তজুমদ্দিনে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, কী ঘটেছিল সেদিন
Published: 2nd, July 2025 GMT
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় যে ঘরে স্বামীকে রাতভর নির্যাতনের পর তাঁর স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, সেই ঘর থেকে চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দ শোনার কথা জানিয়েছেন প্রতিবেশী নারীরা। তাঁরা ওই গৃহবধূকে বাঁচাতে ঘরের পাশে গেলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কিছু করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। বুধবার ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় লোকজন এ কথা বলেন।
গত সোমবার তজুমদ্দিন উপজেলায় শ্রমিক দল, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলায় রোববার সকালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়।
বুধবার সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে এক দোকানদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঘরটি দেখিয়ে দেন। এলাকাটা অনেকটা বস্তির মতো, জেলেপল্লি। এলাকার বেশির ভাগ পুরুষ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। সারা রাত মাছ ধরে বিক্রি করে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। ঘরটির মালিক মামলার বাদীর তৃতীয় স্ত্রী এবং মামলার ৩ নম্বর আসামি। পুলিশ ইতিমধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই ঘরের দক্ষিণে একটি পুকুর। পুকুরের পর আরও কয়েকটি ঘর।
সেখানে যেতে কয়েকজনকে নারীকে পাওয়া যায়। সেদিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে এক নারী বলেন, ‘রাইত্তা চিক্কোর–চেঁচামেচি হুনছি, আমরা আউগগাইনো।’ নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে আরেক নারী বলেন, ‘আমরা এক পাও আউগগাই যাই, দুই পাও পিছমিল গুরি আই, মাইয়া মাইনষের কান্দন হুনছি।’ সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হেসুম ১০টা-১১টা বাজে। বাড়ির বেডারা হেসুম এহোনো গঙোততেন আইয়েনো।’
আরও পড়ুনতজুমদ্দিনে স্বামীকে নির্যাতনের পর গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা৩০ জুন ২০২৫ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুই মা-ছেলেকে পাওয়া গেল। মা চুপ করে আছেন। ছেলে বলেন, ‘আমি নদীত আছিলাম। পরে মোবাইলে ছবি দেখছি।’ মা অনেকক্ষণ পরে বলেন, ‘আমরা দেখলে কিয়াত্তাম পাত্তাম। আমগো কি হেগো লগে লরোনের ক্ষ্যামতা আছে!’
ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী তজুমদ্দিন উপজেলার একটি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তবে তিনি ঢাকায় থাকেন। তিনি তিন বিয়ে করেছেন। ওই ব্যক্তি বলেন, কয়েক দিন আগে তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। গত শনিবার তৃতীয় স্ত্রী তাঁকে বাসায় ডেকে নেন। সেখানে রাতের বেলা উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, যুবদল কর্মী মো.
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, খবর পেয়ে রোববার সকালে তাঁর প্রথম স্ত্রী ঘটনাস্থলে আসেন। প্রথম স্ত্রীকে দেখে আবার রড-হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক পেটানো শুরু করেন। এ সময় প্রথম স্ত্রী হামলাকারীদের হাত-পা ধরে স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন। একপর্যায়ে তাঁরা চার লাখ টাকার বদলে এক লাখ টাকা চান। তখন প্রথম স্ত্রী তাঁর শ্বশুরকে ফোন করে টাকার জন্য বলেন। টাকা আসছে শুনে হামলাকারীরা প্রথম স্ত্রীকে ঘরে রেখে তাঁকে বাইরে নিয়ে যান। পরে সেখানে তাঁকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।
আরও পড়ুনভোলায় দলবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি ছাত্রদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার৮ ঘণ্টা আগেএ ঘটনার পর মামলার প্রধান আসামি উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদ উদ্দিনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। পরে তজুমদ্দিন ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. রাসেল ও যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন ওরফে সজীবকেও বহিষ্কার করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রধান আসামি ফরিদ উদ্দিন ও যুবদলের কর্মী মো. আলাউদ্দিন গা–ঢাকা দেন।
এদিকে তজুমদ্দিন উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে সদস্যসচিব ওমর আসাদকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁরা বলেন, রাতভর স্বামীকে নির্যাতন ও পরদিন সকালে তাঁর স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার সত্যতা আছে। তবে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রদলের নেতা মো. রাসেল ও জয়নাল আবেদীনকে বহিষ্কার করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিএনপির নেতা ওমর আসাদ বলেন, ‘কোনো তদন্ত ছাড়াই বহিষ্কার করে দিল। এটা ঠিক হয়নি।’
কথাবার্তার একপর্যায়ে ছাত্রদল নেতা মো. রাসেল সেখানে আসেন। ওই দিন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না দাবি করে বলেন, ‘যে রাসেলকে মামলার ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে, সে পলাতক। তার বাবার নাম নুরে আলম মিস্ত্রি। আমিও মো. রাসেল, আমার বাবার নাম মো. ইয়াসিন। আমি আসামি হলে শহরে ঘুরছি কীভাবে!’
তবে তজুমদ্দিন উপজেলা যুবদলের সভাপতি প্রার্থী জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদল নেতা রাসেল ও জয়নাল আবেদীনের নাম তো আমরা বলিনি। তাঁদের নাম বলেছেন বাদী ও তাঁর স্ত্রী। তাঁরা হয়তো ধর্ষণে অংশ নেননি। কিন্তু রাতভর নির্যাতনে অংশ নিয়েছেন।’
আরও পড়ুনতজুমদ্দিনে নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে বিএনপির দুই পক্ষের পৃথক মানববন্ধন, ইটপাটকেল নিক্ষেপ০১ জুলাই ২০২৫তজুমদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহব্বত খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুই রাসেলকে খুঁজছি। যাকে পাব, তাঁকেই বাদী ও তাঁর স্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। তাঁরা যাঁর কথা বলবেন, তাঁকে আসামি করা হবে।
পুলিশ জানায়, র্যাব মামলার ৫ নম্বর আসামি মো. মানিককে ইলিশা লঞ্চঘাট দিয়ে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করেছে। এ নিয়ে দুজন আসামি গ্রেপ্তার হলেন।
মামলার বাদী বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের খবরে তিনি খুশি। তবে প্রধান আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত তিনি শঙ্কায় আছেন। তাঁর স্ত্রী ও তিনি ঘর থেকে বের হতে পারছেন না।
ভোলার পুলিশ সুপার মো. শরীফুল হক বলেন, বাদীর পরিবারের কোনো শঙ্কা নেই। শঙ্কা থাকলে পুলিশকে জানাতে পারে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম স ত র ছ ত রদল র গ হবধ ক ন আস ম র আস ম য বদল
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াতের সঙ্গে জোট ও পিআরে একমত নুর
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৫৪ জন, যার মধ্যে কন্যাশিশু ও কিশোরী ২৬৯ জন এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারী ৮৫ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন, যার মধ্যে শিশু-কিশোরী ৬২ জন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮১৯ নারী ও ৭৩৬ শিশু ও কিশোরী।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বিবৃতিতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান তৈরি করে।
বিবৃতিতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানান, কেবল জুনে ১১৬ নারী ও ৮৭ জন কন্যাসহ ২০৩ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ৬৫ জনের মধ্যে কন্যাশিশু ৪৩ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৮ জন, এদের মধ্যে ৫ জন কন্যা। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে, যার মধ্যে ২ জন কন্যা। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ৭ কন্যাশিশু।
উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ৫ জন নারী ও কন্যা; যার মধ্যে ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ১৩ জন কন্যাসহ ৬৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ২ জন কন্যাসহ ১১ জনের মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ৩ নারী, যাদের মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। এসিডদগ্ধ হয়েছেন ১ জন নারী। ৩ জন নারী অগ্নিদগ্ধ (যার মধ্যে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে), যৌতুক নির্যাতনের শিকার ১ নারী এবং পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৬ কন্যাসহ ২২ জন। অপহরণ হয়েছে ২ কন্যা, সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ১ জন এবং বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে দুটি।
সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে নির্যাতনের শিকার ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশুর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪ কিশোরী। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৭ জনকে। যৌন নিপীড়নের শিকার ৫১ জন। ৩১ জনকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। ২১ নারী ও কন্যাশিশু পাচার হয়েছেন। একজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার। ৬১ কন্যাসহ হত্যার শিকার হয়েছে ৩২০ নারী ও কন্যাশিশু।
সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সমকালকে বলেন, এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। বিশেষ করে কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এটি সমাজের জন্য অ্যালার্মিং।
তিনি বলেন, ছয় মাসে হাজারের বেশি নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হলেও মহিলা মন্ত্রণালয় বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আছিয়া ধর্ষণ মামলায় তড়িঘড়ি করে বিচার হয়েছে, কিন্তু ভালো তদন্ত না হওয়ায় পরিবার সন্তুষ্ট নয়। এ ধরনের বিচারে দ্রুততা নয়, নির্ভুলতা জরুরি। তিনি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।