রুপালি পর্দার ঝলমলে আলোয় যখন দর্শকরা ‘ডিসুম ডিসুম’ ফাইট আর বহুতল ভবন বা বিশাল সেতু থেকে লাফানোর দৃশ্য দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন, তখন খুব কম মানুষই প্রশ্ন করেন, এই সাহসিকতার আসল নায়ক কে। পর্দায় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে তারকাদের দেখা যায়, আসলে তা ঝুঁকি নিয়ে বাস্তবায়ন করেন একজন স্টান্টম্যান। এসব দৃশ্যের প্রকৃত নায়ক নেপথ্যের এই মানুষগুলো।

রাজশাহীতে বহুল প্রতীক্ষিত ‘তাণ্ডব’ সিনেমার শুটিং সেটে ঘটে গেল এক বেদনাবিদূর ঘটনা। অভিজ্ঞ স্টান্টম্যান মনির হোসেন শুটিং চলাকালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই নীরব যোদ্ধার মৃত্যু যেন বাংলা সিনেমার স্টান্টম্যানদের দুঃখ-বেদনার চিত্রকে আরো একবার জনসমক্ষে টেনে আনল।

মনির হোসেন ছিলেন সেই মানুষ, যে দর্শকদের রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিতে গিয়ে পর্দার পেছনে নিজের জীবন বাজি রাখতেন। নায়করা বাঁচতেন, দর্শকরা উল্লাস করতেন, কিন্তু মনির হোসেনের মতো মানুষেরা থেকে যান নীরবে! তার মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নায়কদের সুরক্ষা দিতে গিয়ে প্রকৃত নায়কেরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

আরো পড়ুন:

উর্দু ভাষায় পাকিস্তানে মুক্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের ‘জংলি’

মেট গালার লাল গালিচায় হাঁটবেন শাহরুখ, উড়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে

এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, আরেক স্টান্টম্যান আমিনুলের জীবনযুদ্ধের গল্প। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় এসে তিনি ফাইট গ্রুপে কাজ শুরু করেন। সুঠাম দেহ আর সাহসিকতার কারণে দ্রুত হয়ে ওঠেন ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যের অপরিহার্য নাম। প্রায় ৪০-৫০টি সিনেমায় স্টান্টম্যান এবং আরো ৭০টি সিনেমায় ফাইট দৃশ্যে অভিনয় করেন। কিন্তু ২০১৪ সালে শাকিব খান প্রযোজিত ‘হিরো দ্য সুপার স্টার’ সিনেমার শুটিংয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হন। জাম্প দিতে গিয়ে ঘাড়ে আঘাত পান এবং সেখানেই তার জীবন থমকে যায়। হাসপাতালের বিল সেই সময় শাকিব খান দিলেও, এরপরের প্রতিদিনের ব্যয় আর জীবনযুদ্ধে আমিনুল একাই লড়েছেন। এফডিসির প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রয়ে যায়, আর বাচ্চার দুধ কেনার টাকাও জোগাড় করতে পারতেন না তিনি।

বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পে স্টান্টম্যানদের জন্য নিরাপত্তা বলতে গেলে নেই বললেই চলে! উন্নত বিশ্বে যেখানে তাদের ইনস্যুরেন্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, আমাদের দেশে এখনো এসবের ঘাটতি প্রকট। মনির হোসেন অসুস্থ হলেও কাউকে কিছু না বলে শুটিং চালিয়ে গেছেন। আর এটাই হয়তো তার জীবনের জন্য মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল।

এই সাহসী মানুষদের কাজের স্বীকৃতি বাংলা সিনেমায় নেই বললেই চলে। দর্শক যখন নায়কের অ্যাকশন দৃশ্যে উল্লসিত, তখন খুব কমজনই ভাবেন এই দৃশ্যের নেপথ্যে কারা ছিলেন। আজও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে স্টান্টম্যানদের জন্য কোনো আলাদা বিভাগ নেই। তাদের প্রতি এই অবজ্ঞা শুধু সামাজিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিকও।

অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। কোটি টাকা বাজেটের সিনেমায় যেখানে নায়ক-নায়িকারা ৩ লাখ থেকে কোটি টাকা পারিশ্রমিক পান, সেখানে একজন স্টান্টম্যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পান খুবই সামান্য পারিশ্রমিক। কাজও প্রতিদিন থাকে না, দুর্ঘটনা হলে সহায়তা তো দূরের কথা, অনেকে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে আছেন অর্থাভাবে। ঝলমলে আলোর পেছনে এই মানুষদের জীবন সত্যিই অন্ধকারে ঢাকা।

বাংলাদেশে এখনো কোনো পেশাদার স্টান্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। ফলে যারা এই পেশায় আসেন, তারা নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে হাতে-কলমে শেখেন। এই ঘাটতি তাদের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। মনিরের ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটা পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি সতর্কবার্তা। সময় এসেছে স্টান্টম্যানদের জন্য বাধ্যতামূলক ইনস্যুরেন্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার। পাশাপাশি, তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার চালু করা জরুরি।

এই নেপথ্যের নায়কেরা যদি নিরাপদ থাকেন, তবে রুপালি পর্দার ঝলক আরো দীপ্তিমান হবে। তাদের জন্য চাই নিরাপত্তা, সম্মান, চাই জীবনের নিশ্চয়তা। না হলে মনির হোসেনের রক্ত-ঘামে ভেজা মাটিতে আরো জীবন অনাদরে হারিয়ে যাবে। এখনই সময় নেপথ্যের নায়কদের সামনে আনার।

ঢাকা/শান্ত

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চলচ চ ত র স ট ন টম য ন মন র হ স ন দ র জন য র জ বন পর দ র ন পথ য র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

শিক্ষক নিয়োগে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্যের সুপারিশ সহ–উপাচার্যের ফেসবুকে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানের একটি ফেসবুক স্টোরি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একজন প্রার্থীর জন্য জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এক সংসদ সদস্যের (এমপি) সুপারিশের কাগজ স্টোরিতে আপলোড করা হলে এ আলোচনা শুরু হয়।

গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্টোরিটি আপলোড করা হয়। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে। স্টোরিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক পদে জন্য আজমীরা আরেফিন নামের একজন প্রার্থীর প্রবেশপত্রে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য মো. লতিফুর রহমানের সুপারিশ।

স্টোরিটি আপলোড হওয়ার কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান সেটি সরিয়ে ফেলেন। একটি স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমার ফেসবুক স্টোরিতে একজন আবেদনকারীর প্রবেশপত্র ভুলবশত এসে গেছে।...প্রতিদিনই অনেক আবেদনকারী বা তাঁদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সিভি-প্রবেশপত্র দিয়ে যায়। ...একজন আলামনাস (সাবেক এমপি) ফোন করে উনার এলাকার একজন আবেদনকারীর কথা বলেন। আমার অফিস এবং ফোনে এ রকম ডজনখানেক সুপারিশ আছে। তবে এগুলো কোনোভাবেই লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় প্রভাব ফেলে না। আশা করি বিষয়টি নিয়ে কেউ ভুল বুঝবেন না। ভুলবশত এই স্টোরির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।’

মো. লতিফুর রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর-৩ আসন থেকে দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। তিনি ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের পরপর দুবারের সভাপতি ছিলেন। পরে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

সুপারিশের বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মো. লতিফুর রহমান বলেন, চাকরিপ্রার্থীর প্রবেশপত্রে সুপারিশ করা হয়েছে, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে এটা সত্য যে ওই প্রার্থীর বিষয়ে সহ-উপাচার্যকে ফোনে সুপারিশ করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাঁকে (ফরিদ উদ্দিন খান) বলেছিলাম, বিগত দিনে ভাইভাগুলোতে অনেক বাজে চর্চা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে আমরা এটা চাই না। আপনি এই প্রার্থীর আবেদনপত্রটা দেখবেন। আবেদনকারীর বিভাগের ফলাফল অনেক ভালো।’

এ ঘটনার পর মেহেদী হাসান নামে একজন ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামের ফেসবুক গ্রুপে লিখেছেন, ‘শ্রদ্ধেয় স্যার, কারা কারা আপনার কাছে সুপারিশ করেছে? আপনি যদি সত্যিই অসৎ না হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে নিশ্চয়ই আপনার দ্বিধা থাকার কথা নয়। আর যদি সেটা প্রকাশ না করতে পারেন; তাহলে তার মানে এটাই দাঁড়ায়, আপনি নিজে দুর্নীতিবাজ এবং দুর্নীতিবাজদের পাহারাদার। আপনি বিশ্বাসঘাতক। পারলে সুপারিশদাতাদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করুন।’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল লিখেছেন, ‘চাকরি যদি জামায়াত নেতার রেফারেন্সেই দেন...সে ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার নাটক কেন? নাকি লিখিত পরীক্ষা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রার্থীকে নকআউট করার নিঞ্জা টেকনিক?’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক গোলাম কিবরিয়া মো. মেশকাত চৌধুরী লিখেছেন, ‘সুপারিশে আসা বাকি সমস্ত প্রবেশপত্র পোস্ট করার দাবি জানাচ্ছি। আমরা জানতে চাই কারা এইটারে বিশ্ববিদ্যালয় না ভাইভা দলীয় গোয়ালঘর বানাতে চায়।’

উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী মিথ্যাবাদী না মাননীয় উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব স্যার?’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার লেখেন, ‘কাল রাতে আমাদের প্রো-ভিসি মহোদয়ের ছেলে ছাগল–কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। গেমস খেলতে গিয়ে বাবার ফোন থেকে একজন জামায়াতপন্থী সাবেক সংসদ সদস্যের রেফারেন্সসহ প্রবেশপত্র স্টোরি দিয়ে ফেলে। স্যার ক্লারিফিকেশনে লিখলেন এমন অনেক রেফারেন্স ওনার হোয়াটসঅ্যাপ, মেইল বা সরাসরি আসে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনাদের কাছে রেফারেন্স দেওয়ার সাহস কেন পাবে?’

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে একটা পরিবর্তন এলেও আমাদের চিন্তাগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। সত্য কথা হচ্ছে, বিভিন্ন দপ্তরে সুপারিশ, তদবির এগুলো কোনো কিছুই বন্ধ হয়নি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাতকড়াসহ নৌকা থে‌কে হাওরে ঝাঁপ দি‌য়ে আওয়ামী লীগ নেতার পলায়ন
  • ছাত্রলীগে লুকিয়ে থাকা শিবিরকে বাঁচাতে সহায়তার ন্যারেটিভটি সম্পূর্ণ মিথ্যা: সাদিক কায়েম
  • পুটিয়ার ডাকবাংলো চত্বর থেকে মরদেহ উদ্ধার
  • কন্যা ফাতিমাকে নবীজির ৫ উপদেশ
  • ‘ঘাড়ে, বুকে, হাতে গরম কিছু এসে লাগল, লুটিয়ে পড়েছিলাম মাটিতে’
  • স্বাস্থ্যে সংস্কারের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না
  • ‘আমি যৌবনের পিছনে ছুটছি না, সত্যকে আলিঙ্গন করছি’
  • হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য দায়ী শেখ হাসিনা: ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষী
  • রাবি প্রোভিসির ফেসবুক স্টোরি, শিক্ষক নিয়োগে জামায়াত নেতার সুপারিশ
  • শিক্ষক নিয়োগে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্যের সুপারিশ সহ–উপাচার্যের ফেসবুকে