বোধশোধ জাগবার পরে মায়ের চেয়ে আব্বুকেই পেয়েছিলাম বেশি আপন করে। মায়ের হাতে সময় ছিল কম। চাচা-ফুফু সবাই এবং তারপরে আমাকে নিয়ে আধ ডজন সন্তানের সুবিশাল সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরে।

সংসারে বাবার কাজের মধ্যে, মাসের বাজারের ফর্দটি হাতে নিয়ে ‘হাট’ করে আনা। বস্তায় বস্তায় চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ; ওদিকে তেল, গুড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তা-ও কত দিন পথের মধ্যে কোথাও দাবার ছক পাতা দেখলে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে বিশ্বসংসার ভুলে গেছেন। অসময়ে অবেলায় শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে বেচারা-মুখ করে আম্মুর বকুনি শুনে অস্বস্তি ঢাকবার জন্য বারবার করে নাকের ঘাম মুছতে লেগেছেন।

সাইকেলখানা ছিল তাঁর জীবনের দীর্ঘকালীন সঙ্গী। পুরোনো দিনের মানুষেরা তাঁর সাইকেল-আরোহী রূপটিই দেখেছেন। মধ্যবয়স পার হয়ে অবসরজীবনে প্রবেশ করেও বহুদিন ওই সাইকেলই ছিল তাঁর বাহন। হাঁটতেও কোনো ক্লান্তি ছিল না, গ্রামের ছেলে যে! শুনেছি কয়েক ক্রোশ হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করেছেন অক্লেশে। স্বাস্থ্য ভালো ছিল, জোর ছিল গায়ে। কুস্তির অভ্যাসও ছিল, বলতেন ‘মালাম ধরতাম’। কাজেই শারীরিক কাঠামো একেবারে মজবুত।

বাড়ির কেলেকিষ্টি মেয়েটির দিকে তাঁর খুব নজর ছিল। পাছে রংচেহারা নিয়ে মনে কষ্ট পাই, তাই বেশি বেশি আদর দিতেন। মুখখানা মলিন দেখলেই কোলে তুলে জিজ্ঞেস করতেন—কী হয়েছে মা? ভাইবোনদের কেউ কিছু করেছে শুনলে জোর হাঁক দিতেন, ‘কে রে’! এই পর্যন্ত। মারধর করেছেন এমন স্মৃতি নেই ছেলেবেলার। আম্মু কড়া মানুষ। পাছে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই, তাই দুপুরবেলায় ছোট্ট চিমটে হাতে ধরিয়ে বলতেন, ‘খাড়া খাড়া পাকা চুলগুলো তোলো।’ ব্যস, বন্দী! নড়বার উপায় থাকত না।

আমাদের বাড়িতে ওস্তাদজি আসতেন সপ্তাহে দুদিন। বড় দিদি কিছু রাগ-রাগিণী আর গজল শিখতেন। তা ছাড়া রেকর্ড থেকে তুলতেন নানা গান। কিছু রবীন্দ্রসংগীত আর সন্তোষ সেনগুপ্তের গাওয়া আধুনিক গান। ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা/ মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’—বড় প্রিয় গান ছিল তাঁর।

বড়দির সূত্রে নজরুলের কথা এসে যায়। আমি তাঁকে বাড়িতে দেখিনি। কিন্তু বড়দির গলায় অজস্র নজরুলগীতি শুনেছি আশৈশব। আম্মু বলতেন, পাঁচ বছরের নাজুকে কোলে বসিয়ে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ গাইয়েছিলেন এক আসরে নজরুল ইসলাম। নজরুলকে আম্মু খুব ভয় পেতেন। বলতেন, ‘ওই বড় বড় চোখ, ওরে বাবা! গায়ের মধ্যে কাঁটা দেয়!’

আরও পড়ুনকালোত্তীর্ণ কাজী মোতাহার হোসেন০৯ অক্টোবর ২০২০

তখন আব্বুরা বর্ধমান হাউসে থাকেন। আমার জন্মই হয়নি। ত্রিশ-একত্রিশ সালের কথা বোধকরি। বর্ধমান হাউসটা ছিল ছাত্রাবাস। আব্বু ছিলেন ছাত্রদের তদারকিতে। পুরোনো বাড়িটার পূর্ব দিকটায় হাউস টিউটরের বাস। পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ঘরটায় ছিলেন নজরুল। সেটা ছিল আব্বু-আম্মুর শোবার ঘর। আম্মুকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে ওই ঘরটাতে আব্বু থাকতেন নজরুলের সঙ্গে।

আম্মুকে কিছুতেই নজরুলের সামনে বার করা যায় না। একদিন কায়দা করে আম্মুকে আব্বু নিয়ে এসেছেন বাইরের ঘরে, কিছুক্ষণ পরে নজরুল নিরীহ মুখে এসে ঢুকেছেন বাইরে থেকে। আম্মু একছুটে পালান আরকি। আব্বুও অমনি হাত চেপে ধরেছেন। নজরুল নাকি একবার চেয়ে দেখে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন। তারপরে আম্মু ছাড়া পেয়ে ভেতরে চলে যেতেই হা হা অট্টহাসি তাঁর। নজরুল এলেই আব্বুর ঘর থেকে আম্মুর নির্বাসন হতো বলে নজরুল আম্মুকে ‘সতিন’ বলতেন।

আমার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার আগে সেগুনবাগিচার বাড়িতেও নজরুল এসেছেন শুনেছি। এ বাড়িতে কবি জসীমউদ্দীনও আসতেন। ঢাকায় দিলীপ রায় এলে এ বাড়ি থেকেই বড়দিদের সাজিয়ে-গুজিয়ে গান শুনতে নিয়ে যেতেন আব্বু। একবার আমি, রীনা আর সেজদিও গিয়েছিলাম আবছা মনে পড়ে।

আব্বাসউদ্দীন সাহেব এসেছেন, মনে পড়ে। এসেছেন সেই জাদুকর গায়ক কে.

মল্লিক। তখন কিন্তু আব্বু ঠিকঠাক সৌজন্য করতেন সবার সঙ্গে। তারপরে যতই লেখাপড়া আর দাবাতে ডুবতে লাগলেন, ততই ভোলাভুলি বেড়ে চলল।

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম ম ক এস ছ ন নজর ল বলত ন

এছাড়াও পড়ুন:

গকসুর নবনির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ

গণ বিশ্বদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (গকসু) নবনির্বাচিত সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন।

বৃহস্পতিবার (০৯ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১৭ নম্বর কক্ষে এ শপথ পাঠ করান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও গকসু সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন।

আরো পড়ুন:

রাকসু নির্বাচন: ১৬ দফা ইশতেহার দিল গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ

চাকসু: ছাত্রদলের ৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার, নির্বাচন কমিশনের সদস্যবৃন্দসহ বিভিন্ন অনুষের ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও শিক্ষকগণ উপস্থিত ছিলেন।

শপথ শেষে নবনির্বাচিত সহ সভাপতি (ভিপি) মৃদুল দেওয়ান বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতির নয়, জবাবদিহিতার রাজনীতি করতে এসেছি। আমরা চাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপন করতে।”

নবনির্বাচিতদের উদ্দেশ্যে একে অপরকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে গকসু সভাপতি ও উপাচার্য ড. মো. আবুল হোসেন বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ মৃত্যুর আগে দ্রুত ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় আমরা নির্বাচন আয়োজন করতে পারিনি। তবে এখন করেছি। সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারায় নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয় গত ২৫ সেপ্টেম্বর। এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৪ হাজার ৬৭২ জন। ভোটগ্রহণের ৯ ঘণ্টা পর গণনা শেষে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচনে ভিপি পদে নয়জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে চারজন এবং এজিএস পদে তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া কোষাধ্যক্ষ পদে চারজন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে তিনজন, দপ্তর সম্পাদক পদে ছয়জন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে চারজন, সহক্রীড়া সম্পাদক পদে চারজন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে তিনজন, সহসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে দুজন, সমাজকল্যাণ ও ক্যান্টিন সম্পাদক পদে চারজন প্রার্থী হয়েছিলেন।

ঢাকা/সাব্বির/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ