ঢাবি ভিসির ওপর দায় চাপানো সত্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা: সারজিস
Published: 14th, May 2025 GMT
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেছেন, শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে এবং তাদের ওপরে দায় চাপানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে সেটা স্রেফ অপচেষ্টা এবং সত্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা।
বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন তিনি।
পোস্টে সারজিস আলম লেখেন, আমাদের ভাই সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টর স্যারের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে এবং তাদের ওপরে দায় চাপানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে সেটা স্রেফ অপচেষ্টা এবং সত্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা।
তিনি বলেন, প্রথমত, ঘটনা ঘটেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শৃঙ্খলার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের না। দ্বিতীয়ত, এই উদ্যানের মাদক সেবন, হেনস্তা, চাঁদাবাজিসহ যাবতীয় অপকর্ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয় বরং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কিংবা প্রভাব খাটানো বিভিন্ন সংগঠন এবং তাদের ছত্রছায়ায় থাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে থাকে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক বলেন, উদ্যানের গেট এবং উদ্যানের বেতরের অংশে ভাসমান দোকান দিয়ে বস্তি বানানো, মন্দিরের গেটের আশপাশে এবং পুরো ক্যাম্পাসে শতাধিক ভাসমান দোকান ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্টের অন্যতম কারণ। এই দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বসায়নি বরং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কোনো না কোনো সংগঠনের কিছু চাঁদাবাজ নেতাকর্মীরা বসিয়েছে। তারা এর ভাগ নেয় এবং প্রটেকশন দেয়।
‘এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসব অপকর্মে প্রশ্রয় দেয় এবং নিজের ভাগ বুঝে নেয়। কেউ ভালো উদ্দেশ্যে কাজ করতে চাইলে তাকে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বিভিন্ন নেতাকর্মীর দ্বারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।’
তিনি আরও বলেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এগুলো উচ্ছেদ করতে যায় তখন তাদের বাধা দেওয়া হয়, ক্ষমতার দাপট দেখানো হয়। উদ্যানের গেট যখন বন্ধ করা হলো তখন এই গেট খুলে যারা গেটের ভেতরে ও বাইরে পঞ্চাশের অধিক দোকান বসিয়েছে তারা এই হত্যার পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে অন্যতম দায়ী।
সারজিস আলম আরও বলেন, মেট্রোরেল স্টেশন এবং শহীদ মিনারকে ব্যবহার করে যারা সেখানে শতাধিক ভাসমান দোকান বসিয়ে, চাঁদাবাজি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে তারা এমন হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে দায়ী। যারা উদ্যানের ভেতরে মাদকের সিন্ডিকেট চালায়, মাদক সাপ্লাই দেয়, মাদকসেবনের পরিবেশ তৈরি করে এবং সেখান থেকে চাঁদাবাজি করে তারা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কখনো একটা শহরের মানুষের চা, পান, সিগারেট খাওয়ার, আড্ডা দেওয়ার কিংবা অবাধ মেলামেশার জায়গা হতে পারে না।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য টিএসসির বেতরের ক্যাফেটেরিয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য যাবতীয় চা, কফি, নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সেই ক্যাফেটেরিয়াকে অকার্যকর করে টিএসসিতে প্রায় ৩০টা চা দোকানের আসর বসানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগুলো বন্ধ করতে যাক, দেখবেন একদল ভণ্ড এবং সো-কল্ড লিবারেল সুশীল শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের বদহজম শুরু হয়েছে। তাদের চেতনা থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো লাভার নির্গমন শুরু হয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় এই চা দোকানগুলোতে প্রতিদিন পুরো ঢাকা শহর থেকে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে আসে। সঙ্গে কিছু বখাটে মাদকসেবীও আসে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করে। যারা টিএসসির এই দোকানগুলো রাখতে বাধ্য করেছে এবং যারা চাঁদাবাজি করছে তারাও এই হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
তিনি আরও বলেন, দোয়েল চত্বরের একপাশে প্রায় ৩০টার মতো বিভিন্ন কারুকার্যখচিত পণ্যের দোকান এবং অপরপাশে প্রায় ২০টা গাছের দোকান বসানো হয়েছে। দেখতে সুন্দর লাগলেও এখানেও প্রতিদিন হাজার হাজার খদ্দের ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এবং পুরো ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আনাগোনা বৃদ্ধি করে। যানজট সৃষ্টি করে। অবৈধভাবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতি মাসে কারা এখান থেকে চাঁদাবাজি করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। তারাও এই হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টিতে পরোক্ষভাবে দায়ী।
এনসিপির এ নেতা বলেন, আমার যেকোনো একজন ভাইয়ের হত্যা হওয়া তো দূরের কথা, তার গায়ে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা আঘাত আমরা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাদের কাজগুলো করতে দেব না, নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য অবৈধ দোকান বসাবো, মাদকের ব্যবসা চালাবো, চাঁদাবাজি করবো, বহিরাগত নিয়ে আসার যাবতীয় আয়োজন করবো আর কোনো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টরের পদত্যাগ চাইবো, এইসব দ্বিচারিতা বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমি আমার মন মতো স্বাধীনতা চাইবো, যা খুশি তাই করতে চাইবো, ক্ষমতার অপব্যবহার করব আবার শৃঙ্খলাও প্রত্যাশা করব, এই দুইটা একসঙ্গে সম্ভব না।
সারজিস বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করবো- ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরের সকল ভাসমান দোকানকে উচ্ছেদ করতে হবে। টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুলভমূল্যে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মাফিক খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কার্জন হল, মোকারম ভবন এবং মোতাহার ভবনে ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। টিএসসিকে চা দোকানের আখড়া থেকে মুক্ত করতে হবে। ক্যাম্পাসে অবাধে সব প্রকার যান চলাচল এবং বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ভাই সাম্যের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সাম্যের মতো আর কোনো ভাইকে যেন হারাতে না হয় কিংবা কারও গায়ে আঘাত না লাগে তার যথাযথ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অবিলম্বে কার্যকর দেখতে চাই।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড র প র পর ব শ স ষ ট ব যবস থ ক ষমত র র ব যবস র জন য ষ ট কর ট এসস
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফিরে এল
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান আবার ফিরছে। এ–সংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলেও এখনই তা কার্যকর হচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের নির্বাচন অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তা প্রয়োগ হতে পারে।
প্রায় তিন দশক আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। এ–সংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত করে গতকাল বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, এ রায়ের ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান পুনর্বহাল হলো। যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনকে সংবিধান পরিপন্থী ও বাতিল ঘোষণা করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর এবং এ-সংক্রান্ত রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিতে রায় দেন।
গতকাল সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটের দিকে প্রধান বিচারপতি ও অপর ছয় বিচারপতি এজলাসে আসেন। আসন গ্রহণের পর রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। বেঞ্চের অপর ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায়ে বলা হয়, সর্বসম্মতিতে আপিলগুলো মঞ্জুর করা হলো, সে আলোকে রিভিউ আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হলো। নথিদৃষ্টে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আপিল বিভাগের রায়টি (২০১১ সালের রায়) একাধিক ক্রটিপূর্ণ। অতএব পর্যালোচনাধীন রায়টি (২০১১ সালের রায়) সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো।
১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধন আইনের ধারা ৩ দিয়ে সন্নিবেশিত হওয়া সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ‘২ক পরিচ্ছেদ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ সম্পর্কিত বিধানাবলি এ রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো বলে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেন।
রায়ে আরও বলা হয়, এরূপ পুনরুজ্জীবন ‘পরিচ্ছেদ ২ক’–এ উল্লেখিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানাবলির স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল নিশ্চিত করে। তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২)–এর বিধানের প্রয়োগ সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে। পুনর্বহাল ও পুনরুজ্জীবিত ‘পরিচ্ছেদ ২ক’–এ উল্লেখিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের বিধানে যা ছিলত্রয়োদশ সংশোধনী আইনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সংক্রান্ত ৫৮খ(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বা মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখ থেকে সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টা নিয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কার্যকর কবে থেকেরায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, রায়ে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। এটা কার্যকর হবে পরবর্তী সংসদ ভাঙার পরের ১৫ দিনের মধ্যে।
এই রায় চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে বলে মনে করেন আপিলকারী বিএনপির মহাসচিবের অন্যতম জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরে নতুন সরকার গঠিত হবে। সংসদ ভেঙে গেছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর। সুতরাং ওই বিধান, অর্থাৎ যে বিধানটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, এই বাস্তবতায় এটি কার্যকর করার সুযোগ নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন রিভিউ আবেদনকারী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরও।
রায়ের প্রতিক্রিয়াতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ার পর দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে দেশের গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয়েছিল। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে তা সাংবিধানিক হিসেবেই রায়ে ঘোষিত হলো।
একই আপিল বিভাগে তাঁর আগের রায়কে কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ বলার ব্যাখ্যা জানিয়ে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত বলেই ওই রায় বাতিল করা হয়েছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ ছিল, এই রায় লেখার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও তাঁর সহযোগীরা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন।
অন্যতম আপিলকারী সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তার মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলে গত তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে।
রায়কে দেশের জন্য মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। আপিলকারী বিএনপির মহাসচিবের এই আইনজীবী বলেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। রায়ের ফলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এসেছে।
বদিউল আলম মজুমদারসহ আপিলকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, গতকাল দেওয়া রায়টি সামগ্রিকভাবে এই সময়ের পটভূমিতে খুবই ঐতিহাসিক। খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া রায়টি ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল।
জুলাই সনদ ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাজুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার যে রূপরেখা আছে, তার পরিবর্তন সম্ভব হবে কি না—জানতে চাইলে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পার্লামেন্টের কিছু ডিসকাশন থাকবে। ২০ বছর পরে জনগণ যদি মনে করে এই ব্যবস্থা পচে–গলে গেছে, এর থেকেও ভালো কোনো ব্যবস্থা গণতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই পার্লামেন্টের ডিসকাশন থাকবে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, জুলাই সনদ চারটি বিকল্প দিয়ে গণভোটে পাঠানো হচ্ছে। এগুলো গণভোটে পাস হলে এবং নতুন সংসদের সংবিধান সংস্কার সভায় গৃহীত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এটা নির্ভর করবে জুলাই সনদ গণভোটে পাস হলো কি না আর পাস হওয়ার পর সংবিধান সংস্কার পরিষদ তা গ্রহণ করবে কি না তার ওপর।
তত্ত্বাবধায়ক প্রবর্তন, বিলোপ ও পুনর্বহালনির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসংবলিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। আইনটির শিরোনাম ছিল সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৯ সালে একটি রিট হয়।
রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট দেওয়া রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারী পক্ষ। এই আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪: ৩) ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন।
সেদিন সংক্ষিপ্ত আদেশে ওই ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে উল্লেখ করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল।
এই রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (২০১১ সাল) আনা হয়। এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দেশে সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে।
২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। একইভাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি রিভিউ আবেদন করেন। এর পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক রিভিউ আবেদন করা হয়।
এ ছাড়া সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন এই মামলায় ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। শুনানিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সাল) নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলেন আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীরা।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরপর গত ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। ১১ নভেম্বর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য গতকাল দিন ধার্য করেন। এদিন আপিল বিভাগের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাসংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলো।