এনআইডি সংশোধন নিয়ে হয়রানি কমেছে, দাবি ইসি সচিবের
Published: 2nd, July 2025 GMT
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের হয়রানি কমেছে বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেছেন, এনআইডি সংশোধন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণের ফলে এক্ষেত্রে নাগরিকদের ভোগান্তির মাত্রা কমেছে। আগামীতে হয়রানির এমন অভিযোগ থাকবে না বলেই আশা করা যায়।
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে এক ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব এসব কথা বলেন। এনআইডি সংশোধনে গৃহীত ক্র্যাশ প্রোগ্রামের ছয় মাসের অগ্রগতি তুলে ধরতে এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
ইসি সচিব বলেন, প্রতি মাসে নাগরিকদের এনআইডি সংশোধন নিয়ে আবেদনও কমে আসছে। ভোগান্তির মাত্রাও কমে এসেছে। আশা করি আগামীতে এনআইসি সেবা নিয়ে আর হয়রানির অভিযোগ থাকবে না।
তিনি জানান, চলতি বছরের শুরুতে ১ জানুয়ারিতে এনআইডি সংশোধনের অনিষ্পন্ন আবেদন ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৬টি। ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে নতুন আবেদন পড়ে ৬ লাখ ৫ হাজার ৫২০টি। সব মিলিয়ে ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৩৫৬টি আবেদনের মধ্যে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামে’ নিষ্পন্ন করা হয়েছে ৯ লাখ ৭ হাজার ৬৬২টি।
আখতার আহমেদ বলেন, প্রতি মাসে আগে যেখানে গড়ে এক লাখ করে আবেদন পড়ত, এখন তা কমে এসে প্রায় ৮০ হাজারে নেমেছে। বর্তমানে অনিষ্পন্ন আবেদন রয়েছে ৭৬ হাজার ৬৯৪টি।
এনআইডি সংশোধনকে ঘিরে বরাবরই নাগরিকদের নানা ধরনের হয়রানি ও দুর্ভোগের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান ইসির উদ্যোগে তা ধীরে ধীরে কমে আসছে।
এনআইডি আবেদনের ক্ষেত্রে সংশোধনের মাত্রা দেখে চারটি ক্যাটাগরি করে দিয়েছে ইসি সচিবালয়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পূরণ, দলিলাদি যথাযথ কিনা যাচাই, শুনানি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশোধন করে দেওয়া হয়।
২০২০ সাল থেকে ৫৪ লাখ ৭৬ হাজার ১১টি আবেদন হয়েছে। সেক্ষেত্রে চার ক্যাগাটরিতে আবেদন নিষ্পন্ন হয়েছে ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৪২০টি।
আখতার আহমেদ বলেন, আমার মনে হয়, নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তির মাত্রাটা কমেছে। ছয় মাসে তুলনামুলক আবেদনের সংখ্যাও কমেছে। আগামী কয়েক মাসে তা সন্তোষজন পযায়ে আসবে এবং হয়রানি অভিযোগগুলো আর হয়তো থাকবে না।
৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর নানা অভিযোগের ভিত্তিতে বেশ কিছু রাজনীতিবিদসহ অনেকের এনআইডি ‘লক’ রয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সচিব বলেন, ‘নানা কারণে এনআইডি লক করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে এনআইডির অপব্যবহার রোধে তা করা হয়। এমননি আমার টাও নাকি এনআইডি লক করা আছে। কারোর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তথ্য না নেওয়াই ভালো।’
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয় সহজে
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জেরিন আক্তারের জন্ম ১৯৯৬ সালে। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) ভুলবশত তাঁর নাম ছাপা হয়ে আসে জেরীনা বেগম, জন্ম সাল ১৯৯৯। এনআইডিতে নাম ও জন্ম সাল ভুল থাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন তিনি। ভুল সংশোধনীর জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুযায়ীজমা দেন জন্ম সনদ, বিয়ের সনদ, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আট মাসে নির্বাচন অফিসে অন্তত ১৫ বার ছোটাছুটিও করেছেন। তবু সংশোধন হয়নি তাঁর এনআইডি।
নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে গেলে তাঁকে নয়ছয় বুঝ দেওয়া হয়। এর মধ্যে নির্বাচন অফিস থেকে বের হতেই দালালের চক্করে পড়েন জেরিন। দালালরা জেরিনকে বলেন, ‘৭০ হাজার টাকার মতো খরচ করলে কয়েক দিনের মধ্যেই কার্ড হাতে পেয়ে যাবেন।’ তিন ধাপে প্রায় ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার চার দিনের মাথায় জেরিনের হাতে সংশোধিত পরিচয়পত্র তুলে দেয় তারা।
এনআইডি সংশোধনে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু জেরিনের নয়; তাঁর মতো আরও অনেক সেবাপ্রত্যাশী মাসের পর মাস ঘুরেও পাচ্ছেন না সংশোধিত পরিচয়পত্র। এসব কারণে এখন ভোগান্তির আরেক নাম চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিস। তবে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয়ে যায় সহজে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার প্রায় প্রতিটি নির্বাচন অফিসে চার থেকে পাঁচজন দালাল সক্রিয়। দালালের সঙ্গে সখ্য আছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা কার্যালয়ের সব পর্যায়ের কর্মকর্তার। স্থানীয়ভাবে ও নির্বাচন অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানের লোকজনও এ কাজে জড়িত। অনেক সময় দালালের সঙ্গে সেবাপ্রত্যাশীর পরিচয় করিয়ে দেন কম্পিউটারের দোকানি। এনআইডি সংশোধন করাতে মোটা অংকের ঘুষের টাকা চার থেকে পাঁচ ভাগে দিতে হয়। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেও ‘ঘুষ’ লেনদেন হয়। এর সঙ্গে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রায় এক বছর ঘুরেও বাবার নামের ছোট একটি সংশোধনী করতে পারেননি কর্নেলহাটের বাসিন্দা শিমুল কুমার। এনআইডিতে ‘ম’-এর স্থলে ‘শ’ বসাতেই গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছে তাঁকে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া নির্বাচন কর্মকর্তা আবেদন নাকচ করার পাশাপাশি অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন অফিসে একটি লিখিত অভিযোগও করেছেন শিমুল কুমার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অফিসে গিয়ে কয়েকবার দালালের খপ্পরে পড়েছি। ৫০ হাজার টাকা দিলে তিন দিনের মধ্যে এনআইডি সংশোধন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দালালরা।’ শিমুলের মতো এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ার কথা আরও বেশ কয়েক সেবাপ্রত্যাশী সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে দুদক-চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, ‘এনআইডি সংশোধনে ঘুষ আদায়, হয়রানি, দালালদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। একটা এনআইডি সংশোধনে কর্মকর্তারা দালালের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার ওপরে নিয়ে থাকেন। দুই প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দালালদের একটা সংযোগ আছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দুদকের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতা ছাড়া ঘুষ দিয়ে এনআইডি সংশোধন করা অসম্ভব। এই কাজে প্রধান অফিসের লোকজনও জড়িত।’
দালাল সক্রিয় থাকার কথা স্বীকার করে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এখানে দালালের উৎপাত ছিল। এটাকে ভাঙার চেষ্টা করায় অনেকে আমার পেছনে লেগেছিল। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ৩২ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। এখন সেটি অনেক কমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভেতরের কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা তো আছে। প্রতিটা উপজেলায়ও দালাল চক্র আছে।’
আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে চার ক্যাটেগরিতে প্রায় ৫৩ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। নির্বাচন কমিশন ৩০ জুনের মধ্যে সব সংশোধনী নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়ায় এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন কর্মকর্তারা। সরকারি বন্ধের দিনেও নিষ্পত্তির কাজ চলায় মাত্র দুই সপ্তাহে অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে, ইসি নির্দেশনা দেওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় গত ৬ মাসে সাড়ে ৪৫ হাজার আবেদন সংশোধন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সভায় এ তথ্য জানান সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমেদ।