মকদ্দস আলম উদাসীর মেহমানখানা কাম বেডরুম। আধো আলো, আধো অন্ধকার। সেখানে বসেই তিনি আমাদের কাছে ফেলে আসা জীবনের ঠিকুজি বাতলান। মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে, সম্ভবত সেদিন ছুটির দিন ছিল। আমরা সিএনজি অটোরিকশায় চেপে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কেশবপুরে তাঁর ডেরায় গিয়েছিলাম।

উদাসী ছিলেন বৈষ্ণবসাধক রাধারমণের পড়শি। তাঁর ডেরার খানিক দূরেই রাধারমণের সমাধিমন্দির। শাহ আবদুল করিম আর দুর্বিন শাহর পরবর্তী সময়ে সুনামগঞ্জে যে কয়েকজন সাধক-মহাজন আলো ছড়িয়েছেন, উদাসী তাঁদেরই একজন। জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মারা যান ২০২২ সালের ১৪ জুলাই।

সেই ছুটির দিনে উদাসীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিই। টানা চার ঘণ্টা! সেদিনের আলাপে বাউল, ফকির, সহজিয়া দর্শন এবং ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও চেনাজানা সাধক কবিদের নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। কীভাবে তিনি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গানের জগতে ঝুঁকে পড়লেন আর শ্মশান-কবরে রাত কাটাতে থাকলেন দিনের পর দিন, সে গল্পও শোনালেন। পাঁচ সন্তানের মৃত্যু আর ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে মর্মান্তিকভাবে স্ত্রীর মৃত্যুযন্ত্রণা তাঁকে ক্রমাগত বিচ্ছেদি করে তুলেছে বলেও জানালেন।

কতশত গল্প

কুশল বিনিময় আর অল্পবিস্তর বাতচিতের পর মকদ্দস আলম উদাসী ঘরে থাকা একটা লক্কড়ঝক্কড় বুকশেলফের কাচের দরজা খুলে কিছু পুরোনো বই আর ডায়েরি বের করেন। এর মধ্যে কয়েকটা পাণ্ডুলিপিও আছে। একটাতে লেখা তিনটি বাক্য: ‘উদাসী রচনা। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। ৩ খণ্ড একত্রে।’

বই, পাণ্ডুলিপি, ডায়েরি—সব এনে রাখেন চৌকিতে পেতে রাখা নতুন বিছানার চাদরের ওপর। তিনি নিজেও একসময় বিছানায় পদ্মাসন গেড়ে বসেন। কিছু বই তখন ঊরুতেও রাখলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ধন (অর্জন) নেই! তুচ্ছ, একেবারেই তুচ্ছ এক মানুষ আমি!’

প্রশ্ন করি উদাসীকে, ‘আপনার নামের শেষে উদাসী শব্দটা কবে থেকে লাগল?’

প্রশ্ন শুনে একটু হাসেন উদাসী। বলেন, ‘ইতা আমি ভালা পাই না। ওই যে মাইনষে শাহ লাগায়। শাহ অমুক আলী, শাহ তমুক আলী। আমি তো আমি-অই। আমি বাদশা না, আমি ফকির। তো, আমার ইতা লাগাইবার দরকার কিতা? আমি তো ওই মকদ্দস-অই। আমার ছোটবেলার নাম মকদ্দস আলী।’

উদাসী বলে চলেন, ‘মাদ্রাসাত যখন লেখাপড়া করি, এক নামে এক ক্লাসে পড়ি গেল দুইজন। উস্তাদে (শিক্ষক) কইলা, তোমার নামের পিছে লাগাও আলম। ওই মকদ্দস আলম। তান আছলা আমার আরবি শিক্ষক। ওউ তান নাম পাল্টাইল্লা। এরপর গানটান যখন শিখলাম, তখন কেউ ডাকে মকদ্দস ভাই, কেউ পাগল, কেউবা ভগল, আর কেউ কয় উদাসী। যার মনে যা আছে, তাই কয়। কউক (বলুক) না। যার যেটা ভালা লাগে, ডাকুক। তখন তো গান গাইতাম, বয়স কম, অঙ্গভঙ্গিমা আছিন ভালা। তখন মাইনষে কইত, থুরা (ছোট) বাইচ্ছাই গান গাইয়া তো উদাস করিলাইছে। পরে মাইনষের মুখ থাকি শুইনা দুর্বিন শাহও আমারে কইন উদাসী। অউ পড়ি গেল নাম উদাসী।’

‘কত সালের ঘটনা এটা?’

‘ধরুকউক্কা, আমার বয়স তখন বাইশ-তেইশ।’

‘আপনে তো তখন মাদ্রাসাত যান না?’

‘না, না। ই-সময় তো পড়া ছাড়ি দিছি। গানের জগতে ঢুকি গেছি।’

আপনার দুর্বিন শাহর সঙ্গে দেখা কবে?

‘তান সাথে আমার আষট্টিত (১৯৬৮ সাল) দেখা।’

জিজ্ঞাসা করি, ‘তিনি (দুর্বিন শাহ) তো মারা গেলেন ১৯৭৭ সালে। তার মানে ৯ বছর ওনার সঙ্গ করেছেন?’

উত্তরে মকদ্দস আলম উদাসী বলেন, ‘অয়, অয়। ৯ বছর সঙ্গ করছি। ই-সময় আমি, সাবুল মিয়া, আছর আলী, এরার সাথে গান গাই। আমার কোনো উস্তাদ নাই। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর অইছে তখন আমি গানের রাস্তাত। গান গাই, তো মাইনষে কয়, উস্তাদ কে? উস্তাদ নাই, তে পুঙ্গানি? এই রকম মাইনষে খোঁচা দিত। তো, তখন আমার দুর্বিন শাহর লগে দেখা অয়। সম্ভবত, তান তখন লন্ডন থাকি গানটান গাইয়া আইছইন। এই সময় তানের একটা বই বার (প্রকাশ) অইছে, প্রেমসাগর পল্লিগীতি চতুর্থ খণ্ড।’

উদাসী একনাগাড়ে বলে চলেন, ‘তো অউ বইয়ের (দুর্বিন শাহর বই) গান আমি গাইতাম। আর আমার টুকটাক গান গাইতাম। আমি যে গান লিখি, ধরা দিতাম না। আমি গানে কইতাম, পাগলে কয়। তো, দুর্বিন শাহ একদিন কইলা, এই পাগলের নাম কিতা? আবদুল নামে এক পাগল আছিন, তাইন কইলা, এই তো সে-ই (উদাসী) লেখে। অনেক পরে আমারে তান (দুর্বিন শাহ) কইলা, লেখালেখি যখন করো, ইতা রাইখো। কামও লাগবে নে একদিন।’

প্রশ্ন রাখি উদাসীর কাছে, ‘লেখালেখি কবে থেকে শুরু করেছেন?’

লেখালেখি তো করি মাদ্রাসার পড়া ছাড়ার পর থাকি-অউ। ছোটবেলা থাকি-অউ। আমি তো ছোটবেলা থাকি নাগরী জানি। ছোটবেলায় বাবা আমারে সিলেটি নাগরী (বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি) শিখাইছলা। আমার মায় নাগরী জানতা। নাগরীতে লিখা কিতাবগুলা যখন আমি পড়তাম, শিতালং শাহ, ভবানন্দ, শাহনূর—এঁরার অনেক নাগরী কিতাব আছিন (ছিল)। তাঁরার লেখা কিতাব পড়তাম। তো, আমার মায় ইতা অনেক সময় আত (হাত) থাকি নিতা গা, ভবানন্দর বই। কইতা, ‘ইতা হরিবংশ, যে পড়ে, সে হয় নির্বংশ।’ কইতা, ইতা পড়িছ না তুই। তো, আমি লুকাইয়া লুকাইয়া পড়তাম। পড়তাম আর মাঝেমধ্যে ইতা বাংলা করতাম। বাংলা কইরা আমি ইতা আমার মতো কইরা জোড়া দিয়া গাওয়ার চেষ্টা করতাম। অউ, নাগরী লেখতে লেখতে আমার নিজের লেখা আইলো। ছোটবেলায় লেখতাম ইতা টুকটাক। ওই গাঙে দিয়া লঞ্চ যাইত, লঞ্চ নিয়া লেখতাম। কচুপাতা নিয়া লেখতাম। ঢংঢাং করতাম আরকি!

একফাঁকে এক নারী একটি থালায় তেলে ভাজা বেশ কিছু পুলি পিঠা আর কয়েকটি বাটিতে নুডলস দিয়ে গেলেন। একটু পর কয়েকটি চায়ের কাপে করে সেই নারীই নিয়ে এলেন মিরিন্ডা বা ফানটা–জাতীয় পানীয়। পিঠা আর ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে বারকয়েক কাশলেন উদাসী, কফও ঝাড়লেন। কফ-কাশের ছাঁট আমার ডান হাতে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে তা মুছে উদাসী ভাইয়ের কথায় মনোযোগ দিই। তিনি বলে চলেন জীব, পরম আর মনের মানুষ নিয়ে নিগূঢ়তত্ত্ব-কথা।

সময় যায়, কথা চলে। একসময়ে জানা হয়ে যায় উদাসীর দুর্বিন শাহকে মুর্শিদ ধরা আর তাঁর কাছে দোতরাবাদন শেখার গল্প। এ সময়ই উদাসী জানান তাঁর দুই থেকে আড়াই হাজার গান লেখার প্রসঙ্গও। স্মৃতিচারণা করেন নেত্রকোনা-সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মালজোড়া গানের আসর ও প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়েও।

এক দমের নাই ভরসা

সাক্ষাৎকার পর্ব শেষে বাইরে বেরোই। তাঁর ডেরা লাগোয়া যে পাকা রাস্তা আছে, সেখানে আমরা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকি। রাস্তার দুই পাশে বাঁশঝাড়, কলা-নারকেল-সুপারিগাছ। সামান্য দূরে, রাস্তার ঠিক মাথার কোনায় একটা পাকা কবর। এমন পরিবেশে উদাসীকে গান গাইতে অনুরোধ করি। তিনি গাইলেন তাঁরই লেখা গান, ‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা।’

উদাসী গাইছেন আর বারবার হাঁপিয়ে উঠছিলেন, দু-একবার কাশলেনও। তীব্র শ্বাসকষ্ট চেপে তিনি অবলীলায় পুরো গান গাওয়া শেষ করলেন। কবরের সামনে নিজের গানের বই হাতে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে গান গাইতে থাকা উদাসী হাতের ইশারায় কবর দেখিয়ে গাইছিলেন—‘আসা-যাওয়া একা, কবরে একা থাকা/ তাই ভাবিয়া সোনার অঙ্গ নাশ।/ আমার সংসারের অংশ নিতে আপন বংশ/ ভাই বন্ধু করিয়াছে আশ॥’

সেদিন খালি গলায় গেয়েছিলেন মকদ্দস আলম উদাসী। মাথা দুলিয়ে হাত নাড়িয়ে সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরা সফেদ চুল-দাড়িওয়ালা উদাসীর কণ্ঠে একদলা বিরহ ভর করেছিল। তাঁর পাঞ্জাবির বুকপকেটে ছিল কলম আর চোখমুখে ছিল একরাশ ক্লান্তি। এ ক্লান্তি যে দ্রুতই চিরবিশ্রামে রূপ নেবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। সেদিন গানযাপন আর আড্ডা শেষে উদাসীর ডেরা থেকে আসার পর সিলেটে শেষবারের মতো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বইয়ের দোকান বাতিঘরে, পরে আমার অফিসে। এ ঘটনার কিছু পরে উদাসীর মুঠোফোন থেকে কোনো এক নারী কান্নারত কণ্ঠে সংবাদ দিয়েছিলেন, উদাসী দেহ রেখেছেন। সে সংবাদ পাওয়ার পর থেকে মকদ্দস আলম উদাসীর প্রসঙ্গ এলেই শুরুতে এ গান স্মৃতিতে প্রথম উঁকি দেয়। এ গান তরঙ্গ হয়ে ঢেউ তোলে বুকে। অগণিত না-বলা বাস্তবতা আর খেদ গানের শরীরে লেপটে আছে।

উদাসী কবরের পাশে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন:

‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা,

মিছামিছি দুই দিনের পরবাস।

না করলে সাধন মন, না হলো ভজন।

হইলে না বন্ধেরই দাস॥’

উদাসীর কণ্ঠে পরম বন্ধুর প্রতি আত্মনিবেদন ঝরে পড়ছিল। আর এ জগৎ-সংসার যে ‘দুই দিনের পরবাস’ তা-ও তাঁর কণ্ঠের আর্তিতেই অনুভব করা যায়। কিংবা তিনি যখন বলছিলেন, ‘আমার সংসারের অংশ নিতে আপন বংশ/ ভাই বন্ধু করিয়াছে আশ॥’ তখন বাস্তবতা এসে এক কঠিন সত্য উন্মোচন করে। এ দুটো পঙ্‌ক্তির কারণে কয়েকটি প্রশ্নও তাৎক্ষণিক সামনে এসে উঁকিঝুঁকি দেয়। তবে কি এ জন্যই উদাসী সব সময়ে বৈষয়িক ব্যাপার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন? এ কারণেই কি স্থানীয় প্রশাসন উদাসীকে দুবার জায়গাসহ ঘর তৈরি করে দিতে চাইলেও তিনি তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন? তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এটা অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে, স্বজন কিংবা বংশীয়-আত্মীয়রা সহায়-সম্পত্তির ভাগ বসাতে দ্বন্দ্ব-বিবাদ করতে পারেন। ফলে সংসারে বিষয়সম্পত্তি বাড়াতে তাঁর কোনো আগ্রহই ছিল না!

একই গানে উদাসী যখন বলে যান, ‘আহা রে দুনিয়া, দুদিনের মায়া/ কার লাগি কাটলে রে মন ঘোড়ারই ঘাস।/ হাওয়ার পাখি, দিবে যে দিন ফাঁকি/ কবরে পড়ে রইবে লাশ॥’, তখন মৃত্যুচিন্তা এসে ঠাঁই নেয়। জনমভর জীবন যাপন করতে যে খাটাখাটুনি মৃত্যুর পর যে এর কোনো মূল্যই নেই, তা-ও এসব পঙ্‌ক্তির পলে পলে অনুভূত হয়।

গানের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে উদাসীর কণ্ঠে আবেগের ঘনত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তিনি গাইছিলেন, ‘পাড়ি দিতে সাগর, মনেতে বড় ডর,/ অন্ধকারে চেয়ে দেখি কেউ নাই আশপাশ।/ মকদ্দস উদাসী, হাওয়ার পাখিরে ভালোবাসি/ গেলে পাখি ছাড়িব নিশ্বাস॥’

গান শেষে উদাসী বারকয়েক কাশলেন। এরপর তিনি হেঁটে চলেন সামনের পাকা সড়ক ধরে। আমিও তাঁর সঙ্গী হই। তিনি অনবরত কেশেই চলেছেন। সম্ভবত গলায় কাশ আটকে আছে। গলা ঝেড়ে থুতু ফেলে সেই কাশ ফেলার বৃথা চেষ্টাও করলেন দু-একবার। হাঁটতে হাঁটতেই মকদ্দস আলম উদাসীকে আবার গান গাইতে বললাম। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আবারও একই গানের পুনরাবৃত্তি করলেন। এবার আর বই দেখে নয়। এবার স্মৃতি আওড়েই গাইতে শুরু করলেন তিনি, ‘এক দমের নাই ভরসা, করো তুমি কার আশা.

..।’

গান শোনা হলে সিলেট থেকে নিয়ে আসা সিএনজি অটোরিকশাতে উঠে পড়ি। ততক্ষণে মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। সূর্যও হেলে পড়েছে। গ্রামের রাস্তা ধরে কয়েকজন মুসল্লি তসবিহ হাতে ধীরলয়ে হাঁটছেন। আগের রাতে ঘুম না হওয়ায় আমার চোখে ঝিমানি ভাব। আধো ঘুম, আধো ঝিমানি আসা চোখে ভাসছে সেই মেহমানখানা কাম বেডরুম, যেখানে বসা ধ্যানমগ্ন এক ঋষি বলে চলেছেন জীবন-জগৎ-সৃষ্টি-ধ্বংসের মর্মভেদ।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 

মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।

কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।

আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।

এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না

শুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।

২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।

বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।

এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?

যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।

তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।

এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

সম্পর্কিত নিবন্ধ