আগামী ২ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট দেওয়ার আগে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর কথায় আগামী বাজেটের মূল দর্শন, অগ্রাধিকার, সংস্কার, করনীতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, এলডিসি থেকে উত্তরণসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেসবাহুল হক

সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটের মূল দর্শন কী হবে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবারের বাজেট গতানুগতিক হবে না। বাস্তবায়ন করা যায় এমন বাজেট দেওয়া হবে। আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে বাজেটে সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। সহায়তা না পাওয়া গেলে বাজেট দেওয়া কঠিন হয়ে যেত। তবে যথাসম্ভব অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। বাজেটের লক্ষ্য থাকবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন।

আগে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও সাধারণ মানুষ এর সুফল পায়নি। আগামী বাজেটের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে চেষ্টা করা হবে। সমতাভিত্তিক এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ থাকবে। এবারের বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। এখন ৯ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সাড়ে সাত বা আট শতাংশে নামিয়ে আনতে পারব। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো হবে। বাজারে কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের এখানে অনেক বেশি। একটি অংশ চাঁদা আদায় করে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপার। রাজনীতির ব্যাপারও রয়েছে। 

সমকাল: ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কী কী উদ্যোগ থাকবে? 

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের মূল লক্ষ্য ব্যবসা আরও সম্প্রসরিত করা। এটি করা গেলে প্রত্যেক মানুষ সুবিধা পাবে। ‘অলিগার্ক’ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে অন্যরা সুবিধা পায় না। ছোট ছোট ফার্ম আসবে। এতে গুণগত মান বাড়বে। এসএমই ডেটাবেইজ তৈরি করা হবে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল আছে। প্রয়োজনে তহবিল বাড়ানো হবে। 

সমকাল: আপনি আগে বলেছিলেন, আইএমএফের ঋণ ছাড়াই বাজেট দেবেন। এখন কেন তাদের ঋণ ছাড়া বাজেট দেওয়া কঠিন হতো বলে মনে করছেন? 

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের অবস্থান ছিল মুদ্রাবিনিময় হারে আইএমএফ যেভাবে চাইছে, নমনীয়তা দেখাব না। পরে আলোচনায় একটা সমঝোতা হয়েছে। আইএমএফের অর্থ না পাওয়া গেলে অন্যান্য সংস্থার বাজেট সহায়তা পাওয়া যেত না। এতে করে বাজেট আরও ছোট করতে হতো। অথবা আরও বেশি ট্রেজারি বিল-বন্ড ইস্যু করার প্রয়োজন হতো। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব চিন্তা করে অর্থ নেওয়া হয়েছে। 

সমকাল: আইএমএফও কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। কর আদায় বাড়াতে গিয়ে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষের ওপর কোনো চাপ বাড়বে বলে মনে করেন? 

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি মনে করি, চাপ বাড়বে না। জনগণ যে কর দেয় তার একটা অংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। আদায়কারী করকর্তাদের পকেটে চলে যায়। ক’দিন আগে একজন কমিশনার ১০০ কোটি টাকা করের মধ্যে ৬০ কোটি টাকা ছাড় দেখিয়েছে। এর মধ্যে কত নিজে তিনি নিয়েছেন, তিনিই ভালো জানেন। বিষয়টি জানতে পেরে আমি এনবিআর চেয়ারম্যানকে বলেছি, আগে ‘সাসপেন্ড’ করো, তারপর পুলিশে দাও। এগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি কর ফাঁকি বন্ধেরও উদ্যোগ থাকবে। তাছাড়া করছাড়ও কমিয়ে আনা হবে। এসব উদ্যোগে জনগণের ওপর আর চাপ দেওয়া লাগবে না। 

সমকাল: বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ থাকবে কী?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: কোনো খাতেই কোনোভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। কালো টাকার উৎস বন্ধে আমি চেষ্টা করছি, যে দামে জমি কেনাবেচা হয়, সে দামেই হবে জমির নিবন্ধন বা দলিল। এক্ষেত্রে করও কমানো হবে। এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে কিনা জানি না। গুলশানে প্রতি কাঠা জমি ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও দলিল হয় ৫ কোটি টাকায়। এভাবে কেনাবেচায় দু’পক্ষই বিপদে পড়েছে। অনেকে ঘুষটুষ দিয়ে এখান থেকে পার পাচ্ছে। আমরা এ প্রবণতা বন্ধ করতে চাই। 

সমকাল: জ্বালানি সংকটসহ নানা সমস্যা নিয়ে উদ্যোক্তারা উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন। বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য কী বার্তা দেবেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এ সরকার আসার পরই সবাই দাবি-দাওয়া নিয়ে আসছে। অনেক দাবি যে যৌক্তিক, তাও নয়। তবে সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়াতে যেভাবেই হোক জ্বালানি নিশ্চিত করা হবে। সার ও জ্বালানি বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না। যত টাকা লাগবে, দেওয়া হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে না। তবে সিস্টেম লস কমিয়ে ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

সমকাল: অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী বাজেটে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। এসব বিষয়ে কী থাকছে বাজেটে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: দেশের দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ বা অবসায়নসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আলাদা নতুন আইন হয়েছে। আমানতকারীদের বহু টাকা বেহাত হয়ে গেছে। কীভাবে তাদের অর্থ পরিশোধ করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকিগুলোও করা হবে। যাদের বড় বড় আমানত যেমন– ১০ কোটি টাকা চাইলেই হুট করে দেওয়া সম্ভব হবে না। ছোট ছোট আমানত দেওয়া সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়া হবে। বড় আমানতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হওয়ার ‘অপশন’ দেওয়া হবে। কাউকে বন্ড বা শেয়ার দেওয়া হতে পারে। এসবের জন্য আলাদা একটি তহবিল গঠন করবে সরকার। 

সমকাল: এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কর্মকর্তারা আন্দোলন করছেন। তারা কলমবিরতিতে রয়েছেন। এর সমাধান কীভাবে হবে? 

সালেহউদ্দিন আহমেদ: রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি করতে আলাদা বিভাগ করায় এনবিআরের লোকজন হইচই করছেন। আমরা এখানে ‘কম্প্রোমাইজ’ করব না। ২০০৮ সালে চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন কর্মকর্তারা করতে দেননি। সচিব পদ নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তারা ভুল ধারণায় আন্দোলন করছেন। অধ্যাদেশের কোনো জায়গায় বলা হয়নি যে, সচিব নির্দিষ্ট ক্যাডার থেকে নেওয়া হবে। ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কর এবং কাস্টমসকে। তারা এতেও সন্তুষ্ট নন। 

সমকাল: সার্বিকভাবে নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার কী থাকছে? 

সালেহউদ্দিন আহমেদ: সার্বিকভাবে বাজেটে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর থাকবে। স্বাস্থ্যসেবায় টাকা কম দেওয়া হয় তা নয়, কিন্তু বাস্তবায়ন খুব খারাপ। যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে, নষ্ট হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু মৌলিক বিষয় পরিচালন বাজেটে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পনির্ভর না হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে পরিচালন বাজেট বড় হবে। ইতোমধ্যে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দেনাপাওনাসহ অনেক বকেয়া ইস্যু সমাধান করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। 

সমকাল: বাজেটে কর কাঠামোতে বড় কোনো পরিবর্তন থাকছে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: সরকারের আয় বাড়াতে বাজেট ব্যবসাবান্ধব করা হবে। আগের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান সুবিধা পাবে এমনটি হবে না। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। এর আগে মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠান বাড়তি সুবিধা পাওয়ায় অনেক ভালো উদ্যোক্তা পিছিয়ে পড়েছেন। এবার তা হবে না।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড স ল হউদ দ ন আহম দ স ল হউদ দ ন আহম দ র জন য করছ ন সরক র সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

এরদোয়ানের গদি বাঁচাতেই কি পিকেকে ভাঙছে

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহী আন্দোলন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে। তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম হামলার প্রায় চার দশক পর কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) তাদের সংগঠন ভেঙে দেওয়ার এবং অস্ত্র পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে শুধু তুরস্ক নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোচড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আবদুল্লাহ ওজালানের নেতৃত্বে পিকেকে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। সংগঠনটি শুরু থেকেই একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল। পাশাপাশি তুরস্কে বসবাসকারী কুর্দিদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করাও তাদের উদ্দেশ্যের অংশ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পিকেকের নেতাদের সহিংসতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। 

প্রথমে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকানো যাক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইতিমধ্যেই দুটি মেয়াদ শেষ করেছেন এবং তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এ জন্য তাঁকে তুরস্কের সংবিধান সংশোধন করতে হবে অথবা পার্লামেন্টকে আগাম নির্বাচনের জন্য রাজি করাতে হবে। এই দুটি পথেই তাঁর সরকারের অতিরিক্ত রাজনৈতিক সমর্থন দরকার। এই সমর্থন বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট—জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং কট্টর জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি) দিতে পারছে না। 

সমর্থনের এই ঘাটতি পূরণ করতে পারে তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম দল পিপলস ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টি (ডিইএম)। দলটি কুর্দিপন্থী। 

আন্তর্জাতিক পটভূমিও পিকেকের এই আত্মবিলুপ্তির সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। গত ডিসেম্বর মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হন। আসাদ তুরস্ককে দুর্বল করতে পিকেকে যোদ্ধাদের ব্যবহার করতেন। কিন্তু আসাদ সরকারকে উৎখাত করে সিরিয়ায় এখন যে নতুন সরকার এসেছে, তারা পিকেকের প্রতি আসাদের মতো সহানুভূতিশীল নয়। পিকেকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যে সংগঠনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র এত দিন মদদ দিয়ে এসেছে, তাদের কাছ থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। পিকেকের সহযোগী সংগঠনগুলো একসময় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। 

পিকেকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। পিকেকের সন্ত্রাসবাদ থেকে সদ্য পাওয়া মুক্তিকে ধরে রাখতে হলে, তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই প্রচেষ্টা শুধু তুরস্কের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে পারে। এটি দেখাতে পারে যে রাজনৈতিক বিদ্রোহ বা সহিংসতা বন্ধ হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও অংশগ্রহণমূলক শান্তির পথ তৈরি করতে পারে। 

সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে, বিশেষ করে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে (এসডিএফ) প্রায় নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করলেই ভালোভাবে রক্ষা করা সম্ভব। আরেকটি বিষয়, যেটি খুব একটা আলোচিত হয় না; কিন্তু পিকেকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, সেটি হলো তুরস্কের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে ড্রোনপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। বিশেষ করে, এই ড্রোন দিয়ে তুরস্ক পিকেকের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, এমনকি ইরাকের গভীর অঞ্চলেও। 

এর ফলে পিকেকের সামরিক ও কৌশলগত কার্যক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি হয়তো তাদের বাধ্য করেছে পুরো বিদ্রোহী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে। এসব কারণ মিলিয়ে তুরস্কের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে সহিংসতার পথ ছাড়াই কুর্দি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যেতে পারে। তবে অস্ত্রের যুগ থেকে শান্তি ও সংহতির যুগে সফলভাবে প্রবেশ করতে হলে এরদোয়ানের সরকারকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। 

প্রথমত দরকার স্বচ্ছতা। পিকেকে বহু বছর ধরে সহিংসতা চালিয়ে এসেছে, ফলে তুরস্কের সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি ক্ষোভ স্বাভাবিক। তাই তুরস্ক সরকার ও পিকেকের মধ্যে যে আলোচনা হবে, তা স্পষ্টভাবে ও খোলাখুলি প্রকাশ করা খুব জরুরি। বিশেষ করে পিকেকেকে কোন বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে, সেটা মানুষকে জানানো দরকার। যেমন সিরিয়ার সশস্ত্র সংগঠন ওয়াইপিজি যেটি পিকেকের সঙ্গে সম্পর্কিত—তারা অস্ত্র ছাড়বে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন। এই প্রক্রিয়া খুব সংবেদনশীল, তাই এতে তুর্কি পার্লামেন্ট, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত। 

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গণতন্ত্র। এই ঐতিহাসিক শান্তির সুযোগ তখনই সফল হবে, যদি তা প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে হয়—যার মধ্যে থাকবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা এবং মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা আরও জোরদার করার মতো কার্যকর পদক্ষেপ। 

এরদোয়ানের সরকার চাইলে এ বিষয়ে দ্রুত কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের সাম্প্রতিক আদেশ মেনে কুর্দি রাজনৈতিক নেতা সেলাহাত্তিন দেমিরতাশকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে একটি বড় বার্তা দেওয়া সম্ভব। যখন ওজালানকে মুক্তির চিন্তা হচ্ছে, তখন সরকারের উচিত অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়েও খেয়াল রাখা। যেমন ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু ও ভিক্টোরি পার্টির নেতা উমিত ওজদাগের অবস্থার দিকেও নজর দেওয়া দরকার। 

পিকেকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। পিকেকের সন্ত্রাসবাদ থেকে সদ্য পাওয়া মুক্তিকে ধরে রাখতে হলে, তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই প্রচেষ্টা শুধু তুরস্কের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে পারে। এটি দেখাতে পারে যে রাজনৈতিক বিদ্রোহ বা সহিংসতা বন্ধ হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ও অংশগ্রহণমূলক শান্তির পথ তৈরি করতে পারে। 

সিনান উলগেন ইস্তাম্বুলভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইডামের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ