সব সংকট অতি দ্রুত সমাধান করে চলতি বছরের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত ১০০ স্কুলে ই-লার্নিং চালুর নির্দেশ নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এক বৈঠকে এ নির্দেশ দেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এই তথ্য জানিয়েছে।

বৈঠকে পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও দুর্যোগবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম, খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুলগুলোতে ভার্চ্যুয়াল পড়াশোনা চালুর ক্ষেত্রে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেখানে দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ নেই এবং এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই এলাকায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব।

এ ক্ষেত্রে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুতের ঘাটতি নিরসন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ও স্টারলিংক পরিষেবা ব্যবহার করে সংকট মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর পাশাপাশি দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি মোকাবিলায় স্কুলের তালিকা করে সেসব স্কুলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগেরও পরামর্শ দেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রথমে ১০০টি স্কুলের তালিকা তৈরি করতে হবে, যেখানে ইন্টারনেট–বেজড স্কুল শুরুর ব্যবস্থা করতে হবে। কোন স্কুলে কিসের ঘাটতি—ইন্টারনেট সংযোগ, সরঞ্জাম ইত্যাদি কী কী লাগবে, সব তালিকা করে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করে দিতে হবে। চলতি বছরের মধ্যেই ক্লাস শুরু করতে হবে।

‘যেসব দক্ষ শিক্ষক শহরের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান, তাঁরাই অনলাইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছেলেমেয়েদের গণিত, বিজ্ঞান ও ইংলিশ পড়াবেন। তাহলে সেখানকার ছেলেমেয়েরাও আর পিছিয়ে থাকবে না। ভালো শিক্ষক ও পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা পেলে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে সেখান থেকে উঠে আসবে,’ বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

বৈঠকে পার্বত্য উপদেষ্টা তিন পার্বত্য উপজেলায় জীবন-জীবিকার মান উন্নত করা ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। প্রধান উপদেষ্টা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনার নির্দেশ দেন।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

বিসিএস নন-ক্যাডার পদের নিয়োগে কেন সংকট তৈরি হলো

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির ক্যাডার এবং কারিগরি বা পেশাগত পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে থাকে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে বড় নিয়োগ পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই পরীক্ষার চাহিদা ও আকর্ষণ গত দুই-আড়াই দশকে অনেকটা বেড়েছে। বিসিএস দিয়ে নিয়োগ পাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ আগেও ছিল; কিন্তু এখন রীতিমতো একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়!

বর্তমান প্রক্রিয়ায় আবেদনকারী প্রার্থীকে প্রথমে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এখান থেকে বিজ্ঞাপিত শূন্য পদের কয়েক গুণ প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম শতকরা ৫০ ভাগ নম্বরপ্রাপ্তদের ডাকা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য। তিন ধাপের পরীক্ষা পার হওয়ার পর নির্ধারিত ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি; কিন্তু এর বিপরীতে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পার হয়েও অসংখ্য প্রার্থী চাকরি পান না। তাঁদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে ২০১০ সালে নন-ক্যাডার বিশেষ বিধিমালা করা হয়।

এই বিধির ফলে এক বিসিএস দিয়েই প্রার্থীরা নবম গ্রেডের ক্যাডার এবং ৯ থেকে ১২তম গ্রেডের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পেতে থাকেন। সিদ্ধান্তটি চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে খুবই ইতিবাচক ছিল। কারণ, এতে তাঁদের আবেদনের খরচ এবং বারবার পরীক্ষা দেওয়ার ঝামেলা কমে যায়; কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে বেশিসংখ্যক চাহিদা না দেওয়ার কারণে ২৮তম থেকে ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রায় ১৯ হাজার প্রার্থী কোনো চাকরি পাননি। বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হয়েও পদের অভাবে চাকরি না পাওয়াটা প্রার্থীদের জন্য ছিল হতাশার। সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিবছরই হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। বিসিএস পরীক্ষা নিয়মিত হলে এবং ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা গেলে প্রার্থীদের অকারণ অপেক্ষা করতে হয় না

৩৪তম বিসিএস থেকে প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য হারে নন-ক্যাডার পদ পেতে থাকেন। ৩৪তম থেকে ৪১তম বিসিএস পর্যন্ত দুই হাজারের কাছাকাছি থেকে চার হাজারের বেশি প্রার্থী নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পান। যেমন ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডার থেকে ৩ হাজার ১৬৪ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর আগের ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী ছিলেন ৪ হাজার ৩২২ জন। কিন্তু ৪৩তম বিসিএসে এই সংখ্যা নেমে হয় ৬৪২। মূলত এখান থেকেই সংকটের শুরু।

৪৩তম বিসিএসের আগের পরীক্ষাগুলোতে প্রথমে ক্যাডার পদের ফল প্রকাশ করা হতো। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী নন-ক্যাডারের ফল দেওয়া হতো। এর দরুন বেশি সংখ্যক প্রার্থী চাকরির সুযোগ পেতেন। কিন্তু ২০২৩ সালের নন-ক্যাডার বিধিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের চূড়ান্ত ফল একসঙ্গে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার শূন্য পদ উল্লেখের নিয়মও যুক্ত হয়েছে। এর বিরোধিতা করে একদল প্রার্থী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এভাবে পদ উল্লেখের কারণে নির্ধারিত পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আগের নিয়মে তালিকায় থাকা বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীরা পরবর্তী বিসিএসের আগপর্যন্ত চাহিদামতো নিয়োগের সুযোগ পেতেন।

আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, ২০২৩-এর নন-ক্যাডার বিধি বাতিল করে আগের বিধি পুনর্বহাল করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার শূন্য পদ উল্লেখ না করে পদ তৈরির সুযোগ উন্মুক্ত রাখাই ভালো। স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থে ক্যাডারের ফলের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ কিন্তু পদস্বল্পতার কারণে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ না পাওয়া প্রার্থীদের মেধাভিত্তিক তালিকা আলাদা করে প্রকাশ করা যায়। তাহলে এখান থেকেই নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে।

একেকটি বিসিএসে লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে খুব সীমিতসংখ্যকই চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ পান। সর্বশেষ চূড়ান্ত ফল ঘোষিত ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন। এর মধ্য থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয় ১৫ হাজার ২২৯ প্রার্থীকে। লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ৯ হাজার ৮৪১ জন। শেষ পর্যন্ত চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন মাত্র ২ হাজার ৮০৫ জন। এভাবে প্রতিটি বিসিএসেই দেখা যায়, আবেদনকারী মোট প্রার্থীর বিপরীতে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ থেকে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রার্থী চাকরির সুযোগ পান।

পিএসসি ১২তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগ দিয়ে থাকে। ১৩তম থেকে ২০তম গ্রেডের নিয়োগ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। পিএসসির সাবেক কোনো কোনো সদস্য মনে করেন, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সরাসরি নিয়োগ কমিয়ে নন-ক্যাডার নিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। এর ফলে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের একটি অংশ ক্যাডার হতে না পারলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে চাকরির সুযোগ পাবেন। বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ-বাণিজ্য কমে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীরা বেশি হারে সুযোগ পাবেন এবং তাঁদের সময়, অর্থ ও পরিশ্রম কমবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনে ৪ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি পদ শূন্য আছে। তবে একসঙ্গে এত পদ পূরণ করা সম্ভব নয়, এমনকি তা উচিতও হবে না। কারণ, প্রতিবছরই হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। বিসিএস পরীক্ষা নিয়মিত হলে এবং ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা গেলে প্রার্থীদের অকারণ অপেক্ষা করতে হয় না।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিসিএস নন-ক্যাডার পদের নিয়োগে কেন সংকট তৈরি হলো