হিজরি সনের শুরু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মদিনায় হিজরতের অসাধারণ ঘটনা, যা ইসলামের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত কেবল একটি ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়, বরং ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়।

এই ঘটনা আরব উপদ্বীপের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করেছে এবং বিশ্ব সভ্যতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম দুর্বলতা থেকে শক্তির দিকে, ব্যক্তিগত দাওয়াত থেকে রাষ্ট্রীয় দাওয়াতের দিকে এবং একটি ছোট সম্প্রদায় থেকে একটি সুসংগঠিত উম্মাহর দিকে অগ্রসর হয়।

এভাবে অন্তত নতুন করে ছয়টি মাইলফলক অর্জন করেছেন মুসলিমগণ।

বী মুহাম্মদ (সা.

)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত কেবল একটি ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়, বরং ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়।আরও পড়ুনমক্কা-মদিনা এখন বিশ্বমানবের শহর৩১ জুলাই ২০১৮১. দুর্বলতা থেকে শক্তির পথে

মক্কায় মুসলিমরা কুরাইশদের নির্যাতন, অপমান, এমনকি প্রাণনাশের মুখোমুখি হয়েছিলেন। মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে মুসলিমরা এই দুর্বল অবস্থা থেকে শক্তির অবস্থানে পৌঁছান।

মদিনায় তারা আত্মরক্ষার অনুমতি পান এবং বদর, উহুদের মতো যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করেন। ইবন হিশামের সিরাতুন নবীতে বর্ণিত আছে, মদিনায় মহানবী (সা.) একটি শক্তিশালী সম্প্রদায় গঠন করেন, যা ইসলামের প্রতিরক্ষা ও প্রসারের ভূমিকা রাখে। (ইবন হিশাম, সিরাতুন নবী, পৃ. ৩৫২, দারুল কুতুব, ১৯৫৫)

২. ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় দাওয়াত

মক্কায় ইসলামের দাওয়াত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। হিজরতের পর মদিনায় মহানবী (সা.) একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে দাওয়াত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করে। (ইবন হিশাম, সিরাতুন নবী, পৃ. ৫০১, দারুল কুতুব, ১৯৫৫)

এই সনদ ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তাকে বাস্তবায়িত করে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দাওয়াতের পথ প্রশস্ত করে।

আরও পড়ুনমদিনা থেকে কারবালা১৭ জুলাই ২০২৪৩. ছোট সম্প্রদায় থেকে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব

মক্কায় মুসলিমরা ছিলেন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, যাঁরা শত্রুদের বেষ্টনীতে আবদ্ধ। হিজরতের পর মদিনায় তাঁরা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীন ঐক্যবদ্ধ হন। নবীজি (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন স্থাপন করে বলেন, ‘তোমরা একে অপরের ভাই, আল্লাহর জন্য।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৬৫)

ফলে এটা ইসলামি ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই ঐক্য মদিনাকে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত করে।

তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, যারা মানুষের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো।সুরা আল–ইমরান, আয়াত: ১১০৪. আঞ্চলিকতা থেকে সর্বজনীনতায়

মক্কায় দাওয়াত কুরাইশ ও আশপাশের গোত্রকেন্দ্রিক ছিল। হিজরতের পর মদিনা থেকে ইসলামের বার্তা সর্বজনীন হয়ে ওঠে।

নবী (সা.) পারস্য, মিশর ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের শাসকদের কাছে চিঠি পাঠান, ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে। ইবন সাদের তাবাকাতে উল্লেখ আছে, নবী (সা.) সম্রাট হেরাক্লিয়াস ও কিসরার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। (ইবন সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ১/২৬৫, দার সাদির, ১৯৬০)

এই পদক্ষেপ ইসলামকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যায়।

৫. গোষ্ঠী থেকে উম্মাহের পরিসরে

হিজরতের আগে মুসলিমরা ছিলেন একটি ছোট বিশ্বাসী গোষ্ঠী মাত্র। মদিনায় তাঁরা একটি সুসংগঠিত মুসলিম উম্মাহে রূপ নেন। নবীজি (সা.) এই উম্মাহর অধীন জাতি-রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলেন, যেখানে নামাজ, জাকাত ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, যারা মানুষের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো।’ (সুরা আল–ইমরান, আয়াত: ১১০)

আরও পড়ুনআধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দলিল মদিনা সনদ২৩ আগস্ট ২০২৪হিজরতের আগে মুসলিমরা ছিলেন একটি ছোট বিশ্বাসী গোষ্ঠী মাত্র। মদিনায় তাঁরা একটি সুসংগঠিত মুসলিম উম্মাহে রূপ নেন।৬. ইবাদত থেকে জীবনব্যবস্থায় রূপান্তর

হিজরতের আগে ইসলাম প্রধানত ইবাদতকেন্দ্রিক ছিল। মদিনায় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়, যা রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক ও অন্যান্য ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে।

মাক্কী কোরআন তাওহিদ ও আধ্যাত্মিকতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, যেমন সুরা আল-ইখলাসে বলা হয়েছে, ‘বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়।’ অন্যদিকে, মাদানী কোরআন জীবনের নিয়মকানুন, যেমন উত্তরাধিকার ও বিবাহের বিধান তুলে ধরে। (সুরা নিসা, আয়াত: ১১-১২)

এই রূপান্তর ইসলামকে একটি ব্যাপক জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

মদিনায় হিজরত ইসলামি ইতিহাসের একটি বাঁক বদলকারী ঘটনা। হিজরত আমাদের শেখায় ত্যাগ, ঐক্য ও আল্লাহর ওপর ভরসার গুরুত্ব। আসুন, হিজরি নববর্ষে আমরা এই শিক্ষাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং ইসলামি আদর্শের আলোকে জীবন গড়ি।

 সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট নেট

আরও পড়ুনজাতীয় ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত মদিনা সনদ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ জরত র ইসল ম র আল ল হ মদ ন য যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বের প্রথম ৫ লাখ কোটি ডলারের কোম্পানি এনভিডিয়া

চিপ কোম্পানি এনভিডিয়ার অগ্রযাত্রা চলছেই। এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির প্রাণভোমরা হচ্ছে এই চিপ। ফলে এনভিডিয়ার ব্যবসায়িক বিকাশই এখন প্রযুক্তি খাতের স্বাভাবিক ঘটনা। সে সুবাদে কোম্পানিটি একের পর এক সমৃদ্ধির মাইলফলক অর্জন করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

সফলতার ধারাবাহিকতায় জেনসেন হুয়াং প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি গত বুধবার বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম কোম্পানি হিসেবে ৫ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার মূলধনের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। খবর অ্যারাবিয়ান বিজনেসের।

বাজার মূলধন ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে ওঠার খবরে বুধবার এনভিডিয়ার শেয়ারের দর ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এই দাম বাড়ার ফলে দিন শেষে কোম্পানিটির বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক শূন্য ৩ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

এক মাইলফলক থেকে আরেক মাইলফলক অর্জন করতে এনভিডিয়ার তেমন একটা সময় লাগছে না। ২০২৩ সালের জুন মাসে কোম্পানিটি প্রথম এক ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলারের বাজার মূলধনের মাইলফলক স্পর্শ করে। তার ২৯ মাসের মাথায় কোম্পানিটি ৫ লাখ কোটি ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলল।

এক লাখ কোটি ডলারের বাজার মূলধন থেকে দুই লাখ কোটি ডলারে পৌঁছাতে এনভিডিয়ার সময় লেগেছিল ১৮০ দিন। এরপর দুই লাখ কোটি ডলার থেকে তিন লাখ কোটি ডলারে যেতে লেগেছে মাত্র ৬৬ দিন। সর্বশেষ চার লাখ কোটি ডলার থেকে পাঁচ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ৭৮ দিন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উত্থানের ঢেউয়ে চেপে এগিয়ে চলেছে এনভিডিয়া—যে প্রবণতা শুরু হয়েছে ২০২২ সালের শেষ দিকে ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আর গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ১ হাজার ৫০০ শতাংশের বেশি। সেই তুলনায় এ বছর এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক বেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ও ন্যাসডাকে ২৩ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে এনভিডিয়ার বাজার মূলধন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়া এখন বিশ্বের যেকোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির আকার ২৯ দশমিক ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার, আর চীনের জিডিপি ১৮ দশমিক ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর পেছনে জার্মানির অবস্থান। সে দেশের জিডিপির আকার ৪ দশমিক ৬৬ ট্রিলিয়ন ডলার।

কোম্পানিস মার্কেট ডট কমের তথ্যানুসারে, বাজার মূলধনের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে মাইক্রোসফট; তাদের বাজার মূলধন ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি ডলার। ৪ লাখ কোটি ডলারের বাজার মূলধন নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে অ্যাপল। ৩ লাখ ৩২ হাজার কোটি ডলার নিয়ে চতুর্থ স্থানে আছে অ্যালফাবেট। ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি ডলার নিয়ে পঞ্চম স্থানে আছে অ্যামাজন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিশ্বের প্রথম ৫ লাখ কোটি ডলারের কোম্পানি এনভিডিয়া