কপালে ছোট্ট একরঙা টিপ, কানে দুল, গলায় চিকন চেইন আর হাতে দুই গোছা চুড়ি– এ সাজে তারা যেন সাহিত্যের পাতা পেরিয়ে বাস্তবের পর্দায় এসে দাঁড়ায়। কেউ বিভা, কেউ নন্দিনী, কেউবা হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি এ নারীরা সময়কে অতিক্রম করে আজও আমাদের সংস্কৃতির নান্দনিক প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন।

নন্দনের পাঠকদের জন্য আজ আমরা ফিরে তাকাই রবীন্দ্রনাথের তিনটি মাধ্যম– টেলিভিশন, মঞ্চ ও আলোকচিত্রে উঠে আসা তিন নারী চরিত্রের দিকে। বিভা এসেছেন টিভি নাটক ‘রবিবার’ থেকে, নন্দিনী মঞ্চনাটক ‘রক্তকরবী’ থেকে, আর হৈমন্তী উঠে এসেছেন একটি ফটোশুটের ভাবনায়। এ তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের তিন গুণী শিল্পী– জয়া আহসান, অপি করিম ও সাদিয়া ইসলাম মৌ। তাদের অভিনয়ে আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনারীর এক নতুন ভাষ্য। সাহিত্যের রূপ তারা প্রাণবন্ত করে তুলেছেন পর্দা, মঞ্চ ও ক্যামেরার লেন্সে। এ রূপান্তর সহজ নয়– প্রয়োজন পড়ে অনুভব, অভিজ্ঞতা ও গভীর পাঠের। আর সেই কাজটিই নিখুঁতভাবে করে দেখিয়েছেন এ তিন অভিনেত্রী।

বিভা: নীরব দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি
আলো-আঁধারির দোলাচলে জয়া আহসানের অভিনয়জীবন এগিয়েছে নিজের ছন্দে। তবে তাঁর সৃষ্টির অন্তরালে রয়েছেন এক নীরব প্রেরণা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি বরাবরই জয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। অভিনয়জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটক, গল্প ও কবিতার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নতুন প্রাণ দিয়েছেন সাহিত্যকে। টেলিভিশনের জন্য কাজ করার সময় তিনি ‘রবিবার’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত নাটকে ‘বিভা’ চরিত্রে অভিনয় করেন। আত্মত্যাগী, বিনয়ী কিন্তু দৃঢ়চেতা বিভার চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে জয়া বলেন, “বিভা অভীককে ভালোবাসে, কিন্তু কোনো সংকোচে জড়ায় না। সে জানে– তাদের ভালোবাসা ঠিক আছে, যে কোনো পরীক্ষায় তা টিকে থাকবে।” বৃষ্টিভেজা জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা বিভার চোখে থাকে বিস্ময় আর মনের গভীরে চলে ঢেউয়ের খেলা। সেই আবেগ, সেই দৃঢ়তা জয়া ফুটিয়ে তোলেন নিঃশব্দ অভিব্যক্তি, চোখের ভাষা আর সংযত ভঙ্গিমায়। নাটকটি প্রচারের পরই প্রশংসায় ভেসে যায় তাঁর অভিনয়। দর্শক-সমালোচক উভয়েই স্বীকার করেন, জয়া বিভার নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের সৌন্দর্য অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

নন্দিনী: আলোর প্রতীক এক বিদ্রোহিনী
“দেবতার সময়ের অভাব নেই, পূজার জন্য যুগ যুগান্তর অপেক্ষা করতে পারেন। মানুষের দুঃখ মানুষের নাগাল চায় যে, তার তো সময় অল্প।”– এই সংলাপ উচ্চারিত হয় নন্দিনীর কণ্ঠে, ‘রক্তকরবী’ নাটকে। নন্দিনী যেন নতুন জীবনের বার্তাবাহক, প্রেম ও প্রতিবাদের এক প্রতীক। অপি করিম এই চরিত্রে অভিনয় করে মঞ্চে এনেছেন সতেজতা, আবেগ আর অভ্যন্তরীণ আলো। অপি বলেন, ‘নন্দিনী’ আমার অভিনয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যতবার ‘রক্তকরবী’ পড়ি, মনে হয়, আমার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকার এখনও আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।” ২০০১ সালে প্রথমবার মঞ্চে ‘নন্দিনী’ হয়ে ওঠেন অপি। প্রথম প্রদর্শনী থেকেই দর্শকের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। অপির অভিনয়ে অতিনাটকীয়তা নেই; বরং ছিল সংযম, স্থিরতা ও গভীর আবেগ। চোখের চাহনি, মৃদু হাসি আর সংযত শরীরী ভাষায় তিনি তুলে ধরেন এক নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। নন্দিনী শুধু একটি নাট্যচরিত্র নয়– তিনি এক দার্শনিকতা, এক স্বর, এক প্রতিবাদ। অপির কণ্ঠে, চোখে ও উপস্থিতিতে সে প্রতিবাদ নতুন করে প্রতিধ্বনিত হয়।

হৈমন্তী: নীরবতার গভীর ভাষা
সাদিয়া ইসলাম মৌ সরাসরি ‘হৈমন্তী’ চরিত্রে অভিনয় না করলেও তাঁর উপস্থিতিতে বারবার যেন সেই ছায়া ফিরে আসে। বিজ্ঞাপন হোক কিংবা নাটক, যখন রবীন্দ্রনাথের কোনো পঙ্‌ক্তি তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তখন মনে হয় হৈমন্তী যেন সামনে দাঁড়িয়ে। মৌ বলেন, “রবীন্দ্রনাথের নারীরা অতিশয় নয়– তারা সংযত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং আত্মবিশ্বাসী। এ বৈশিষ্ট্যগুলোই বারবার আমাকে রবীন্দ্রনাথের কাছে টেনে আনে।” নৃত্যশিল্পী হিসেবে মৌ যে পরিচিতি গড়ে তুলেছেন, তাও রবীন্দ্রনারীর ঐতিহ্যবাহী রূপের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা তৈরি করেছে। অভিনয় ও নৃত্য, উভয়ের মেলবন্ধনে তিনি নির্মাণ করেছেন এক নান্দনিক সত্তা, যেখানে হৈমন্তীর প্রজ্ঞা ও সংযম অনুরণিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রবিবার’, ‘রক্তকরবী’ আর ‘হৈমন্তী’তে যে নারীদের রূপ ও দর্শন এঁকেছেন, তা আজ জয়া, অপি ও মৌয়ের শরীর ও অভিনয়ে বাস্তবের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা শুধু চরিত্র ধারণ করেননি, হয়ে উঠেছেন সেই নিঃশব্দ ভাষা– যা রবীন্দ্রচরিত্রের গভীরতা, ব্যথা ও সৌন্দর্যকে বহন করে। এ প্রয়াস শুধু অভিনয়ের নয়, ছিল এক সাহিত্যিক সাধনার অংশ; তাই তারা হয়ে উঠেছেন আমাদের সময়ের তিন রবীন্দ্রনারী– বিভা, নন্দিনী ও হৈমন্তী। 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জয় আহস ন নন দ ন চর ত র হ মন ত

এছাড়াও পড়ুন:

বিভা, নন্দিনী ও হৈমন্তীর গল্প

কপালে ছোট্ট একরঙা টিপ, কানে দুল, গলায় চিকন চেইন আর হাতে দুই গোছা চুড়ি– এ সাজে তারা যেন সাহিত্যের পাতা পেরিয়ে বাস্তবের পর্দায় এসে দাঁড়ায়। কেউ বিভা, কেউ নন্দিনী, কেউবা হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি এ নারীরা সময়কে অতিক্রম করে আজও আমাদের সংস্কৃতির নান্দনিক প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন।

নন্দনের পাঠকদের জন্য আজ আমরা ফিরে তাকাই রবীন্দ্রনাথের তিনটি মাধ্যম– টেলিভিশন, মঞ্চ ও আলোকচিত্রে উঠে আসা তিন নারী চরিত্রের দিকে। বিভা এসেছেন টিভি নাটক ‘রবিবার’ থেকে, নন্দিনী মঞ্চনাটক ‘রক্তকরবী’ থেকে, আর হৈমন্তী উঠে এসেছেন একটি ফটোশুটের ভাবনায়। এ তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের তিন গুণী শিল্পী– জয়া আহসান, অপি করিম ও সাদিয়া ইসলাম মৌ। তাদের অভিনয়ে আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনারীর এক নতুন ভাষ্য। সাহিত্যের রূপ তারা প্রাণবন্ত করে তুলেছেন পর্দা, মঞ্চ ও ক্যামেরার লেন্সে। এ রূপান্তর সহজ নয়– প্রয়োজন পড়ে অনুভব, অভিজ্ঞতা ও গভীর পাঠের। আর সেই কাজটিই নিখুঁতভাবে করে দেখিয়েছেন এ তিন অভিনেত্রী।

বিভা: নীরব দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি
আলো-আঁধারির দোলাচলে জয়া আহসানের অভিনয়জীবন এগিয়েছে নিজের ছন্দে। তবে তাঁর সৃষ্টির অন্তরালে রয়েছেন এক নীরব প্রেরণা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি বরাবরই জয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। অভিনয়জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটক, গল্প ও কবিতার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নতুন প্রাণ দিয়েছেন সাহিত্যকে। টেলিভিশনের জন্য কাজ করার সময় তিনি ‘রবিবার’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত নাটকে ‘বিভা’ চরিত্রে অভিনয় করেন। আত্মত্যাগী, বিনয়ী কিন্তু দৃঢ়চেতা বিভার চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে জয়া বলেন, “বিভা অভীককে ভালোবাসে, কিন্তু কোনো সংকোচে জড়ায় না। সে জানে– তাদের ভালোবাসা ঠিক আছে, যে কোনো পরীক্ষায় তা টিকে থাকবে।” বৃষ্টিভেজা জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা বিভার চোখে থাকে বিস্ময় আর মনের গভীরে চলে ঢেউয়ের খেলা। সেই আবেগ, সেই দৃঢ়তা জয়া ফুটিয়ে তোলেন নিঃশব্দ অভিব্যক্তি, চোখের ভাষা আর সংযত ভঙ্গিমায়। নাটকটি প্রচারের পরই প্রশংসায় ভেসে যায় তাঁর অভিনয়। দর্শক-সমালোচক উভয়েই স্বীকার করেন, জয়া বিভার নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের সৌন্দর্য অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

নন্দিনী: আলোর প্রতীক এক বিদ্রোহিনী
“দেবতার সময়ের অভাব নেই, পূজার জন্য যুগ যুগান্তর অপেক্ষা করতে পারেন। মানুষের দুঃখ মানুষের নাগাল চায় যে, তার তো সময় অল্প।”– এই সংলাপ উচ্চারিত হয় নন্দিনীর কণ্ঠে, ‘রক্তকরবী’ নাটকে। নন্দিনী যেন নতুন জীবনের বার্তাবাহক, প্রেম ও প্রতিবাদের এক প্রতীক। অপি করিম এই চরিত্রে অভিনয় করে মঞ্চে এনেছেন সতেজতা, আবেগ আর অভ্যন্তরীণ আলো। অপি বলেন, ‘নন্দিনী’ আমার অভিনয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যতবার ‘রক্তকরবী’ পড়ি, মনে হয়, আমার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকার এখনও আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।” ২০০১ সালে প্রথমবার মঞ্চে ‘নন্দিনী’ হয়ে ওঠেন অপি। প্রথম প্রদর্শনী থেকেই দর্শকের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। অপির অভিনয়ে অতিনাটকীয়তা নেই; বরং ছিল সংযম, স্থিরতা ও গভীর আবেগ। চোখের চাহনি, মৃদু হাসি আর সংযত শরীরী ভাষায় তিনি তুলে ধরেন এক নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। নন্দিনী শুধু একটি নাট্যচরিত্র নয়– তিনি এক দার্শনিকতা, এক স্বর, এক প্রতিবাদ। অপির কণ্ঠে, চোখে ও উপস্থিতিতে সে প্রতিবাদ নতুন করে প্রতিধ্বনিত হয়।

হৈমন্তী: নীরবতার গভীর ভাষা
সাদিয়া ইসলাম মৌ সরাসরি ‘হৈমন্তী’ চরিত্রে অভিনয় না করলেও তাঁর উপস্থিতিতে বারবার যেন সেই ছায়া ফিরে আসে। বিজ্ঞাপন হোক কিংবা নাটক, যখন রবীন্দ্রনাথের কোনো পঙ্‌ক্তি তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তখন মনে হয় হৈমন্তী যেন সামনে দাঁড়িয়ে। মৌ বলেন, “রবীন্দ্রনাথের নারীরা অতিশয় নয়– তারা সংযত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং আত্মবিশ্বাসী। এ বৈশিষ্ট্যগুলোই বারবার আমাকে রবীন্দ্রনাথের কাছে টেনে আনে।” নৃত্যশিল্পী হিসেবে মৌ যে পরিচিতি গড়ে তুলেছেন, তাও রবীন্দ্রনারীর ঐতিহ্যবাহী রূপের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা তৈরি করেছে। অভিনয় ও নৃত্য, উভয়ের মেলবন্ধনে তিনি নির্মাণ করেছেন এক নান্দনিক সত্তা, যেখানে হৈমন্তীর প্রজ্ঞা ও সংযম অনুরণিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রবিবার’, ‘রক্তকরবী’ আর ‘হৈমন্তী’তে যে নারীদের রূপ ও দর্শন এঁকেছেন, তা আজ জয়া, অপি ও মৌয়ের শরীর ও অভিনয়ে বাস্তবের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা শুধু চরিত্র ধারণ করেননি, হয়ে উঠেছেন সেই নিঃশব্দ ভাষা– যা রবীন্দ্রচরিত্রের গভীরতা, ব্যথা ও সৌন্দর্যকে বহন করে। এ প্রয়াস শুধু অভিনয়ের নয়, ছিল এক সাহিত্যিক সাধনার অংশ; তাই তারা হয়ে উঠেছেন আমাদের সময়ের তিন রবীন্দ্রনারী– বিভা, নন্দিনী ও হৈমন্তী। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ