গত বছর আমার জন্মদিনে একটি ড্রোন উপহার পেয়ে আমি খুবই উৎসাহিত হই। আকাশে উড়িয়ে আমার বাড়ির পেছনের বাগানটা কেমন দেখায়, তা দেখার জন্য যেন তর সইছিল না। যাঁরা ড্রোন ব্যবহার করেন, তাঁরা একটা বিষয় জানেন। খুব দ্রুতই আমি সেই কঠিন সত্যি জানলাম, ড্রোন ওড়ানো আসলে সহজ কোনো কাজ নয়। এর জন্য প্রচুর অনুশীলন ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়।

সেই ড্রোন হয়তো আবার বের করার সময় এসেছে। গত মাসে ভারতে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি প্রশিক্ষণ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দিল্লি সফরের সময়, আমি সঙ্গীতা দেবী, সুমিত্রা দেবী ও কাজল কুমারী নামের তিনজন ড্রোন দিদির সঙ্গে দেখা করি। যাঁরা ভারতের বিহারের কৃষি উৎপাদনশীলতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

আমি যে নারীদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাঁরা ভারত সরকারের নমো ‘ড্রোন দিদি’ কর্মসূচিতে যুক্ত। দিদি হিন্দি শব্দ, যার অর্থ বোন। গ্রামীণ নারীদের আয় বৃদ্ধি ও ভারতের কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ২০২৩ সালে এই কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, আমি এরই মধ্যে যার ফলে বেশ মুগ্ধ।

বর্তমানে ড্রোন দিদিরা প্রধানত ফসলে সার দেওয়ার জন্য ড্রোন ওড়ানোর দক্ষতা ব্যবহার করছেন। হাতে সার দেওয়ার চেয়ে ড্রোনের মাধ্যমে সার প্রয়োগের অনেক সুবিধা রয়েছে। যেহেতু আপনি গাছ থেকে আরও দূরে স্প্রে করতে পারেন, তাই তরল সার আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে সার আরও সূক্ষ্ম কণায় পরিণত হওয়ায় বৃহত্তর এলাকাজুড়ে ছড়ানো যায়। ড্রোনের মাধ্যমে সার ছড়ানোর কাজ কৃষক ও পরিবেশ—উভয়ের জন্যই উপকারী। এই পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে কম সার লাগে। আর কম পানির প্রয়োজন হয়। দ্রুত কাজ করা যায়। একজন ড্রোন দিদি একই সময়ে পাঁচজন অর্ধ-একর জমিতে যা করেন, ততক্ষণে পাঁচ একর জমিতে কাজ করতে পারছেন।

সামনের বছরে এই কাজ কতটা প্রসারিত হবে, তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। ভারত সরকার ড্রোনে উন্নত সেন্সর ও ইমেজিং প্রযুক্তি যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে ড্রোন দিদিরা কৃষকদের ফসলের গুণমান ও পরিমাণ উন্নত করার জন্য তাৎক্ষণিক তথ্য ব্যবহারের সুযোগ দেবে। এতে আরও কাজ করার সুযোগ বাড়বে। তাঁরা রোগ ও কীটপতঙ্গ শনাক্ত করতে, মাটির আর্দ্রতার স্তর মূল্যায়ন করতে, ফসলের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করাসহ অনেক কিছু করতে সক্ষমতা লাভ করবেন।

ড্রোন দিদি কার্যক্রম পুরো ভারতে নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করবে, তা জানতে আমি উৎসাহী। একেকজন দিদি একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কার্যক্রমে যুক্ত। আগামী বছরের শেষ নাগাদ সারা ভারতে এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৫ হাজার নারীকে ড্রোন সরবরাহ করা হবে।

আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে স্বনির্ভর গোষ্ঠী সাধারণত মানসিক স্বাস্থ্য–সংক্রান্ত কাজ করে। ভারতে এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে পারস্পরিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দল ছোট। বেশির ভাগ দল প্রায় ১২ জন নারী নিয়ে গঠিত। যদিও কিছু দলে ২৫ জন পর্যন্ত সদস্য থাকেন। সামাজিক ও আর্থিকভাবে একে অপরকে সমর্থন করার জন্য নারীদের একত্র করে। নারীরা তাঁদের সঞ্চয় একত্র করেন, কম সুদের হারে ক্ষুদ্রঋণ পান। নিজেরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করেন।

আমি যে দিদিদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাঁরা জীবিকা নামের দলের সদস্য দীর্ঘদিনের জন্য। বিহারের এই সংস্থা গ্রামীণ এলাকার মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে। দিল্লিতে দেখা করার সময় কাজল দিদি আমাকে তিন বছর আগে তাঁর দোকান খোলার গল্প বলেন। তিনি বীজ ও সার বিক্রি করেন। তিনি একজন উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলেন। যখন তাঁকে ড্রোন দিদি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন তিনি জানতেন ড্রোন তাঁর ব্যবসার জন্য দারুণ কাজ করবে।

একেকজন দিদি হায়দরাবাদ বা নয়ডায় প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশ নেন। তাঁদের ড্রোন চালানো ও কার্যকরভাবে সার প্রয়োগ করা শেখানো হয়। আমি শুনে অবাক হয়েছিলাম যে উড়তে শেখা সার প্রয়োগ করার চেয়ে সহজ। কম সময় লাগে! অন্য নারীদের ড্রোন টেকনিশিয়ান হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাঁরা নিজেরাই যেন যন্ত্র মেরামত করতে পারেন।

দুই বছরের কম সময়ে ড্রোন দিদি কর্মসূচিটি এরই মধ্যে নারী পাইলটদের জীবন পরিবর্তন করছে। কাজল দিদি তাঁর অতিরিক্ত আয় ব্যবহার করে দোকানের পণ্য প্রসারিত করছে। স্টক সংরক্ষণের জন্য একটি গুদাম তৈরি করছে। তিনি তাঁর সন্তানদের আরও ভালো স্কুলে পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। সঙ্গীতা দিদি ড্রোন দিদি হওয়ার আগে তাঁর পরিবারের জন্য একটি সাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিল না। এখন তিনি একটি অটোরিকশার গর্বিত মালিক।

সুমিত্রা দিদি আশা করেন, যখন মানুষ তাঁর মতো কাউকে বিশাল ড্রোন ওড়াতে দেখবেন, তখন নারীরা কী করতে পারেন বা সক্ষম, সে সম্পর্কে সমাজের ধারণার পরিবর্তন হবে। তাঁর এলাকার অনেক নারীর মতো, সুমিত্রার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সন্তানদের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে থাকার কথা ছিল। আজ তাঁর সন্তানেরা তাঁকে পাইলট মাম্মি বলে ডাকে। একদিন তাঁকে বিমান ওড়ানোর স্বপ্ন দেখে সন্তানেরা।

আশাকরি পরেরবার যখন আপনি কোনো বিয়ে বা পার্কে আপনার মাথার ওপর ড্রোনের গুঞ্জন শুনতে পাবেন, তখন দিদিদের কথা ভাববেন। এটি একটি অসাধারণ বিষয়। প্রযুক্তির একটি অংশ কীভাবে একটি সম্প্রদায়ের সম্ভাবনার রূপ পরিবর্তন করছে, তা দারুণ একটা বিষয়। কাজল দিদি আমাকে বলেছিলেন, লোকেরা মাঝেমধ্যে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘খুব উঁচুতে উড়ছ! এরপর কী করবে?’
কাজল দিদির উত্তর, ‘এটা তো সবে শুরু। অপেক্ষা করুন, আর দেখুন কী আসছে।’
সূত্র: গেটস নোটস
অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জল দ দ ব যবহ র ক জ কর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

স্তম্ভিত হারমানপ্রীত, আবেগ-রোমাঞ্চ-গর্ব-ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার

২০০৫ ও ২০১৭, ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে বিশ্বকাপের খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি। হারমানপ্রীত কৌররা লম্বা সেই অপেক্ষা দূর করলেন দুই হাজার পঁচিশে।

মুম্বাইয়ের নাভিতে প্রায় ষাট হাজার দর্শকের সামনে উচিুঁয়ে ধরলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৭ সালের ফাইনালেও খেলেছিলেন হারমানপ্রীত। রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এবার আর ভুল করলেন না। অধিনায়ক হয়ে জিতলেন শিরোপা। গড়লেন ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছবে না। কখনো জং ধরবে না।

ঝলমলে হাসিতে হারমানপ্রীত ট্রফি হাতে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। এবার তার আবেগের ধরণ ছিল ভিন্ন, যেন স্বপ্ন পূরণের মাখামাখি। লম্বা সংবাদ সম্মেলন জুড়ে বারবার তার কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগ, রোমাঞ্চ, গর্ব, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে একটি শব্দের ওপর বারবার ফিরে আসছিলেন তিনি, তা হলো আত্মবিশ্বাস,
‘‘আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি স্তম্ভিত, আমি বুঝতে পারছি না। আসলে, এতে উত্থান-পতন ছিল, কিন্তু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি প্রথম দিন থেকেই এটা বলে আসছি। আমরা বাম বা ডানে তাকাচ্ছিলাম না। আমরা কেবল আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েছিলাম।’’ - বলেছেন হারমানপ্রীত।

স্বপ্ন পূরণের রাতে হারমানপ্রীত কাছে পেয়েছিলেন সাবেক তিন ক্রিকেটার মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী এবং অঞ্জুম চোপড়াকে। প্রত‌্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর। তাদের অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জেমিমা, দীপ্তি, শেফালি, স্মৃতিরা।

শিরোপা উৎসবে যোগ দেন মিতালি, ঝুলন, আঞ্জুমরা। তাদের হাতেও ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাথে সেই মুহূর্তটি ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারমানপ্রীত বলেন, ‘‘ঝুলন দি আমার সবচেয়ে বড় আইডল ছিলেন। যখন আমি দলে যোগ দিই, তখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন খুব কাঁচা ছিলাম এবং ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, তখনও তিনি সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। অঞ্জুম দি-ও তাই। এই দুজন আমার জন্য দারুণ সমর্থন ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি তাদের সাথে এই বিশেষ মুহূর্তটি ভাগ করে নিতে পেরেছি। এটি খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আমার মনে হয় আমরা সবাই এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে, আমরা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পেরেছি।’’

তার জন‌্য বিশ্বকাপের পুরো অভিযানটিই ছিল গভীরভাবে আবেগপূর্ণ। রাউন্ড রবিন লিগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম‌্যাচ হার। চোট, অফ ফর্ম, জড়তা। সব সামলে সেরা হয়েছেন। তাইতো নিজেদের নিয়ে গর্বটাও বেশি হারমানপ্রীতদের, ‘‘আমরা প্রথম বল থেকেই অনুভব করেছিলাম যে আমরা জিততে পারি, কারণ শেষ তিন ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে খেলছিল, তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছিল, বিশেষ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা অনেকদিন ধরেই ভালো ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানতাম দল হিসেবে আমরা কী করতে পারি।”

"গত এক মাস খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই দিনটির (ইংল্যান্ডের কাছে হারের) পর আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই রাত আমাদের জন্য অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। এটি প্রত্যেকের উপর প্রভাব ফেলেছিল। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আরও প্রস্তুত হলাম। আমরা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। আমরা বারবার বলছিলাম, যে জন‌্য আমরা এখানে এসেছি এবং এবার আমাদের এটা করতেই হবে।" - যোগ করেন হারমানপ্রীত।

প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। রোমাঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা শব্দে বয়ান করা যায় না। বয়ান করা সম্ভব হয় না। হারমানপ্রীতও পারেন না নিজের সবটা উজার করে বলতে। তবে এই শিরোপায় তাদের নাম লিখা হবে সেই আত্মবিশ্বাস তারও ছিল, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে এটি নিয়ে কথা বলছি—আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আমাদের একটি বড় শিরোপা জিততেই হতো।"

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ