দাম বাড়াননি। এ মুহূর্তে এমন উদ্যোগ নেই, নিকট ভবিষ্যতেও দাম বাড়বে না। তবে সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও খাতভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গরিব পাচ্ছে বিদ্যুৎ ভর্তুকির ছিটেফোঁটা, লাভবান ধনীরা