নীল-সাদার দলাদলিতে শিক্ষকদের কি না জড়ালেই নয়
Published: 2nd, July 2025 GMT
আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব সমস্যা বিদ্যমান, তার মূলে রয়েছে শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। শিক্ষকরাজনীতি এতটাই ভয়াবহ যে এর থেকেই অন্য সব সমস্যা বিস্তার লাভ করছে।
উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক আজ লাগামহীনভাবে চাটুকারী রাজনীতিতে যুক্ত।
সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্য সব মানুষের মতো শিক্ষকদেরও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন বা অধিকার রয়েছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা অনুধাবনের সক্ষমতা শিক্ষকদের মধ্যে থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ফলে অধিকাংশ শিক্ষক আজ চাটুকারী ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
এটা এতটাই ঘৃণ্য অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিপূজার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সরকারপ্রধানের গুণকীর্তনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বা কারণে-অকারণে মুহুর্মুহু তাঁদের প্রশংসার সাগরে ভাসানোর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে কী উপযোগ সৃষ্টি হয়, তা আমার বোধগম্য নয়।
আরও পড়ুনশিক্ষকরাজনীতি যেভাবে শিক্ষার মানের ক্ষতি করেছে১১ নভেম্বর ২০২৪এমন স্বপ্রণোদিত কার্যকলাপ যে শুধু ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় সহায়ক, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা শুধু যে শিক্ষকদের গুণগত মানই নষ্ট করে তা-ই নয়, এর মাধ্যমে শিক্ষার মানেরও ব্যাপক অবনতি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোয় দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি ও পদক্ষেপের ব্যাপারে আলোচনা ও সমালোচনা হওয়া আবশ্যক, যাতে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের চলমান ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেদের গঠনমূলক মতামত প্রকাশ করতে পারেন।
কিন্তু শ্রেণিকক্ষে যদি দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে সক্রিয় একজন শিক্ষক পাঠদান করেন, তবে তাঁর কাছ থেকে কোনো গঠনমূলক আলোচনা বা সমালোচনা আশা করা বাতুলতা মাত্র। আর এর ফলে শিক্ষার্থীরা সঠিক জ্ঞানের বিকাশ থেকে বঞ্চিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষকরাজনীতি শিক্ষকদের মানের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ততার কারণে শিক্ষকেরা মানসম্মত পাঠদান ও গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছেন। শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে যে নিয়মিত গবেষণা না করেও অনেকে উচ্চ পদে, এমনকি অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাচ্ছেন।
আরও পড়ুনএই শিক্ষকরাজনীতি দিয়ে জাতির লাভ কী০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২অনেক ক্ষেত্রেই কে কোন দলের সমর্থক, তা গুরুত্ব বহন করলেও কে কত উঁচু মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন, তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তাঁদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে বিস্তর অভিযোগ। এই অভিযোগের ধারাবাহিকতা বহুদিনের হলেও কোনো সরকারই এসব অভিযোগের কোনো যুক্তিসংগত সমাধান দিতে পারেনি বা দেওয়ার চেষ্টাও করেনি।
এর জন্যও শিক্ষকরাজনীতি অনেকাংশে দায়ী। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থেকে শুরু করে সব নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়, সেখানে শিক্ষকদের সামগ্রিক বিষয়াবলি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করার নৈতিক অধিকার বা সাহস বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের মানুষদের থাকার কথা নয়।
তাঁরা নিজেদের পদ রক্ষার জন্য বা নতুন কোনো লোভনীয় পদ পাওয়ার আশায় এসব দাবিদাওয়ার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অনীহা প্রকাশ করেন কিংবা আলোচনা করলেও তাঁদের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারেন না।
এটি নিঃসন্দেহে সামগ্রিকভাবে শিক্ষকদের নৈতিক পরাজয় আর এই পরাজয়কে ত্বরান্বিত করতে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই দায়ী।
আরও পড়ুন‘রাজনীতি’ নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হোক শিক্ষার উন্নয়ন১২ আগস্ট ২০২৪আজকাল হরহামেশাই শিক্ষকদের সম্মানের কথা শুনতে পাই। যে শিক্ষক তার নিজের শিক্ষক পরিচয়ে গর্বিত নন, তাঁর সম্মান কে নিশ্চিত করবে? শিক্ষকদের সম্মান তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে।
কিন্তু এই পরম সত্য শিক্ষকদের মন থেকে বিলীন হতে চলেছে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের নামের সঙ্গে অধ্যাপক পদবির চেয়ে অন্য কোনো পদবি বেশি মানানসই।
আর তাই কখনো কখনো অধ্যাপক পদবি লুকিয়ে রেখে ভিজিটিং কার্ডে ‘উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা’, সিনিয়র সচিব, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বা পরিচালক, এমনকি কোনো রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনের সদস্যপদ লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
শুধু তা-ই নয়, এমনও দেখেছি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সমস্ত শিক্ষকসমাজের মুখে কালিমা লেপনেও কেউ কেউ পিছপা হননি।
শিক্ষক হয়ে আমরাই যদি শিক্ষকের পদমর্যাদাকে পদদলিত করি, তবে সেই মর্যাদা পুনরুদ্ধারে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করলে মর্যাদা যে আরও নিম্নগামী হবে, তা বোঝার জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না।
আরও পড়ুনছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মুক্তি’ দেবে কে২৭ আগস্ট ২০২৩আর শিক্ষক হিসেবে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া আমাদেরই দায়িত্ব। আমরাই শিক্ষার্থীদের বোঝাব যে সমাজে সব পেশার মানুষই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর তা না করে আমরাই যদি মর্যাদার লড়াই করি, তবে সামাজিক বৈষম্য আরও প্রকট হবে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক অচলাবস্থার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সংস্কার কার্যক্রমের আশ্বাসে জনগণের মনে আসার সঞ্চার হয়েছিল যে নতুন কার্যকর কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে।
কিন্তু দুঃখের সঙ্গে পরিলক্ষিত হচ্ছে, নতুন মুখোশের অন্তরালে পুরোনো স্বার্থান্বেষী মহলই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাল ধরছে।
ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এই সরকারও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগপ্রক্রিয়ার বদলে নিজেদের পছন্দমতো জনবল নিয়োগ করেছে।
আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময়ের মতো ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করছেন।
রাজনৈতিক সরকারের সময়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত শিক্ষকেরা যেমন সরকারের অক্ষশক্তি বিস্তারে ভূমিকা রাখতেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যেন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে না পারেন, তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেসব প্রশাসনিক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তা যেন প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে হয়, সে-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত জরুরি।এই দুঃখজনক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যেন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে না পারেন, তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেসব প্রশাসনিক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তা যেন প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে হয়, সে-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত জরুরি।
সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে তাঁদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এখন সত্যিকার অর্থেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের নিজেদের মধ্যে নীল, সাদা বা গোলাপি রঙের সর্বনাশা খেলার পরিসমাপ্তি টেনে শিক্ষার্থীদের জীবনকে সাফল্যের রঙে রঙিন করতে আরও সচেষ্ট হবেন।
ড.
মসফিক উদ্দিন, অধ্যাপক, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র জন ত ক শ ক ষকদ র র জন ত ত র র জন ত সরক র র আম দ র র জন য পর য য় আরও প
এছাড়াও পড়ুন:
ইভিএম কেনায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
বাজারমূল্যের চেয়ে দশ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। দেড় লক্ষ নিম্নমানের ইভিএম কেনায় সরকারের প্রায় ৩ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ক্ষতি বা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
বুধবার যে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তারা হলেন– নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (চলতি দায়িত্ব) মো. ফরহাদ হোসেন, সিনিয়র মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট ফারজানা আখতার। এ ছাড়া আরও তিন কর্মকর্তাকে ডাকা হলেও গতকাল হাজির হননি। তারা হলেন– নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপপ্রধান মো. সাইফুল হক চৌধুরী, সহকারী প্রধান মো. মাহফুজুল হক ও আইটি সিস্টেম কনসালট্যান্ট এ এইচ এম আব্দুর রহিম খান।
কে এম নূরুল হুদাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম, সরকারি আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন, কোনো সমীক্ষা ও টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ইভিএম মেশিন ক্রয়ের অভিযোগ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনে গুণগত মানসম্পন্ন ইভিএম সরবরাহ করা হয়েছে কিনা এবং প্রতিটি ইভিএমের মূল্য সঠিক ছিল কিনা– দুদক এ-সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ বের করে প্রতিবেদন তৈরি করবে। পরে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২০ মার্চ থেকে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ টিম এই অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গতকাল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ছয় কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিন কর্মকর্তা ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে অভিযোগ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে ইসি ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে।