ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই মামলায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকেও দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো মামলার রায় হলো। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনাও পেলেন প্রথম সাজা।
বিচারপতি মো.
রায়ে বলা হয়েছে, বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন, ১৯৭৩-এর ১১(৪) ধারা অনুযায়ী তাদের সাজা দেওয়া হলো। আসামিদের এ কারাদণ্ড বিনাশ্রম এবং তারা যেদিন আত্মসমর্পণ করবেন বা গ্রেপ্তার হবেন, সেদিন থেকে কার্যকর হবে।
১৯৭৩-এর ১১(৪) ধারায় বলা হয়েছে, “ট্রাইব্যুনাল যে কোনো ব্যক্তিকে সাজা দিতে পারে, যদি সে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে অথবা অ্যাবিউজ (অপব্যবহার) করে অথবা এর কোনো আদেশ নির্দেশকে অবজ্ঞা অথবা কোনো পক্ষের মামলায় ‘প্রিজুডিস’ করা হলে সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ এক বছরের সাজা ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুটোই দিতে পারে।” এর আগে আদালত অবমাননার দায়ে ২০১৪ সালে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে ও ২০১৫ সালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাজা দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এখন তিনি সেখানেই আছেন। এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সারাদেশে দেড় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। অসংখ্য মামলায় শেখ হাসিনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ একাধিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেন, ‘২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়েছি।’ এই বক্তব্য প্রকাশের পর তিনি তা অস্বীকার করেননি কিংবা তাঁর দলের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতিও পাওয়া যায়নি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে, এটি তাঁর বক্তব্য। ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাঁর ওই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হুমকির পাশাপাশি বিচারকাজে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদেরও চরম হুমকি দেওয়া হয়েছে। এতে মামলার বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে ভীতি সঞ্চার হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, পুরো বিচার ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে রাখা হয়েছে।
যে প্রেক্ষাপটে সাজা
ভারতে থাকা শেখ হাসিনার সঙ্গে গাইবান্ধার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের টেলিসংলাপ গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অডিও ক্লিপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাই আমি ২২৭ জনকে হত্যা করার লাইসেন্স পেয়েছি।’ এ অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ার পর ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পরে সিআইডি ওই কথোপকথনের ফরেনসিক পরীক্ষা করে সত্যতা পাওয়ার কথা জানায়।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৩০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেন। এর পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে ১৫ মের মধ্যে অভিযুক্তদের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। তবে তারা জবাব না দেওয়ায় ২৫ মে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেদিনও আদালতে না আসায় আবার ৩ জুনের মধ্যে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। ওই দিন প্রসিকিউশনের তরফে বলা হয়েছিল, জাতীয় দুটি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত হননি বা কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে ব্যাখ্যা দেননি। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন।
এর পর ট্রাইব্যুনাল ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ শেখ হাসিনার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেন। পাশাপাশি এ মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য গত ১৯ জুন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। সেই ধারাবাহিকতায় শুনানি শেষে গতকাল শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানিতে যা হলো
গতকাল বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল বসেন। কার্যতালিকার ২ নম্বরে ছিল এ মামলার শুনানি। শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর শেখ হাসিনার সঙ্গে শাকিল আকন্দ বুলবুলের কথোপকথন পড়ে শোনান। আদালত অবমাননার পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এ কথোপকথন সিআইডিকে দিয়ে ফরেনসিক করানো হয়েছে। এটি এআই জেনারেটেড নয়, অর্থাৎ অডিওটির ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে– কণ্ঠস্বরটি শেখ হাসিনার। কথোপকথনের সংবাদটি গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, তাদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে তার ভুক্তভোগী বাদী, সাক্ষী ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ভয় দেখানো হয়েছে। তারা ভীতসন্ত্রস্ত্র। মামলার সাক্ষীরা এসব হুমকির কারণে ট্রাইব্যুনালে আসতে ভয় পাচ্ছেন। শেখ হাসিনার এ বক্তব্যে অত্যন্ত ডেসপারেট। কথোপকথনে তিনি বলেছেন, এক মাঘে শীত যায় না। যারা মামলা করেছে, তাদের কি বাড়িঘর নেই? সবকিছু আমাকে বলে দিতে হবে কেন? সবকিছু ধরে ধরে তালিকা করতে হবে। এ পর্যায়ে তাজুল বলেন, এখানে তিনটি থ্রেট (হত্যার হুমকি) দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এটা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করতে প্রসিকিউটর তানভীর জোহাকে গাইবান্ধায় পাঠানো হয়, তিনি সেখানে বুলবুলের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এর পর ওই প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালের সামনে এ বিষয়ক নথি উপস্থাপন করে কীভাবে কথোপকথন হয়েছে, এর বর্ণনা দেন।
পরে রাষ্ট্র নিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) আইনজীবী আমির হোসেনের বক্তব্য শোনেন ট্রাইব্যুনাল। আমির হোসেন বলেন, আদালত অবমাননার অভিযোগের অনেক নথিপত্র এখানে এসেছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা এখানে আসেননি। যতক্ষণ তারা সশরীরে এখানে না আসবেন, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।
এরপর ট্রাইব্যুনালের সামনে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান দাঁড়িয়ে বলেন, আসামিরা গ্রেপ্তার হননি বা ট্রাইব্যুনালের সামনে আসেননি। তাহলে স্টেট ডিফেন্স কেন নিয়োগ দেওয়া হলো– এ প্রশ্ন রাখেন তিনি। বিচারটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। আমরা সাধারণত বুঝি, আদালত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করাই অবমাননা। এটা তো প্রমাণ করতে হবে। থ্রেটের (হুমকি) কারণে আদালত অবমাননা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করেন, এ থ্রেটের কারণে বিচার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল পদক্ষেপ নিতে পারেন। এ পর্যায়ে তিনি আদালত অবমাননার বিষয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আদালতের নজির ট্রাইব্যুনালকে উপস্থাপন করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল তাঁর বক্তব্য শুনে বসিয়ে দেন।
ঘণ্টাব্যাপী চিফ প্রসিকিউটর, স্টেট ডিফেন্স ও অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য শুনে ট্রাইব্যুনাল পৌনে ১টায় রায় দেওয়া শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ের জন্য সময় নেন ৪৫ মিনিট। রায়ে শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি গাইবান্ধার বুলবুলকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর যা বললেন
রায়ের পর প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আজ আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করেছি। আমরা বলেছি, শেখ হাসিনার যে কথোপকথন, সেটা যে তাঁর তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, সবার যুক্তি এবং সিআইডির ফরেনসিক প্রতিবেদন বিচার বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, কথোপকথনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী, সাক্ষী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ যারা এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের হত্যা করা এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ ‘থ্রেট’ করেছেন।
শেখ হাসিনার পক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, এখনই মন্তব্য করা যাবে না। তবে আমার মক্কেলকে সাজা দেওয়ায় খুশি হতে পারিনি। পুরো রায় দেখে পরে প্রতিক্রিয়া জানাব। অ্যামিকাস কিউরি এ ওয়াই মশিউজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বার্গম্যান ও জাফরুল্লাহকেও সাজা দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল
২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর আদালত অবমাননার দায়ে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতীকী সাজা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দণ্ড দেন। দণ্ডের সঙ্গে বার্গম্যানের ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।
পরে আদালত অবমাননার দায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টার কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ২০১৫ সালের ১০ জুন এ আদেশ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে ট্রাইব্যুনালের জরিমানার রায়ের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ায় তাঁর এ সাজা দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে কোনো মামলায় বিচার হয়নি
বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নাইকো, ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র, মিগ-২৯, নভোথিয়েটার, ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) কেনাসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে ১৫টি মামলা হয়েছিল। তবে এর কোনোটিরই বিচার হয়নি। পরে উচ্চ আদালত শেখ হাসিনাকে এসব মামলা থেকে পর্যায়ক্রমে অব্যাহতি দেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র গম য ন ব ধ গ রস ত ব চ রপত আইনজ ব ত হয় ছ স আইড তদন ত সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।