বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ
Published: 23rd, May 2025 GMT
নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের সম্মেলন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে প্ল্যাটফর্মটি। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনী বিধিমালা তৈরি করে প্রার্থিতা আহ্বান করবে।
আজ শুক্রবার বেলা তিনটার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমন এক সময়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে, যখন প্ল্যাটফর্মটির পরিচয় ব্যবহার করে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসন্ন সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন লুৎফর রহমান। আর কমিশনার হিসেবে থাকবেন ওয়াহিদুজ্জামান ও মোহাম্মদ রাকিব। নবগঠিত এই কমিশন অবিলম্বেই নির্বাচনী বিধিমালা প্রস্তুত করে প্রার্থিতা আহ্বান করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া লুৎফর রহমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। বর্তমানে তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন দল ও মতের শিক্ষার্থীরা সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন।
অভ্যুত্থানের প্রায় তিন মাসের মাথায় ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ সদস্যের সমন্বয়ক টিম বিলুপ্ত করে চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। হাসনাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক, আরিফ সোহেলকে সদস্যসচিব, উমামা ফাতেমাকে মুখপাত্র ও আবদুল হান্নান মাসউদকে মুখ্য সংগঠক করা হয়। উমামা ছাড়া বাকি তিনজনই এখন এনসিপির নেতা। শুধু তাঁরাই নন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বড় অংশই নতুন দলটিতে যোগ দিয়েছেন।
গত বছরের জুলাইয়ে যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়, তখন এর উদ্যোক্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, আন্দোলন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু পরে একটি অংশের উদ্যোগে এই প্ল্যাটফর্ম পুনর্গঠন করা হয়। এ নিয়ে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে সমালোচনাও করেছে।
আরও পড়ুনসবাইকে একত্র করতে পেরেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন০৭ নভেম্বর ২০২৪তবে যেদিন প্ল্যাটফর্মটির পুনর্গঠন করা হয়, ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের দাবি করেন, আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এই ব্যানার ফ্যাসিবাদের পতন ত্বরান্বিত করেছে। দেশের মানুষ মনে করে, এই ব্যানারের কার্যক্রম এখানেই শেষ হওয়ার সুযোগ নেই।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম সমন বয়ক গঠন কর সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
হাজার কোটি ব্যয়েও ফেরেনি নাব্য, উল্টো গতিপথ বদল
নাব্য সংকটে ধুঁকতে থাকা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে ২০১৯ সালে খনন শুরু করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ছয় বছরের খননে পানিপ্রবাহ তো বাড়ানো যায়নি, উল্টো অন্তত তিন স্থানে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে নদের গতিপথ। কোথাও অপরিকল্পিতভাবে নদের মধ্যেই ড্রেজিংয়ের বালু ফেলে, আবার কোথাও জমি দখল করার জন্য মূল প্রবাহ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে নদীভাঙনে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারিয়েছে শত শত মানুষ।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত ব্রহ্মপুত্রের সাবেক ধারাটি গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ হয়ে ভৈরবে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। উজানে এটি সংযুক্ত যমুনা নদীর সঙ্গে। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ২২৭ কিলোমিটার এলাকাই খননের দায়িত্বে রয়েছে তারা। প্রকল্প এলাকায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার পরপর বসানো হয়েছে ৯৬টি ড্রেজার মেশিন। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলায় ৯০ কিলোমিটার এলাকায় খনন চলছে। ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোয় প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৭ সালে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, নদের সর্বনাশের পাশাপাশি প্রকল্পটির নামে চলছে সরকারি অর্থ লুটপাটের মচ্ছব। যত্রতত্র বালু উত্তোলন করায় বিভিন্ন স্থানে বর্ষায় দেখা দিচ্ছে নদীভাঙন। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় চলছে বালু লুটপাট।
সরেজমিন দেখা যায়, গত ছয় বছরে নদের খনন করা স্থানের অনেকটিতে ফের চর জেগেছে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া সব স্থান দিয়ে নৌকা চলে না। পানির প্রবাহ না বাড়ায় ড্রেজিংয়ের পর অনেক স্থানে নদীটি পরিণত হয়েছে সরু খালে। গৃহপালিত পশুর পাশাপাশি মানুষও হেঁটে পারাপার হচ্ছে। এ ছাড়া খনন করা বালু ফেলা হচ্ছে নদের ধারেই। এতে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদেই ফেরত যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করলেও তারা সুফল পাচ্ছেন না।
অথচ প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, খনন শেষ হলে নদে শুষ্ক মৌসুমেও ১০ মিটার পানির প্রবাহ থাকবে। প্রশস্ত হবে ৩০০ মিটার। চলবে জাহাজ। আন্তর্জাতিক নৌরুট হিসেবেও এটি ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া উন্নয়ন ঘটবে মৎস্যসম্পদের। এতে বদলে যাবে নদের দুই পাড়ের মানুষের জীবনধারা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকায় বছরের পর বছর খনন চললেও নাব্য সংকট কাটেনি। উল্টো পুরোনো গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ায় নদীতে গেছে অনেকের বাড়িঘর ও ফসলি জমি।
জামালপুর শহরের মেডিকেল রোড এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা ইউ প্যাটার্নে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঘুরিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজম। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পাঁচবারের এ সংসদ সদস্য এরপর ভরাট করা স্থানে তৈরি করেছেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
গফরগাঁও উপজেলায় মূল নদ ভরাট করে প্রায় দুই কিলোমিটার দূর দিয়ে নতুন গতিপথ তৈরি করিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল। এখানেও উদ্দেশ্য ছিল একটিই– জমি দখল। মূলধারা সরিয়ে দেওয়ায় এ এলাকায়ও কয়েকশ মানুষ হারিয়েছে বাড়িঘর। নদীতে গেছে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি।
স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব আবদুস সাত্তার বলেন, এখনকার নদের জায়গায় আগে আমরা ফসল ফলাতাম। এখন নদে সরে সেই জমি নেই হয়ে গেছে। এতে আমাদের আয়-রোজগার কমে গেছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা নামাপাড়ায় মূল গতিপথে বালু ভরাট করায় তিনটি উপধারা তৈরি হয়েছে। প্রবাহ প্রায় ছয় কিলোমিটার সরে উচাখিলা, নামাপাড়া ও মরিচার চর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শতাধিক বাড়িঘর নদে বিলীন হওয়ার পাশাপাশি ফসলি মাঠ হারিয়েছেন অনেকে।
এদিকে, ময়মনসিংহ শহরের ভেতর দিয়ে অনেক স্থানে ব্রহ্মপুত্র প্রশস্ত ছিল এক কিলোমিটার পর্যন্ত। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ে প্রশস্ততা কমে ৫০ থেকে ১০০ মিটারের সরু খালে পরিণত হয়েছে। আবার খননের বালু নদের ধারে রাখার কারণে অনেক খাল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিভিন্ন স্থানে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
ময়মনসিংহ নগরীর কাচারিঘাট এলাকায় প্রায় ৪০ বছর ধরে নৌকা চালান আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ড্রেজিংয়ের নামে তামাশা করছে সরকার। এক জায়গায় সারাবছর মেশিন বসিয়ে তারা বালু বিক্রি করে। অথচ নদীর অন্য অংশে নৌকা চালানো যায় না। হেঁটেই নদ পারাপার হয় সবাই।
গৌরীপুর উপজেলার বাসিন্দা সগীর আলী বলেন, আমাদের বাপদাদারা এই নদকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় অনেক বড় মাছ ধরা পড়ত। ছোটবেলায় শুনেছি, বড় বড় নৌকা ও ট্রলার চলত। এখন বর্ষাকাল ছাড়া পানিই পাওয়া যায় না।
ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, খননের নামে ব্রহ্মপুত্রসহ নির্ভরশীল শত শত নদী ও খালকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের একাধিক ধারা বন্ধ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ডিসি মুফিদুল আলম বলেন, বিভিন্ন জায়গায় উত্তোলিত বালু সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এতে কিছু অসাধু চক্র চুরি করে বালু নিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর বিআইডব্লিউটিএর খনন ঠিকভাবে চলছে কিনা, এটি তাদের প্রকৌশলীরা ভালো বলতে পারবেন।
বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, এ প্রকল্পের অধীন চারটি নদীর খনন করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষের দাবি, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগমুখে ড্রেজিং করতে না পারায় প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ওই স্থানে ৩৬টি ড্রেজার মেশিন থাকলেও স্থানীয়দের বাধায় কার্যক্রম চালাতে পারছে না তারা। নদীভাঙনের অভিযোগ তুলে একাধিক ড্রেজার মেশিন পুড়িয়েও দিয়েছে তারা।
বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মহসিন মিয়া বলেন, করোনা মহামারিতে লকডাউন, অর্থপ্রাপ্তিতে ধীরগতি, নদের সীমানা নিয়ে জটিলতা, বালু রাখা নিয়ে সমস্যা, যমুনায় সংযোগমুখে খননকাজে স্থানীয়দের বাধা– এসব কারণে প্রকল্পটির কাজ ধীরগতিতে চলছে। আর বিআইডব্লিউটিএর কাজ শুধু ড্রেজিং করা। বালু বিক্রির দায়িত্ব জেলা কমিটির। এ নিয়ে ডিসির নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মেসবাহুল আলম বলেন, নদের গতিপথ পরিবর্তন হলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।