প্রস্তাবিত ‘আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্প’ বাস্তবায়নে পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষার ওপর জনমত যাচাই ও গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আগামী ইরি-বোরো মৌসুমের শুরুতে যেকোনভাবে সেচের পানি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

কৃষকেরা জানান, তারা গত ৪-৫ বছর কম খরচে ও সুবিধাজনক সেচের পানি না পাওয়ায় তাদের কৃষি জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকের কমে, সেচ খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।

তারা অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন কৃষকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। তাদের ধোঁকা দিয়েছেন।

বুধবার দুপুরে বিএডিসির আশুগঞ্জস্থ নিজস্ব কার্যালয়ে পুরনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইআইএস) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এ গণশুনানির আয়োজন করে।

জানা গেছে, ‘আশুগঞ্জ পলাশ এগ্রো-ইরিগেশন সেচ প্রকল্প’টি দেশের একটি জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব ও ব্যতিক্রমী সেচ প্রকল্প। গত ৩০ জুন/২০২০ প্রকল্পের পঞ্চম পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হয় এবং আশুগঞ্জ আখাউড়া মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদ্যমান প্রকল্পের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে গত ৫ বছর ধরে প্রায় বন্ধ সেচ ব্যবস্থাপনা। এ অবস্থায় দেশের জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও কম খরচের প্রকল্পের আওতায় ১৫ হাজার হেক্টর জমির ইরি-বোরোর আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। সেচ খরচ বৃদ্ধিতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রকল্পের ৩৪ হাজার কৃষক, প্রতি মৌসুমে ব্যাহত হচ্ছে ধানের অন্তত ৭০ হাজার টন ধান উৎপাদন। 

কৃষকরা জানান, সেচের সুবিধা না পাওয়ায় যে জমিতে ২০-২৫ মণ ধান উৎপাদন হতো সেখানে হয় ৭-৮ মণ। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের সেচ চালু থাকলে বিঘা প্রতি গড়ে হাজার টাকা সেচ খরচ হলেও এখন হচ্ছে ৬-৭ হাজার টাকা। কৃষক ও কৃষির স্বার্থে তারা দ্রুত সেচ সুবিধা চালুর দাবি জানান।

বিএডিসি সূত্র জানিয়েছে, কৃষকের দাবির প্রেক্ষিতে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে পরিকল্পনা কমিশনে নতুন প্রস্তাবনা জমা দেয় বিএডিসি। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটি (একনেক) সভায় ৪৬৭ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেয়। অনুমোদিত প্রকল্পটি পরিবেশ সম্মত কিনা তা যাচাইয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

গণশুনানিতে উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন সেচ সুবিধাভোগী কৃষক আশুগঞ্জের মো.

সুলায়মান মিয়া, হুমায়ুন মিয়া, তফছির মিয়া, আবু তালেব ও সরাইল উপজেলার আবতাব মিয়া, সিদ্দিক মিয়া, আব্দুল বাছেতসহ বেশ কয়েকজন। তারা নিজেরদের বোকা ও প্রশাসন তাদের ধোঁকা দিচ্ছেন উল্লেখ করে অভিযোগ করেন, গত ৪-৫ বছর ধরে বিএডিসি ও উপজেলা প্রশাসন সেচ চালু হচ্ছে বলে বললেও তা হচ্ছে না। সেচ না পাওয়ায় তাদের জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে।

তারা বলেন, ‘আপনাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাক, আমাদের সেচের পানি দেন।’

কৃষকের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজী শাহজাহান সিরাজ ও কেন্দ্রীয় কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শামীম। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফে মোহাম্মদ ছড়াসহ উপস্থিত সবাই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করেন। 

আশুগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফে মোহাম্মদ ছড়ার সভাপতিত্বে গণশুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএডিসির উপ-প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মো. ওবায়েদ হোসেন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাজী তাহমিনা শারমিন, আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহজাহান সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুন্নাহার সীমা, বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী রনি সাহা, সিইআইএসের পরিচালক কাজী কামরুল হাসান, একই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ এইচএম নুরুল ইসলাম, সেচ বিশেষজ্ঞ মো. ফেরদৌসুর রহমান প্রমুখ।

উল্লেখ, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন ইউনিটের টারবাইন ঠান্ডা রাখতে মেঘনা নদী থেকে যে বিপুল পরিমাণ পানি উঠানো হয়, তা ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসাবে একটি আউটার চ্যানেল দিয়ে পুনরায় নদীতেই ফেলে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে এলাকার কিছু ব্যক্তির প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে একটি হেড রেগুলেটর নির্মাণের মাধ্যমে এ পানির গতিপথ আংশিক পরিবর্তন করে পার্শ্ববর্তী জমিতে সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা আসলে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে উৎসাহের সঞ্চার হয়, দৃষ্টিগোচর হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও। পরবর্তীতে সরকার ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে বিএডিসির আওতায় ‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’ নামে একটি সেচ প্রকল্প গ্রহণ করে। এদিকে একই সময় নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়ও অনুরূপ একটি প্রকল্প গড়ে উঠায় প্রকল্প দুটিকে একীভূত করে ১৯৯০-৯৫ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যাত্রা শুরু করে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ এগ্রো ইরিগ্রেশন সেচ প্রকল্প’।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় স চপ ম প স চ প রকল প ন প রকল প প রকল প র গণশ ন ন পর ব শ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

সর্বজনীন পেনশন গতিশীল করতে সুবিধা বাড়ছে

সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বেশ কিছু সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে পেনশনযোগ্য বয়স হলে জমাকৃত অর্থ এককালীন তোলার সুযোগ, প্রবাস ও প্রগতি স্কিমে সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদার পরিমাণ কমানো, প্রগতি স্কিমে মাসিক সর্বোচ্চ জমার পরিমাণ বাড়ানো, আউটসোর্সিং সেবাচুক্তিতে নিয়োজিত কর্মীদের পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ইসলামিক ভার্সন চালুর প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদি। 

গতকাল বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের দ্বিতীয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একজন চাঁদাদাতা পেনশনযোগ্য বয়সে উপনীত হওয়ার পর তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে তাঁর মোট জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ এককালীন তুলে নেওয়ার সুবিধা দেওয়া হবে। বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত বয়সীরা সর্বজনীন পেনশন স্কিমগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। চাঁদাদাতাদের বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর থেকে তারা মাসিক পেনশন পাবেন। এতদিন এককালীন টাকা তোলার কোনো সুযোগ ছিল না।

প্রবাসীদের জন্য প্রগতি পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী অনেকের মাসিক আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় এ দুটি স্কিমে সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদার হার দুই হাজার টাকার পরিবর্তে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রগতি পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি অংশের মাসিক আয় বেসরকারি খাতের কর্মকর্তাদের গড় মাসিক আয়ের তুলনায় বেশি হওয়ায় মাসিক সর্বোচ্চ জমার পরিমাণ ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা এবং আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা চুক্তির আওতায় নিয়োজিত সেবাকর্মীদের প্রগতি পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। 

এতে বলা হয়, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসএসএ) সদস্যপদ গ্রহণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ইসলামিক ভার্সন চালুর বিষয়টি পরীক্ষা করে পরবর্তী বৈঠকে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

এছাড়া পেনশন স্কিমে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য প্রচার কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে। পাশাপাশি টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, টকশো ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচারকালে বিজ্ঞাপন প্রচার ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রচার কার্যক্রম জোরদার করা হবে। 

বৈঠকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ৬০ বছর বয়সের জন্য অপেক্ষা না করে চাঁদাদাতার ইচ্ছা অনুসারে যে কোনো বয়স থেকে পেনশন সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। একে ‘স্বেচ্ছা পেনশন’ নামে উল্লেখ করে শর্তসাপেক্ষে এ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করে কর্তৃপক্ষ। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলে তাঁর অক্ষমতার সময় থেকেই পেনশন সুবিধা চালু করার কথাও বলা হয়। একইসঙ্গে যে কোনো প্রয়োজনের সময় পেনশন স্কিমে জমা করা মোট অর্থের ২০ শতাংশ এককালীন উত্তোলনের বিধান সংযুক্ত করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তবে এসব বিষয় আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার নির্দেশনা দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। 

জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা গতকাল সমকালকে বলেন, পেনশন কর্তৃপক্ষের বেশকিছু প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করেছে। আবার কিছু প্রস্তাব আরও পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে আরও জনপ্রিয় করতে বাস্তবতার ভিত্তিতে বিষয়গুলো আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। 

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। সেদিন থেকেই বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’ ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’– এ চার স্কিম সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে পুরোপুরি প্রস্তুতি না নিয়ে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জনগণকে তুষ্ট করতে তড়িঘড়ি করে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করার অভিযোগ ওঠে। চাঁদা ও পেনশন সুবিধার কাঠামোও সমালোচনার মুখে পড়ে। এতে শুরুর দিকে নিবন্ধকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও পরে তাতে ভাটা পড়ে। 

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৪১ জন। চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭৩ কোটি ৬৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ