সরকারি নথিতে রাজধানীর বাউনিয়ায় বড়সড় একটি পুকুর আছে। জমির দাগ নম্বর ধরে খুঁজতে গেলাম পুকুরটিকে। গিয়ে দেখা গেল, সেখানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি টিনের ছাউনির ঘর ও একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এমনকি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ও করা হয়েছে সরকারি পুকুরের জমিতে।

যেখানে পুকুর ছিল, তার কাছেই একটি বাড়িতে থাকেন এক প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, তিনি ওই এলাকায় বাস করেন চার দশকের বেশি সময় ধরে। পুকুরটি তিনি দেখেছেন। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা গোসল করতেন। মাছ ধরতেন। বছর ১০-১২ আগে পুকুরটি ভরাট করা শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে পুরো ভরাট করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

বাউনিয়ার পুকুরটি নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুকুরের জমির অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ১৯।

ঢাকা জেলা প্রশাসন ২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকার পুকুরগুলো নিয়ে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে পাঠায়। এতে রাজধানীতে থাকা খাস ও ভিপি (অর্পিত সম্পত্তি) জমিতে ৫৮টি পুকুরের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়।

জেলা প্রশাসন রাজউককে চিঠিটি দিয়েছিল পুকুরগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার, পুনঃখনন, পাড় বাঁধাই ও হাঁটার রাস্তা নির্মাণ করার জন্য, যাতে তা দখলমুক্ত থাকে এবং অগ্নিদুর্ঘটনার সময় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

এই প্রতিবেদক গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দাগ নম্বর ধরে রাজধানীর পুকুরগুলোর খোঁজ করেছেন। জানুয়ারি মাসে বাউনিয়ায় গিয়ে খোঁজ করা হয় সেখানে থাকা পুকুরটির। দেখা যায়, ৭৭ শতক আয়তনের পুকুরটির কোনো অস্তিত্ব নেই।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন, রাজউকের জরিপ ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান অনুযায়ী, ৫৮টির মধ্যে ৩১টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এ যেন পুকুরচুরি! পুকুরচুরি বাগ্‌ধারাটির অর্থ বড় ধরনের চুরি। ঢাকার সেই পুরোনো পুকুরগুলো বড় ধরনের চুরিরই শিকার হয়েছে।

৩১টির মধ্যে ২০টি পুকুরের জমির পুরো ও আংশিক অবৈধ দখলদার বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দুটি পুকুরের আংশিক জায়গায় গড়ে উঠেছে ধর্মীয় স্থাপনা। তিনটি পুকুরের জায়গায় বানানো হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। খেলার মাঠ ও উদ্যান হয়ে গেছে দুটি পুকুরের জায়গা। পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে দুটি পুকুর। সরকারিভাবে তিনটি পুকুরের জায়গা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা অধিগ্রহণ করেছে।

বাকি ২৭টি পুকুরের মধ্যে ৯টি কোনোমতে টিকে আছে। আশপাশের জলাশয়ের সঙ্গে ডুবে আছে ১৪টি। সেগুলোকে আলাদা করা কঠিন। চারটি পুকুরের সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়নি। এসব পুকুরের অবস্থান সম্পর্কে প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।

এই প্রতিবেদক গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দাগ নম্বর ধরে রাজধানীর পুকুরগুলোর খোঁজ করেছেন। জানুয়ারি মাসে বাউনিয়ায় গিয়ে খোঁজ করা হয় সেখানে থাকা পুকুরটির। দেখা যায়, ৭৭ শতক আয়তনের পুকুরটির কোনো অস্তিত্ব নেই। জমির এক পাশে বাউনিয়া ভূমি অফিসের (মিরপুর রাজস্ব সার্কেল) একতলা ভবন। কার্যালয়টির সামনে কিছু জমি খালি। সেখানে যে সাম্প্রতিককালে বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, তা বোঝা যায়। কারণ, কোনো ঘাস এখনো জন্মায়নি। পুকুরটির বাকি জমিতে ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা।

ভূমি অফিসে গিয়ে পাওয়া গেল ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হামিদুর রহমানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কার্যালয় নির্মাণের আগেই পুকুর ভরাট হয়ে গিয়েছিল। অবৈধ দখলদার ছিল। পরে জায়গা উদ্ধার করে ২০২১ সালে ভূমি অফিস নির্মাণ করা হয়।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন, রাজউকের জরিপ ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান অনুযায়ী, ৫৮টির মধ্যে ৩১টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এ যেন পুকুরচুরি! পুকুরচুরি বাগ্‌ধারাটির অর্থ বড় ধরনের চুরি। ঢাকার সেই পুরোনো পুকুরগুলো বড় ধরনের চুরিরই শিকার হয়েছে।

পুকুরের খোঁজে

ঢাকা জেলা প্রশাসনের নথি বলছে, রাজারবাগ মৌজার ৭৩৪০ নম্বর দাগের প্রায় পৌনে ১১ শতক আয়তনের একটি পুকুর রয়েছে। পূর্ব রাজারবাগে গিয়ে পুকুর খোঁজ পেতে বেগ পেতে হয়। পরে রাজউকের প্রতিবেদনে দেওয়া জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) লোকেশন মুঠোফোনে দেখে পুকুরের জায়গাটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। মিলিয়ে দেখা যায়, রাজউক পুকুরের জায়গায় যে স্থাপনার কথা বলেছে এবং ছবি দিয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে।

পুকুরটির জায়গার কিছু অংশে স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকটি ২-৩ তলা বাড়ি করেছেন। কিছু অংশে টিনের ছাউনির কিছু ঘর আছে। মাঝখানে কিছুটা খালি জায়গা। সেটি মূলত আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। পুরোটা ময়লা-আবর্জনায় ভরা।

পুকুরের জায়গায় তোলা ঘরে বসবাসকারী কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা পুকুর থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পাশাপাশি জায়গাটি দেখে ফেরার পথে স্থানীয় এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে থামিয়ে সেখানে যাওয়া এবং ছবি তোলার কারণ জানতে চান। ওই ব্যক্তির দাবি, জায়গাটি তাঁরা কিনেছেন, সেখানে কখনো কোনো পুকুর ছিল না।

পুকুরটির জায়গার কিছু অংশে স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকটি ২-৩ তলা বাড়ি করেছেন। কিছু অংশে টিনের ছাউনির কিছু ঘর আছে। মাঝখানে কিছুটা খালি জায়গা। সেটি মূলত আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। পুরোটা ময়লা-আবর্জনায় ভরা।

অবশ্য স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ওই ব্যক্তি পুকুরের জায়গার অবৈধভাবে দখলদারের একজন। তাঁর নাম রুবেল।

এটি একসময় পুকুর ছিল। বর্তমানে ভূমি কার্যালয়ের রাজস্ব সার্কেলের একটি ভবন হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেতের বটতলা এলাকায়.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বড় ধরন র চ র প রথম আল প ক রগ ল দখলদ র কর ছ ন ব উন য় র জউক অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ‘গণহত্যার অর্থনীতিতে’ লাভবান মাইক্রোসফট-অ্যামাজনসহ আরো যারা

অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেসকা আলবানিজ একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং গাজায় গণহত্যার যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তাকারী বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলেও প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশন (গুগলের মূল কোম্পানি) এবং অ্যামাজনের মতো ৪৮টি করপোরেট সংস্থার নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজারের বেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ইসরায়েলের স্থায়ী দখলদারিত্বের অভিযান অস্ত্র নির্মাতা ও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আদর্শ পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে, যেখানে সরবরাহ ও চাহিদা রয়েছে। তবে তদারকি নেই, দায়বদ্ধতাও নেই। সেখানে বিনিয়োগকারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবাধে মুনাফা করছে।”

আরো পড়ুন:

আরিফুলকে হত্যা করে তারই ২ বন্ধু: পুলিশ

নরসিংদীতে ইউপি কার্যালয়ে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা

এতে আরো বলা হয়েছে, “কোম্পানিগুলো এখন আর শুধু দখলদারিত্বের প্রকল্পে জড়িত নয়, তারা সম্ভবত এক ধরনের ‘গণহত্যার অর্থনীতির’ অংশ হয়ে উঠেছে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে ইসরায়েলের গাজা নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্পের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে।

গত বছর এক বিশেষজ্ঞ মতামতে আলবানিজ বলেছিলেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল যে অভিযান চালাচ্ছে, তা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি রয়েছে।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, এই তথ্যগুলো দেখায় কেন ইসরায়েলের গণহত্যা এখনও চলমান। 

“কারণ এটি অনেকের জন্য লাভজনক,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে যে অস্ত্র নির্মাতা ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অস্ত্র শিল্প খাত
ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ বিশ্বে বৃহত্তম অস্ত্র ক্রয় কর্মসূচির অংশ, যার সঙ্গে যুক্ত আছে আটটি দেশের অন্তত ১ হাজার ৬০০ কোম্পানি। এ কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লকহিড মার্টিন। তবে এর যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। 

এসব কোম্পানির মধ্যে উল্লেখযোগ্য লিওনার্দো এস.পি.এ. । এটি একটি ইতালীয় কোম্পানি, সামরিক খাতে তারা বড় ভূমিকা রাখছে। আরেকটি হলো ফ্যানুক কর্পোরেশন। এটি একটি জাপানি কোম্পানি, যেটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।

প্রযুক্তি খাতে ইসরায়েলকে সহায়তাকারী কোম্পানি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তি খাত ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি চালানো, তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক ‘পারমিট’ ব্যবস্থাকে সমর্থন করছে।

ইসরায়েলের গণহত্যায় সমর্থনকারী প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান) ও অ্যামাজন। এ তিনটি মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি ইসরায়েলকে প্রায় পুরো সরকারের ব্যবহারের জন্য ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এতে তাদের তথ্য বিশ্লেষণ ও নজরদারি ক্ষমতা অনেক বেড়েছে।

গাজায় গণহত্যায় সহায়তাকারী অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইবিএম অন্যতম। ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত কেন্দ্রীয় ডেটাবেস পরিচালনার দায়িত্বে আছে আইবিএম। এই ডেটাবেস পরিচালনা করে ইসরায়েলের জনসংখ্যা, অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষ। 

প্যালানটিয়ার টেকনোলজিস আরেকটি কোম্পানি, যারা ইসরায়েলকে সাহায্য করে।  এই মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানি ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সহায়তা আরো বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কোম্পানি যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ডেটা বিশ্লেষণ এবং লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে এআই প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ল্যাভেন্ডার, গসপেল ও হোয়ার’স ড্যাডি নামের এআই সিস্টেম, যা পূর্বাভাসমূলক নজরদারি ও টার্গেটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

সারসংক্ষেপে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেছে কীভাবে অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ইসরায়েলের দখলদার নীতিতে সরাসরি লাভবান হচ্ছে এবং একটি ‘গণহত্যার অর্থনীতির’ সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে আরো কয়েকটি কোম্পানির নাম উঠে এসেছে, যারা তথাকথিত ‘দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য’ (ডাবল ইউজ) বেসামরিক প্রযুক্তি তৈরি করে, যেগুলো ইসরায়েলের দখলদারীত্ব কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গৃহ ধ্বংস ও অবৈধ বসতি নির্মাণে সহায়তাকারী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ক্যাটারপিলার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই কোম্পানির ভারী যন্ত্রপাতি ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভাঙা এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

আরো রয়েছে রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ। ইতালির লিওনার্দো কোম্পানির মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলকে সামরিক ও নজরদারি প্রযুক্তি সরবরাহ করে। এইচডি হুন্দাই দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানি, যারা ভারী নির্মাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করে ইসরায়েলকে। সুইডেনভিত্তিক ভলভো গ্রুপের যন্ত্রপাতিও বাড়িঘর ধ্বংস ও অবৈধ বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ভাড়া প্ল্যাটফর্মের মধ্যে বুকিং ডটকম এবং এয়ারবিএনবি দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবস্থিত অবৈধ বসতির মধ্যে হোটেল ও বাসস্থানের তালিকা প্রকাশ করে, যা সেগুলোর বৈধতা দেওয়ার পথে সহায়তা করে।

ইসরায়েলকে সহায়তাকারী জ্বালানি সরবরাহকারীর কোম্পানির মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ড্রামন্ড কোম্পানি  এবং সুইজারল্যান্ডের গ্লেনকোর।  এই দুই প্রতিষ্ঠান মূলত কলম্বিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে ইসরায়েলকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করে।

কৃষি খাতে ইসরায়েলকে সহায়তকারী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড। এই চীনা কোম্পানি ইসরায়েলের বৃহত্তম খাদ্য কোম্পানি টনুভার প্রধান মালিক। টনুভা ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জবরদখল করা জমি ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছে।

ড্রিপ সেচ প্রযুক্তির সরবরাহকারী নেটাফিম নামে কোম্পানিটির ৮০ শতাংশ মালিকানা মেক্সিকোর ওরবিয়া অ্যাডভান্স করপোরেশনের। এটি দখলকৃত পশ্চিম তীরে পানি সম্পদ ব্যবহারের জন্য অবকাঠামো সরবরাহ করে।

ইসরায়েলকে অর্থায়ন করে সহায়তা করছে যারা
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গাজার ওপর চলমান যুদ্ধের অর্থায়নে ট্রেজারি বন্ড (রাষ্ট্রীয় ঋণপত্র) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কিছু ব্যাংক, যেমন ফ্রান্সের বিএনপি প্যারিবাস এবং যুক্তরাজ্যের বার্কলেজ ইসরায়েলকে ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করেছে, এমনকি তাদের ঋণমান কমে যাওয়ার পরও।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির পেছনে বিনিয়োগকারী হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি বৃহৎ বহুজাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরক এবং ভ্যানগার্ড।

ব্ল্যাকরক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্ল্যাকরক প্যালানটিয়ার ৮.৬ শতাংশের মালিক (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী)। মাইক্রোসফটের ৭.৮ শতাংশ, অ্যামাজনের ৬.৬ শতাংশ, অ্যালফাবেটের ৬.৬ শতাংশ, আইবিএমের ৮.৬ শতাংশ, লকহিড মার্টিনের ৭.২ শতাংশ (তৃতীয় সর্বোচ্চ) ও ক্যাটারপিলারের ৭.৫ শতাংশ বিনিয়োগকারী ব্ল্যাকরক।

ভ্যানগার্ড হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভ্যানগার্ড ক্যাটারপিলারের ৯.৮ শতাংশ, শেভরনের ৮.৯ শতাংশ, প্যালানটিয়ারের ৯.১ শতাংশ, লকহিড মার্টিনের ৯.২ শতাংশ এবং এলবিট সিস্টেমসের ২ শতাংশ (ইসরায়েলি অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি) বিনিয়োগকারী। 

ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ড- এই দুই মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান শুধু মার্কিন প্রযুক্তি ও অস্ত্র কোম্পানিগুলোতেই নয়, বরং ইসরায়েলি সামরিক কোম্পানিতেও বড় অঙ্কে বিনিয়োগ করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের দখলদার নীতি ও গাজায় চলমান যুদ্ধের সঙ্গে আর্থিকভাবে জড়িত বলেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ফিলিস্তিন অধিকৃত অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঔপনিবেশিক প্রকল্প ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত গণহত্যাগুলো ঐতিহাসিকভাবে করপোরেট খাতের মাধ্যমে পরিচালিত ও সহায়তাপ্রাপ্ত হয়েছে।”

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সম্প্রসারণকে একটি ‘ঔপনিবেশিক বর্ণবাদ-ভিত্তিক পুঁজিবাদ’ (কলোনিয়াল রেসিয়াল ক্যাপিটালিজম) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে লাভবান হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, যেসব প্রতিষ্ঠান পূর্বে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষ করার প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছিল, তারা সেই ভূমিকা থেকে সরে না এসে বরং এখন ‘গণহত্যার অর্থনীতিতে’ সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।”

অস্ত্র কোম্পানিগুলোর জন্য গাজার গণহত্যা লাভজনক
২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলারে, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি, বিশেষ করে অস্ত্র, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতের কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে উল্লেখযোগ্য মুনাফা করেছে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ১৭৯ শতাংশ স্ফিত হয়েছে, যার ফলে বাজারমূল্য বেড়েছে ১৫৭.৯ বিলিয়ন ডলার।

বীমা খাতও এতে লাভবান
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলিয়ান্‌জ ও অ্যাক্সার মতো বৈশ্বিক বীমা কোম্পানিগুলো ইসরায়েলের দখলদারিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত শেয়ার ও বন্ডে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। যদিও এর একটি অংশ সংরক্ষিত মূলধন হিসেবে রাখা হয়েছে, মূল উদ্দেশ্য ছিল মুনাফা অর্জন।

বুকিং ডটকম এবং এয়ারবিএনবিও ইসরায়েলি দখলকৃত ভূখণ্ডে বাড়ি ও হোটেল ভাড়া দিয়ে লাভ করে যাচ্ছে।

এয়ারবিএনবি ২০১৮ সালে অবৈধ বসতিতে থাকা কিছু সম্পত্তি তাদের তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, তবে পরে আবার যুক্ত করে এবং জানায়, ওইসব সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা তারা মানবিক কাজে দান করবে। প্রতিবেদনে এই কৌশলকে বলা হয়েছে ‘হিউম্যানিটারিয়ান ওয়াশিং’ অর্থাৎ মানবিক কাজের ছদ্মাবরণে মুনাফার বৈধতা দেওয়া।

করপোরেট দায়বদ্ধতা
ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও গাজায় যুদ্ধ একটি মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে, যেখানে বহু দেশি-বিদেশি কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে এবং সেইসঙ্গে ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

আলবানিজের প্রতিবেদনের মতে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দায়বদ্ধ। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বাধ্যবাধকতা রয়েছে যেন তারা সরাসরি বা তাদের ব্যবসায়িক অংশীদারদের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে।

রাষ্ট্রগুলো এই দায়িত্ব বহনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে অর্থাৎ তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, করপোরেট সংস্থাগুলো মানবাধিকার সম্মান করে এবং যদি বেসরকারি কোনো পক্ষ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তবে তা প্রতিরোধ, তদন্ত এবং শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে শুধু রাষ্ট্রের দায়ই নয়, বরং যে দেশে কোম্পানিটি পরিচালিত হচ্ছে সেই রাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষা না করলেও কোম্পানির নিজস্বভাবে মানবাধিকার রক্ষা করার নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানিকে অবশ্যই তাদের সম্পূর্ণ সাপ্লাই চেইনে (সরবরাহ শৃঙ্খলে) এমন কর্মকাণ্ড বা অংশীদারিত্ব রয়েছে কি না, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বা সেই লঙ্ঘনে অবদান রাখতে পারে, তা মূল্যায়ন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হলে করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ফৌজদারি দায় নিতে হতে পারে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ব্যক্তিরাও ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হতে পারেন, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখিও হতে পারেন।

প্রতিবেদনটি কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কার্যক্রম থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে, কারণ এই দখল আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত একটি পরামর্শমূলক মতামত দিয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে তাদের অবস্থান যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা উচিত। 

এই মতামতের ভিত্তিতে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দাবি করেছে যে, ইসরায়েলকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল থেকে তাদের অবৈধ উপস্থিতি প্রত্যাহার করতে হবে।

আলবানিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই রায় অনুযায়ী ইসরায়েলের এই দখল এখন কার্যত একটি ‘আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে যেকোনো কোম্পানি বা পক্ষ যদি এই দখলদারিত্ব এবং তার প্রশাসনিক কাঠামোকে সমর্থন বা চালু রাখার জন্য সহায়তা করে, তবে তা রোম সংবিধির আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধে সহযোগিতার শামিল হতে পারে। 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রগুলো কোনোভাবেই এই অবৈধ পরিস্থিতিকে বজায় রাখার জন্য সহায়তা বা সহযোগিতা দিতে পারে না। তারা ইসরায়েলের তৈরি করা এই অবৈধ অবস্থা বজায় রাখতে সহায়ক বাণিজ্যিক বা বিনিয়োগমূলক সম্পর্ক প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য।”

ঢাকা/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসলে দখলদারিত্ব, চাদাঁবাজি থাকবেনা : মাওলানা মঈনুদ্দিন  
  • ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
  • পুরনো সিস্টেম ও দখলদারিত্ব ফিরে আসার চেষ্টা চলছে : নাহিদ  
  • গাজায় ‘গণহত্যার অর্থনীতিতে’ লাভবান মাইক্রোসফট-অ্যামাজনসহ আরো যারা