ন্যায্য মূল্য পান না পেঁয়াজচাষি, মজুতদারদের পোয়াবারো
Published: 10th, May 2025 GMT
বর্তমানে বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু, চাষিরা এমন উচ্চমূল্য পাননি। চাষির ঘরে এখন পেঁয়াজ নেই। মৌসুমের শুরুতেই ২০ থেকে ৩০ টাকায় তারা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। এখন সেই পেঁয়াজই দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের পকেটে।
শনিবার (১০ মে) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি সফিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডি ডটকমের এ প্রতিবেদক। সফিউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ক্ষেতে ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু, ২২ টাকার চেয়ে বেশি দাম পাইনি। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারিনি। আজ যখন পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তখন আমার ঘর ফাঁকা।”
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন। এ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি হয়েছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিয়েছে সংরক্ষণে। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে কৃষকরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এখন বাজারে সেই পেঁয়াজই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে, পেঁয়াজের মজুতদারদের পোয়াবারো।
যাত্রাবাড়ীর পাইকারি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেছেন, “চাষিরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করেন। তখন আমরা মজুত করি। এখন দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়া অন্যতম কারণ।”
এ বিষয়ে কৃষি উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো.
তিনি জানান, সরকার কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। পেঁয়াজের জন্য পৃথক হিমাগার স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে কৃষক এভাবে ঠকবেন না।
এই বাজার ব্যবস্থায় বিপাকে আছেন ভোক্তা ও উৎপাদক দু’পক্ষই। লাভ হচ্ছে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের।
রাজধানীর বাসিন্দা সানজিদা শ্যামা বলেছেন, চৈত্র মাসে শুনেছি, কৃষকরা পেঁয়াজ ফেলেও দিয়েছেন দাম না পেয়ে। এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা দিয়ে! তাহলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি মৌসুমেই একই রকম ভুক্তভোগী হন—উৎপাদন করে লোকসান, আর বাজারে সেই পণ্য বিক্রি হয় চড়া দামে। পেঁয়াজের বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করল, উৎপাদন বাড়লেই কৃষকের লাভ বাড়ে না। বাজার ব্যবস্থাপনা সুসংহত না হলে কোনো লাভই কৃষকের ঘরে পৌঁছায় না। সময় এসেছে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কথা নয়, কাজ দেখানোর।
ভোক্তাদের সংগঠন সচেতন নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক শামীমা হক বলেন, পেঁয়াজের বাজার একটি চক্রের হাতে। এখানে স্বচ্ছতা নেই। কৃষককে রক্ষা করতে হলে উৎপাদন-পরবর্তী ন্যায্য বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ মৌসুম শেষে সংরক্ষণ করা যায় না। দেশে বিদ্যমান হিমাগারগুলো মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য নির্মিত, যা পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। কৃষকরা তাই কম দাম পেলেও বাধ্য হয়ে আগেই বিক্রি করেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ফিরোজ কবির বলেছেন, কৃষক দাম না পেলে চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। এতে ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। তখন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এই চক্র রোধ করতে হলে উৎপাদনকারীকে লাভ দিতে হবে।
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকিসহ মজুত-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল কৃষি বিপণন চালু করে সরাসরি বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। মজুদার ও বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ করতে হবে।
ঢাকা/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ বল ছ ন র জন য উৎপ দ ক ষকর
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: বাণিজ্য আদালত প্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশ
গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক মোড় ঘোরানোর দিন ছিল। শেখ হাসিরা সরকার পতনের পর (৮ আগস্ট ২০২৪) দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো। এই এক বছরে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে এনেছে একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষ করে রমজান ও ঈদুল আজহা দুই বড় ধর্মীয় উৎসবেই বাজার ছিল নজিরবিহীন স্থিতিশীল। যা গত দশকের ইতিহাসে এক বিরল উদাহরণ।
ব্যবসা সহজ করতে নতুন অধ্যায়
ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরোধ, প্রতারণা বা অনৈতিক চুক্তি এসব সমাধানে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে আইনি প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এখন সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য আদালত প্রতিষ্ঠার।
আরো পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকার: এক বছরে সফলতা ও ব্যর্থতা
রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন,“বাণিজ্য আদলতের খসড়া আইন প্রণয়ন চলছে। প্রথমে ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে এই আদালত চালু হবে, পরে প্রয়োজনে জেলা পর্যায়েও বিস্তৃত হবে। ব্যবসা সহজীকরণে এটি একটি বড় মাইলফলক হবে।”
রেকর্ড নজরদারি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা
গত বছর যেখানে বাজার পর্যবেক্ষণ দল ছিল ১২টি, এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ২৮-এ দাঁড়িয়েছে। তদারকির পরিধি এখন জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। রমজান ও কোরবানির সময় ৪০০ এর বেশি নজরদারি টিম সার্বক্ষণিক মাঠে ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম।
সরবরাহ শৃঙ্খল নিশ্চিত করতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রায় এক কোটি পরিবারের কাছে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য পৌঁছানো হচ্ছে।
স্মার্টকার্ড ও সহায়তাপ্রযুক্তি
টিসিবির ভর্তুকি কার্যক্রমে স্মার্টকার্ড ব্যবস্থা চালু হলেও গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের অনেকের স্মার্টফোন নেই, ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, “প্রযুক্তিনির্ভর হলেও মানবিক বিবেচনাও রাখতে হচ্ছে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে।”
রপ্তানিতে ইতিবাচক সুর ও বহুপাক্ষিক চুক্তি
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় বেড়েছে। পণ্যের বৈচিত্র্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় সাফল্য এসেছে যার নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। আগস্টে জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (EPA)–এর সপ্তম রাউন্ড শুরু হবে। ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।
মূল্যস্ফীতির পতন: পরিসংখ্যান বলছে অগ্রগতি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই: খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি ১৪.১০% (১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ)। ২০২৫ সালের জুন: তা কমে দাঁড়ায় ৭.৩৯% (দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন) অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও কমে জুনে ৯.৩৭%-এ দাঁড়িয়েছে।
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও পাইকারি খুচরা দামের ফারাক
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, বাজারে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাইকারি ও খুচরা দামের অযৌক্তিক ব্যবধানও এখন সরকারের নজরদারির মধ্যে।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: টেকসই ও দুর্নীতিমুক্ত বাজার
বাণিজ্য সচিব বলেন, “টেকসই বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা চাই প্রযুক্তিনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত ও সর্বজনীন বাজার।”
তিনি বলেন, “বাণিজ্য আদালত চালু হলে ব্যবসায়িক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি, লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বাজার শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।”
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, “এক বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ গতি পেয়েছে নজরদারি, ভর্তুকি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে। তবে কিছু পণ্যের দামের অস্থিরতা, প্রযুক্তি ব্যবহারে গ্রামীণ সীমাবদ্ধতা এবং রপ্তানি বাজারের বৈশ্বিক ঝুঁকি এখনও বিদ্যমান।বাণিজ্য আদালত বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা বাণিজ্যে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা আসতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে বাজার স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।”
ঢাকা/এসবি