বর্তমানে বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু, চাষিরা এমন উচ্চমূল্য পাননি। চাষির ঘরে এখন পেঁয়াজ নেই। মৌসুমের শুরুতেই ২০ থেকে ৩০ টাকায় তারা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। এখন সেই পেঁয়াজই দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের পকেটে। 

শনিবার (১০ মে) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি সফিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডি ডটকমের এ প্রতিবেদক। সফিউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ক্ষেতে ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু, ২২ টাকার চেয়ে বেশি দাম পাইনি। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারিনি। আজ যখন পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তখন আমার ঘর ফাঁকা।” 

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন। এ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি হয়েছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিয়েছে সংরক্ষণে। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে কৃষকরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এখন বাজারে সেই পেঁয়াজই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে, পেঁয়াজের মজুতদারদের পোয়াবারো।

যাত্রাবাড়ীর পাইকারি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেছেন, “চাষিরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করেন। তখন আমরা মজুত করি। এখন দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়া অন্যতম কারণ।”

এ বিষয়ে কৃষি উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো.

জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “এ বৈষম্য আমাদের কৃষিব্যবস্থার বড় দুর্বলতা। কৃষক উৎপাদন করেন ঠিকই, কিন্তু ন্যায্য মূল্য পান না। অন্যদিকে, কিছু ব্যবসায়ী মজুতের মাধ্যমে ফায়দা লুটে নেন। এটা রোধ করতে হলে উৎপাদন থেকে বাজার পর্যন্ত একটি সুসংহত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।”

তিনি জানান, সরকার কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। পেঁয়াজের জন্য পৃথক হিমাগার স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে কৃষক এভাবে ঠকবেন না।

এই বাজার ব্যবস্থায় বিপাকে আছেন ভোক্তা ও উৎপাদক দু’পক্ষই। লাভ হচ্ছে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের। 

রাজধানীর বাসিন্দা সানজিদা শ্যামা বলেছেন, চৈত্র মাসে শুনেছি, কৃষকরা পেঁয়াজ ফেলেও দিয়েছেন দাম না পেয়ে। এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা দিয়ে! তাহলে কার লাভ, কার ক্ষতি?

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি মৌসুমেই একই রকম ভুক্তভোগী হন—উৎপাদন করে লোকসান, আর বাজারে সেই পণ্য বিক্রি হয় চড়া দামে। পেঁয়াজের বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করল, উৎপাদন বাড়লেই কৃষকের লাভ বাড়ে না। বাজার ব্যবস্থাপনা সুসংহত না হলে কোনো লাভই কৃষকের ঘরে পৌঁছায় না। সময় এসেছে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কথা নয়, কাজ দেখানোর।

ভোক্তাদের সংগঠন সচেতন নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক শামীমা হক বলেন, পেঁয়াজের বাজার একটি চক্রের হাতে। এখানে স্বচ্ছতা নেই। কৃষককে রক্ষা করতে হলে উৎপাদন-পরবর্তী ন্যায্য বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ মৌসুম শেষে সংরক্ষণ করা যায় না। দেশে বিদ্যমান হিমাগারগুলো মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য নির্মিত, যা পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। কৃষকরা তাই কম দাম পেলেও বাধ্য হয়ে আগেই বিক্রি করেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ফিরোজ কবির বলেছেন, কৃষক দাম না পেলে চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। এতে ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। তখন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এই চক্র রোধ করতে হলে উৎপাদনকারীকে লাভ দিতে হবে। 

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকিসহ মজুত-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল কৃষি বিপণন চালু করে সরাসরি বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। মজুদার ও বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ করতে হবে।

ঢাকা/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ বল ছ ন র জন য উৎপ দ ক ষকর

এছাড়াও পড়ুন:

চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে

দেশে সব সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়ে থাকে ব্যবসায়ী মহলে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হলেও সে আশার গুড়ে বালিই ঘটেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা না আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য বিষফোড়া হিসেবে চাঁদাবাজি ব্যবসায়ীদের চরমভাবে ভুক্তভোগী করছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। 

পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সভায় ব্যবসায়ী নেতারা যে সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, তার সারসংক্ষেপ হলো বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নয়, বরং কিছু করপোরেট গ্রুপের সিন্ডিকেট এবং পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে খালাস পর্যন্ত চলমান ভয়াবহ চাঁদাবাজি।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলার বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বাজার তদারকিতে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরাবেন, ততক্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না। কারওয়ান বাজারের চুনোপুঁটি ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে রাঘববোয়ালের কাছে যান।’ চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো অপরিহার্য পণ্য সরবরাহের জন্য মুষ্টিমেয় সাতটি গ্রুপের ওপর গোটা দেশের নির্ভরতা এই সিন্ডিকেট-নির্ভরতার বিপদকে প্রকট করে তোলে।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিনের অভিযোগ আরও গুরুতর। তিনি সরাসরি করপোরেট ব্যবসায়ীদের ‘শকুনের মতো শোষণকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ৩ টাকার মোড়ক দিয়ে ৪০ টাকা দাম বাড়ানোর মতো কারসাজির কথা তুলে ধরেছেন। সংকটের সময় মিলগুলো নিয়মিত পাইকারদের তেল না দিয়ে বিশেষ শ্রেণির পরিবেশকদের সুবিধা দেওয়ায় বাজার আরও অস্থির হয় বলে অভিযোগ। এসব করপোরেট কারসাজির ওপর সরকারের কার্যকর নজরদারি না থাকলে রমজানের সময় মূল্য সহনীয় রাখা অসম্ভব।

ব্যবসায়ী নেতারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নিত্যপণ্য পরিবহন ও সরবরাহের পথে গুরুতরভাবে চাঁদাবাজি চলছে। পণ্য ট্রাকে ওঠানো-নামানো—সর্বত্রই চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও চাঁদাবাজদের ‘দহরম-মহরম’ থাকার অভিযোগ তো নতুন নয়। চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ তৈরি না হলে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে না এবং বাজার স্থিতিশীল হবে না—এই কঠোর সত্যটি সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক কেবল ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে অনুরোধ করা হবে’ বলে দায় সারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না, দরকার কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা।

পেঁয়াজ বা খেজুরের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরকারের ভুল শুল্কনীতি এবং আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা বড় ভূমিকা রাখে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি এসেও সামান্য ১০ শতাংশ ঘাটতির জন্য দামের ‘সেঞ্চুরি’ হওয়ার পর সরকারের আমদানির প্রয়োজন বোধ করা সময়োচিত নয়। অন্যদিকে খেজুরের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে এটিকে বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। ফল আমদানিকারকেরা অবিলম্বে শুল্ক যৌক্তিক করার দাবি জানিয়েছেন। রমজানে চাহিদা মেটাতে সরকার যদি নিজেই নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি করে মজুত রাখে, তবে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কমবে এবং সংস্থার হয়রানিও বন্ধ হবে—এমন প্রস্তাব সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

গত বছরের রমজানে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্তের ফলে বাজারের পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলক সন্তোষজনক। আমরা আশা করব, সরকার আসন্ন রমজানের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আগাম প্রস্তুতি নেবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হবে, সেটিই কাম্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে আশুগঞ্জ সার কারখানায় সমাবেশ 
  • ওয়েস্টিন ও শেরাটনের ব্যবসা বেড়েছে 
  • নভেম্বরের ১৫ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা 
  • সরবরাহ বাড়ছে শীতের আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপির, কমছে দাম
  • গ্রিস থেকে গ্যাস আমদানিতে সম্মত ইউক্রেন: জেলেনস্কি
  • সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের ব্যবসা বেড়ে তিন গুণ
  • তিন মাসে ওয়ালটনের মুনাফা ২২১ কোটি টাকা
  • ইউক্রেনের হামলা: নভোরো-সিয়েস্ক বন্দরের তেল রপ্তানি বন্ধ করল রাশিয়া
  • চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে
  • সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে