বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিকের তালিকা সংশোধনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ অদ্যাবধি আলোর মুখ না দেখিবার বিষয়টি শুধু দুঃখজনক নহে, বিস্ময়করও বটে। গত বৎসর অক্টোবর মাসের সূচনা সপ্তাহে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ জানাইয়াছিলেন, জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের ৪৩ শতাংশকেই ত্রুটিপূর্ণ বলা হইয়াছে। তাহারা উক্ত তালিকাসমূহ পর্যালোচনা করিবেন। ঐ মাসে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকও সমকালকে জানাইয়াছিলেন, যাচাই-বাছাই অন্তে তালিকা চূড়ান্ত করিয়াই নূতন তালিকা অনুযায়ী চলমান অর্থবৎসরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা প্রদান করা হইবে। কিন্তু, বাস্তব চিত্র ভিন্ন কিছু বলিতেছে। রবিবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাইতেছে, নূতন তালিকা প্রস্তুতির কথা বলিয়া বিলম্ব ঘটিলেও শেষাবধি তিন প্রান্তিকের ভাতাই ত্রুটিপূর্ণ তালিকা অনুযায়ী প্রদান করা হইয়াছে। ইহার ফলে একদিকে রাষ্ট্র যদ্রূপ তৈলাক্ত মস্তকে আরও তৈল সিঞ্চন করিল, তদ্রূপ রাষ্ট্রীয় সম্পদের কার্যত অপচয় হইল। সমাজে বিদ্যমান ধনবৈষম্যের অগ্নিতেও যে ইহা ঘৃত ঢালিয়াছে, বলাই বাহুল্য। 

অর্থ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়াছে, তালিকাভুক্ত অনেকেই অবসর ভাতা, দুস্থ ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা গ্রহণ করিতেছেন। ফলস্বরূপ, তাহাদের ভাগ্যে একাধিক রাষ্ট্রীয় ভাতা জুটিতেছে। অপরদিকে উপকারভোগী হইবার প্রকৃত যোগ্যতাধারীরা বঞ্চিতই থাকিতেছেন। প্রসংগত, অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন বলিতেছে, দেশের দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৫৪ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষার বেষ্টনী-বহির্ভূত। অপরদিকে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা গ্রহণকারী পরিবারগুলির ৬২ শতাংশ দরিদ্র নহে এবং কোনো ঝুঁকির মধ্যেই নাই। প্রতিবেদনমতে, এই সকল ত্রুটি দূরীভূত করা সম্ভব হইলে আরও অন্তত ১১ লক্ষ মানুষকে অতিদরিদ্র ও ২৫ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য হইতে বাহির করিয়া আনা সম্ভব হইত। 

আমরা জানি, বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করিয়া থাকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ ২৭ ধরনের ভাতা প্রদান করা হয়। যেই সকল জনগোষ্ঠীর এই সকল ভাতাপ্রাপ্তির কথা, তাহারা সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। শারীরিক-মানসিক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের অবস্থাও অনেকের নাই। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ভাতার পরিমাণ নগণ্য হইলেও উক্ত জনগোষ্ঠীসমূহের নিকট উহা অতি মহার্ঘ।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যভান্ডারে উপকারভোগীদের প্রায় ৫০ ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। তন্মধ্যে বয়স, বাৎসরিক আয়সহ অন্তত ১০টি তথ্য মাঠ পর্যায়ে যাচাই করার প্রয়োজন হইবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সদিচ্ছা থাকিলে তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে উক্ত তালিকা যাচাই করা সম্ভব।  কিন্তু অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়াছে, যেই নির্দেশনার ভিত্তিতে তালিকা যাচাই করা হইবে, উহাই অদ্যাবধি প্রস্তুত হয় নাই। এমনকি এই বৎসর উহা চূড়ান্ত হইবে কিনা, তাহাও অনিশ্চিত। এই অবস্থার জন্য অবশ্যই চিরাচরিত আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করা যায়। কিন্তু এই কার্যে সরকারের আন্তরিকতা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য।

বিগত সরকারসমূহের দলীয় পক্ষপাতকে প্রশ্রয় দিবার কারণে রাষ্ট্রীয় সম্পদে দরিদ্ররা তাহাদের ন্যায্য হিস্যা হইতে বঞ্চিত, তাহা আমরা জানি। এই কার্য সম্পাদনের অপরিহার্য মাধ্যম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষপাত ও দুর্নীতি এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য দায়ী– ইহাও অনস্বীকার্য। তাই দৃশ্যত দলীয় স্বার্থবিহীন অন্তর্বর্তী সরকারকেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগীর তালিকা ত্রুটিমুক্ত করিতে হইবে। সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় নাগরিক সমাজের সহিত সমন্বয়ের মাধ্যমে করিলে এখনও উক্ত কার্য স্বল্প সময়েই সম্পাদন সম্ভব।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দর দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মণিপুরে জমি ঘিরে সংঘাত, ‘ক্রসফায়ারে’ কুকি গ্রামপ্রধান নিহত

ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে কুকিদের সঙ্গে মেইতেই সম্প্রদায়ের সংঘাত আবার বাড়ছে। দক্ষিণ মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলার লাংচিয়াংমানবি নামের একটি গ্রামে পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ কুকিদের লাংচিয়াংমানবির গ্রামপ্রধানের স্ত্রী নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম হৈখোলহিং হাওকিপ।

মণিপুর পুলিশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তাদের ওপরে গুলি চালানো হলে তারা পাল্টা গুলি চালায়। এতে হাওকিপ নিহত হন।

কুকি-জো সম্প্রদায়ের বক্তব্য

তবে এই মুহূর্তে মণিপুরে আদিবাসীদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন ইন্ডিজিনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরাম (আইটিএলএফ) জানিয়েছে, হৈখোলহিং হাওকিপ গ্রামপ্রধানের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি নিজেই লাংচিয়াংমানবি গ্রামে কুকি-জো সম্প্রদায়ের প্রধান ছিলেন।

আইটিএলএফ বলছে, হাওকিপের একমাত্র অপরাধ, তিনি কুকি-জো সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকেই চূড়াচাঁদপুর জেলায় ‘ধর্মঘটের’ ডাক দিয়েছে আইটিএলএফ। কুকি-জো নাগরিক সংগঠন নামে আদিবাসীদের একটি সংগঠন ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে।

আইটিএলএফ বলেছে, এ জঘন্য কাজটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি আরেকটি লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করে হামলা। এটি কুকি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জাতিগত নির্মূলের পদ্ধতিগত একটি কৌশলে পরিণত হয়েছে৷ নিরাপত্তা বাহিনীকে এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করছে আইটিএলএফ।

কী কারণে সংঘাত

কুকি-জো ও মেইতেইরা পাশাপাশি বসবাস করে। ফলে তাদের বসবাস বা চাষের জমিও পাশাপাশি। ফলে জমি বা জমির সীমানা নিয়ে কুকি-জো ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। দুই জমির মধ্যবর্তী অঞ্চলকে এখন সীমান্তের মতো ‘বাফার জোন’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে যাতে জমি নিয়ে বিবাদ না হয়, তা মাথায় রেখে সরকারের তরফে এই ‘বাফার জোন’ তৈরি করা হয়েছিল।

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছে, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরে জমি নিয়ে এই ধরনের বিরোধের খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য ২০২৩ সালের মে মাসে যখন মেইতেইদের সঙ্গে কুকি-জোসহ অন্যান্য আদিবাসীর সংঘাত শুরু হয়, তখন জমি নিয়ে বিবাদের নানা ঘটনা ঘটেছিল। তখন সরকার দুই পক্ষকে আলাদা রাখতে ‘বাফার জোন’ তৈরি করে। ফলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরে জমি নিয়ে বিবাদ হয়নি।

গত এক সপ্তাহে অন্তত দুবার ফুবালা গ্রামে কৃষকদের মধ্যে জমির সীমানা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুন এক দফায় সংঘর্ষ হওয়ার পরে আবার হলো গতকাল, যার জেরে একজনের মৃত্যু হলো। এলাকায় উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে।

আইটিএলএফ গতকালের এ ঘটনার জন্য মেইতেইদের দায়ী করেছে। তারা বলেছে, মেইতেইরা ‘বাফার জোনে’ নিয়মিত আক্রমণ চালাচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে নিরাপত্তাবাহিনী জানে। কিন্তু তারা দুর্বল সম্প্রদায়কে সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণেই আরও একজনের প্রাণ গেল।

এই ‘বাফার জোনে’ সংঘাত দিয়েই গতকাল নতুন করে লড়াই শুরু হয়। মণিপুর পুলিশ গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিষ্ণুপুর জেলার ফুবালা গ্রামের চাষি নিংথৌজাম বীরেন সিংকে বেলা ৩টার দিকে একজন অজ্ঞাত ও সশস্ত্র দুষ্কৃতি বাম হাতে গুলি করে। তিনি ধানখেতে কাজ করার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। পরে তাঁকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ইম্ফলের আঞ্চলিক ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানানো হয়েছে।

পুলিশ দাবি করছে, এ ঘটনার জেরে গতকাল বিকেলে নিরাপত্তা বাহিনী লাংচিয়াংমানবি, হেইচাংলোক, ফুবালা গ্রামের পশ্চিমাঞ্চলে এবং তার আশপাশে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপরে ‘গুলি’ চালানো হলে তারা পাল্টা গুলি চালায়, যাতে হৈখোলহিং হাওকিপ নিহত হন।

হাওকিপের মরদেহ চূড়াচাঁদপুর জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। চূড়াচাঁদপুর কুকিপ্রধান জেলা। ফলে হাওকিপের মরদেহ নিয়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওই জেলাসহ মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

মেইতেই সম্প্রদায়ের অভিযোগ

মেইতেই সম্প্রদায়ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করছে।

মেইতেইরা বলছে, কুকি-জো সম্প্রদায়ের মানুষ ‘বাফার জোনে’ সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে, অথচ সব জেনেও সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী চুপচাপ রয়েছে। এই ঘটনার জেরে মেইতেইরা তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজধানী ইম্ফল এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আজ শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। গতকালের ঘটনার পরে তারা বিষ্ণুপুর এবং চূড়াচাঁদপুরের মধ্যবর্তী জাতীয় সড়কও দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এতে মেইতেই নিয়ন্ত্রিত ইম্ফল ও বিষ্ণুপুর এবং কুকি-জো নিয়ন্ত্রিত চূড়াচাঁদপুর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি বাহিনী মোতায়ন করা হয়েছে।

২০২৩ সালের মে মাস থেকে জাতিগত সহিংসতায় মণিপুরে ২৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ