ফিলিস্তিনের নাকবা: ১০০ বছর আগে জায়নভূমির প্রকল্পের সূচনা
Published: 15th, May 2025 GMT
সেটা আজ থেকে ১৪০ বছর আগের কথা। অস্ট্রিয়ার ইহুদি লেখক-সাংবাদিক নাথান ব্রিনবাম তখন স্বমুক্তি (সেলফ ইমানসিপেশন) নামে একটি সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ শুরু করেন ভিয়েনা থেকে। ইহুদি পুনর্জাগরণ ঘটানো ও ফিলিস্তিনে তাদের পুনর্বসতি স্থাপনের ধারণাটি প্রচারণায় নিয়ে আসাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
এ কাজে ব্রিনবাম আবার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পোলীয় ইহুদি চিকিৎসক ও লেখক লিওন পিনসকারের দ্বারা, যিনি ১৮৮২ সালে একই নামে জার্মান ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন। রাশিয়ায় ইহুদি নিধনযজ্ঞ দেখে ব্যথিত হয়ে ছদ্মনামে এটি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ইহুদি সম্প্রদায়কে স্বাধীনতার ও জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করার এবং স্বাধীন ভূমিতে ফেরার আহ্বান জানান।
এর তিন বছর পর ব্রিনবামের সাময়িকী এ আহ্বানকেই আরেকটু উচ্চকিত করার জন্য মাঠে নামে। তারা তখন থেকে জায়নভূমির বিষয়টি সামনে আনতে শুরু করে। ১৮৯০ সালে ব্রিনবাম ‘জায়নিস্ট’ ও ‘জায়নিজম’ এবং ১৮৯২ সালে ‘পলিটিক্যাল জায়নিজম’ পরিভাষার প্রবর্তন করেন।
সাধারণভাবে জায়নিজম বা জায়নবাদ হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়া ও ইসরায়েলের ভূমিতে (এরেতজ ইসরায়েল) ইহুদি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (জুইশ ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি)।
হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণকারী লেখক-সাংবাদিক থিওডর হারজেল জায়নবাদের ধারণাটিকে নিয়ে জোরালোভাবে অগ্রসর হয়ে একে আন্দোলনে রূপ দেন এবং জায়নবাদের পিতা হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি ১৮৯৬ সালে ‘জুইশ স্টেট’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের নিজস্ব ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।
ব্রিনবাম ও হারজেল সমসাময়িক ছিলেন এবং দুজনেই জায়নাবাদী আন্দোলনের পুরোধার ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিনবাম এই পথ থেকে সরে এসে জীবনের শেষ পর্যায়ে জায়নবাদবিরোধী হয়ে ওঠেন। তবে হারজেল এই আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন, যা তাঁর মৃত্যুর (১৯০৪) ৫০ বছরের মধ্যে সাফল্যের মুখ দেখে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়—ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেই।
একই সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের ওপর অনিঃশেষ বিপর্যয় নেমে আসে। সেই বিপর্যয় স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মে পালিত হয় আল-নাকবা দিবস। ১৯৯৮ সালে ইসরায়েল যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘটা করে উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেয়, তখন ফিলিস্তিনিদের কিংবদন্তি নেতা ও ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরাও তাঁদের নাকবার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবেন। তিনি ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনটিকে নাকবা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে নাকবা পালিত হয়ে আসছে। আর জাতিসংঘ ২০২৩ সাল থেকে দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু করে।
ইসরায়েলের সংশোধনবাদী (রিভিশনিস্ট) ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইমের ভাষায়, ‘ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো হলোকাস্ট। আর ফিলিস্তিনি জনগণেরটা হলো নাকবা। আর এই নাকবা শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং তা হলো আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে ক্রমাগত বিতাড়ন ও অপসারণ করার নির্মম চলমান প্রক্রিয়া।’
আরও পড়ুনইসরায়েল শান্তি নয়, ভূমিই বেছে নিয়েছে১৫ মে ২০২৪আসলেই এ প্রক্রিয়া ৭৭ বছর ধরে চলমান। জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে ব্রিটিশ–শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্তত ১০ লাখ মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। তারা প্রায় কেউই আর স্বদেশে ফিরতে পারেনি। আর যারা রয়ে গিয়েছিল, তারা নিজভূমে পরবসী হয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। লুণ্ঠন, দখল, বিতাড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন—কোনোটিই বাকি রাখেনি জায়নাবাদী বাহিনী স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য। পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছ থেকে অস্ত্র, অর্থসহ যাবতীয় নিরন্তর সমর্থন ও সহযোগিতায় বলীয়ান ইসরায়েল সেই থেকে ফিলিস্তিনিদের কোণঠাসা করে বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার আগ্রাসী প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
দুই.অবশ্য নাকবার প্রকৃত সূত্রপাত অন্তত ১০০ বছরের বেশি আগে—১৯১৭ সালে ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে। ওই বছর ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার ব্যালফোর জায়নাবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে ছোট্ট একটি চিঠি দেন।
তাতে বলা হয়, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’
এটি কালক্রমে ব্যালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সালতানাতের পতন হলে ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশ ম্যানডেটে বা শাসনাধীনে। ব্রিটিশ সরকার ব্যালফোর ঘোষণা বাস্তবায়নে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। আভি শ্লেইম তাই বলেছেন, ‘ব্রিটেনের নেপথ্য মদদেই জায়নবাদীরা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিতে অগ্রসর হয় ও সফল হয়।...মূলত ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যানডেটে বা শাসনাধীনে থাকাকালেই জায়নবাদীদের জন্য সুযোগ তৈরি হয় এখানে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের।’ (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০২৪)
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আরবদের দায়ী করা হয় নবগঠিত রাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করার জন্য। দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূমি থেকে একসময় বিতাড়িত হওয়া হিব্রুরা ফিরে এসে তাদের জন্য স্বাধীন দেশ গঠন করেছে, যা তাদের কাছে ‘ঈশ্বরের দেওয়া প্রতিশ্রুতির’ বাস্তবায়ন।ফিলিস্তিনিদের অনিঃশেষ নাকবা তৈরির সুদীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে ইসরায়েলের পত্তন ও বিকাশের ইতিহাসও নিবিড়ভাবে যুক্ত। সাধারণভাবে ইসরায়েলি তথা জায়নাবাদী বয়ানে ফিলিস্তিনের নাকবাকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আরবদের দায়ী করা হয় নবগঠিত রাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করার জন্য। দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূমি থেকে একসময় বিতাড়িত হওয়া হিব্রুরা ফিরে এসে তাদের জন্য স্বাধীন দেশ গঠন করেছে, যা তাদের কাছে ‘ঈশ্বরের দেওয়া প্রতিশ্রুতির’ বাস্তবায়ন।
তিন.তবে জায়নাবাদী ভাষ্যে গড়ে ওঠা ইসরায়েলের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ জানান খোদ ইসরায়েলেরই কয়েকজন ইতিহাসবিদ।
মূলত ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ বেন্নি মরিসের দ্য বার্থ অব দ্য প্যালেস্টিনিয়ান রিফিউজি প্রবলেম: ১৯৪৭-১৯৪৯; ইলান পেপের ব্রিটেন অ্যান্ড দ্য আরব-ইসরায়েল কনফ্লিক্ট: ১৯৪৮-১৯৫১ এবং আভি শ্লেইমের কলিসন অ্যাক্রোস দ্য জর্ডান: কিং আবদুল্লাহ, দ্য জায়নিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব প্যালেস্টাইন বইগুলো প্রকাশিত হলে ইসরায়েলজুড়ে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এর এক বছর আগে সিমহা ফ্লাপানের দ্য বার্থ অব ইসরায়েল: মিথস অ্যান্ড রিয়েলিটিস প্রকাশিত হয়। তাঁর আরেকটি বই জায়নিজম অ্যান্ড দ্য প্যালেস্টিনিয়ানস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তো, এই চারজনকে ‘নিও-হিস্টোরিয়ান’ (নয়া ইতিহাসবিদ) হিসেবে অভিহিত করা হয় সেই আশির দশকেই। এই ঘরানায় আরও যুক্ত হন টম সেগেভ, বেনইয়ামিন হাল্লাহমি, ইউরি মাইলস্টেইন, ইয়োসি আমিতাই, শ্লোমো স্যান্ড প্রমুখ।
ধরা হয়, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সিমহা ফ্লাপানই প্রথম ‘জায়নাবাদী পুরাকথা’-কে আক্রমণ করেন। বলেছিলেন, তিনি ইসরায়েলের ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চান এ জন্য যে বিদ্যমান প্রচারণার কাঠামো দেশটিতে শান্তিবাদী শক্তির বিকাশে বিশাল বাধা তৈরি করে রেখেছে।
এভাবে নয়া ইতিহাসবিদেরা ইসরায়েলের জন্ম–ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা বলেন, জায়নবাদ বড়জোর একটি আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের একটি রূপ। এই জায়নাবাদীরাই ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আরব-ইসরায়েল সংঘাত বজায় রেখেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার পেছনেও জায়নবাদের ভূমিকা আছে।
নিউ হিস্ট্রি’ (নয়া ইতিহাস) অভিধাটি বেন্নি মরিসের কাছ থেকে প্রথম আসে; যদিও এর মানে এই নয় যে এর আগের ইতিহাস সব পুরোনো; বরং ইসরায়েলের পত্তন ও ফিলিস্তিনের বিপর্যয়কে নতুনভাবে দেখার ও বিশ্লেষণের তাগিদ থেকে এই নামকরণ।
আভি শ্লেইমের ভাষায়, ‘আমরা রিভিশনিস্ট (সংশোধনবাদী) বা নিউ (নতুন) ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিতি পাই। কারণ, আমরা (ফিলিস্তিন-ইসরায়েল) সংঘাতের প্রামাণ্য জায়নাবাদী বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করি, আমরা এই সংঘাত বাড়ানো ও জিইয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলকে অধিকতর দায়ী করি। এর আগপর্যন্ত যা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ভাষ্য’ (জাদালিয়া, অক্টোবর ২৩, ২০১৭)।
এই নয়া ইতিহাসবিদেরা আশির দশকে ইসরায়েল সরকার কর্তৃক অবমুক্ত করা বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ ও নথি পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা করে মোটাদাগে তিনটি উপসংহারে উপনীত হন। প্রথমত, ইহুদি রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে আদিবাসী ফিলিস্তিনি আরবদের চড়া মূল্যের বিনিময়ে; দ্বিতীয়ত, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে যায়নি, বরং তাদের জোরপূর্বক বিতাড়ন করা হয়েছে; তৃতীয়ত আরব-ইসরায়েলি বিরাজমান সংঘাতের জন্য প্রধানত দায়ী ইসরায়েল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইলান পেপে বলেন, ‘নয়া ইতিহাসবিদেরা অতীতকে যে দৃষ্টিতে দেখেন, তা জায়নবাদীদের বয়ানের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক বয়ানের সঙ্গে অনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ। তাঁদের কাজে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর দাবি ও ঐতিহাসিক বঞ্চনার বিষয়টিও ঠাঁই পেয়েছে।
এই পণ্ডিতেরা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের জাতীয় প্রতিবাদকে বৈধ ও যৌক্তিক মনে করেন, যেমন মনে করেন মিজরাহিদের (আরব-ইহুদি) সামাজিক ক্ষোভকে। প্রথমে জায়নাবাদী আন্দোলন, তারপর ইসরায়েল রাষ্ট্র তাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে ও চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ ও প্রতিবাদ।’ (মিডল ইস্ট রিপোর্ট ২০৭, সামার, ১৯৯৮, মিডল ইস্ট রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রজেক্ট)
পেপের মতে, নয়া বা সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদেরা জায়নবাদের ইতিহাস পর্যালোচনা ও সমালোচনা করার আগপর্যন্ত ইসরায়েলের মূলধারার ইতিহাসবিদদের কাছে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের অধিকার অবধারিত ছিল। তাঁরা এই অধিকারের সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে মনোনিবেশ করেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। অথচ নিরপেক্ষ পদ্ধতি ও তুলনামূলক তাত্ত্বিক পন্থা ব্যবহার করে নয়া ইতিহাসবিদেরা দেখিয়েছেন, জায়নবাদ আসলে একটি উপনিবেশবাদী আন্দোলন। এটাকে কোনোভাবেই দুই হাজার বছর নির্বাসিত থাকার পর ইহুদিদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায় না।
একইভাবে নয়া ইতিহাসবিদেরা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে বিতাড়ন তথা নাকবাকে দেখেছেন দুভাবে।
বেন্নি মরিসের মতে, এই সময়ে ফিলিস্তিনিরা যে নৃশংসতা ও বিতাড়নের শিকার হয়ে শরণার্থীজীবন বেছে নেয়, তা ছিল যুদ্ধের অনিবার্য ফল। তবে ইলান পেপের মতে, এটা ছিল যুদ্ধের আগে ইহুদি নেতৃত্বের পরিকল্পনার ফসল। তিনি তাঁর এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন (২০০৬) বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। অন্যদিক ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদেরা এই নাকবাকে দেখেছেন ফিলিস্তিনি জায়নাবাদী বসতি স্থাপনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে। আর এই বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই ১৮৯০ সাল থেকে।
সমালোচনা, সীমাবদ্ধতা, বিচ্যুতি ও অসম্পন্নতা সত্ত্বেও নয়া ইতিহাসবিদেরা ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার ও ঐতিহাসিক নিষ্ঠুর বঞ্চনাকে ইসরায়েলের ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, জায়নবাদকে এই অবিচার-অনাচারের জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন।
তাঁদের কাজ ফিলিস্তিনি তথা আরব ইতিহাসবিদের অনুপ্রাণিত করেছে, অনেক ইসরায়েলিকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও বেন্নি মরিসের মতো নয়া ইতিহাসবিদ পরবর্তীকালে এই ঘরানা থেকে সরে গিয়ে ঘুরেফিরে ইসরায়েলের উগ্র জাতীয়তাবাদী বয়ানে ফিরেছেন।
সে কারণেই তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অভিযানে ৫০ হাজারের বেশি প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞকে জেনোসাইড মনে করেন না। কিন্তু আভি শ্লেইম একে শেষ পর্যন্ত জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন যে এটাই হলো প্রথম জেনোসাইড, যা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে।
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আরব ইসর য় ল স ব ধ নত র জ য়নব দ র ব ইসর য় ল ইসর য় ল য র র জন য ব ষয়ট প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনের নাকবা: ১০০ বছর আগে জায়নভূমির প্রকল্পের সূচনা
সেটা আজ থেকে ১৪০ বছর আগের কথা। অস্ট্রিয়ার ইহুদি লেখক-সাংবাদিক নাথান ব্রিনবাম তখন স্বমুক্তি (সেলফ ইমানসিপেশন) নামে একটি সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ শুরু করেন ভিয়েনা থেকে। ইহুদি পুনর্জাগরণ ঘটানো ও ফিলিস্তিনে তাদের পুনর্বসতি স্থাপনের ধারণাটি প্রচারণায় নিয়ে আসাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
এ কাজে ব্রিনবাম আবার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পোলীয় ইহুদি চিকিৎসক ও লেখক লিওন পিনসকারের দ্বারা, যিনি ১৮৮২ সালে একই নামে জার্মান ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন। রাশিয়ায় ইহুদি নিধনযজ্ঞ দেখে ব্যথিত হয়ে ছদ্মনামে এটি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ইহুদি সম্প্রদায়কে স্বাধীনতার ও জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করার এবং স্বাধীন ভূমিতে ফেরার আহ্বান জানান।
এর তিন বছর পর ব্রিনবামের সাময়িকী এ আহ্বানকেই আরেকটু উচ্চকিত করার জন্য মাঠে নামে। তারা তখন থেকে জায়নভূমির বিষয়টি সামনে আনতে শুরু করে। ১৮৯০ সালে ব্রিনবাম ‘জায়নিস্ট’ ও ‘জায়নিজম’ এবং ১৮৯২ সালে ‘পলিটিক্যাল জায়নিজম’ পরিভাষার প্রবর্তন করেন।
সাধারণভাবে জায়নিজম বা জায়নবাদ হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়া ও ইসরায়েলের ভূমিতে (এরেতজ ইসরায়েল) ইহুদি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (জুইশ ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি)।
হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণকারী লেখক-সাংবাদিক থিওডর হারজেল জায়নবাদের ধারণাটিকে নিয়ে জোরালোভাবে অগ্রসর হয়ে একে আন্দোলনে রূপ দেন এবং জায়নবাদের পিতা হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি ১৮৯৬ সালে ‘জুইশ স্টেট’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের নিজস্ব ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।
ব্রিনবাম ও হারজেল সমসাময়িক ছিলেন এবং দুজনেই জায়নাবাদী আন্দোলনের পুরোধার ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিনবাম এই পথ থেকে সরে এসে জীবনের শেষ পর্যায়ে জায়নবাদবিরোধী হয়ে ওঠেন। তবে হারজেল এই আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন, যা তাঁর মৃত্যুর (১৯০৪) ৫০ বছরের মধ্যে সাফল্যের মুখ দেখে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়—ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেই।
একই সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের ওপর অনিঃশেষ বিপর্যয় নেমে আসে। সেই বিপর্যয় স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মে পালিত হয় আল-নাকবা দিবস। ১৯৯৮ সালে ইসরায়েল যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘটা করে উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেয়, তখন ফিলিস্তিনিদের কিংবদন্তি নেতা ও ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরাও তাঁদের নাকবার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবেন। তিনি ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনটিকে নাকবা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে নাকবা পালিত হয়ে আসছে। আর জাতিসংঘ ২০২৩ সাল থেকে দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু করে।
ইসরায়েলের সংশোধনবাদী (রিভিশনিস্ট) ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইমের ভাষায়, ‘ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো হলোকাস্ট। আর ফিলিস্তিনি জনগণেরটা হলো নাকবা। আর এই নাকবা শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং তা হলো আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে ক্রমাগত বিতাড়ন ও অপসারণ করার নির্মম চলমান প্রক্রিয়া।’
আরও পড়ুনইসরায়েল শান্তি নয়, ভূমিই বেছে নিয়েছে১৫ মে ২০২৪আসলেই এ প্রক্রিয়া ৭৭ বছর ধরে চলমান। জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে ব্রিটিশ–শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্তত ১০ লাখ মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। তারা প্রায় কেউই আর স্বদেশে ফিরতে পারেনি। আর যারা রয়ে গিয়েছিল, তারা নিজভূমে পরবসী হয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। লুণ্ঠন, দখল, বিতাড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন—কোনোটিই বাকি রাখেনি জায়নাবাদী বাহিনী স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য। পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছ থেকে অস্ত্র, অর্থসহ যাবতীয় নিরন্তর সমর্থন ও সহযোগিতায় বলীয়ান ইসরায়েল সেই থেকে ফিলিস্তিনিদের কোণঠাসা করে বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার আগ্রাসী প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
দুই.অবশ্য নাকবার প্রকৃত সূত্রপাত অন্তত ১০০ বছরের বেশি আগে—১৯১৭ সালে ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে। ওই বছর ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার ব্যালফোর জায়নাবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে ছোট্ট একটি চিঠি দেন।
তাতে বলা হয়, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’
এটি কালক্রমে ব্যালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সালতানাতের পতন হলে ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশ ম্যানডেটে বা শাসনাধীনে। ব্রিটিশ সরকার ব্যালফোর ঘোষণা বাস্তবায়নে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। আভি শ্লেইম তাই বলেছেন, ‘ব্রিটেনের নেপথ্য মদদেই জায়নবাদীরা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিতে অগ্রসর হয় ও সফল হয়।...মূলত ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যানডেটে বা শাসনাধীনে থাকাকালেই জায়নবাদীদের জন্য সুযোগ তৈরি হয় এখানে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের।’ (প্রথম আলো, ১৫ মে ২০২৪)
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আরবদের দায়ী করা হয় নবগঠিত রাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করার জন্য। দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূমি থেকে একসময় বিতাড়িত হওয়া হিব্রুরা ফিরে এসে তাদের জন্য স্বাধীন দেশ গঠন করেছে, যা তাদের কাছে ‘ঈশ্বরের দেওয়া প্রতিশ্রুতির’ বাস্তবায়ন।ফিলিস্তিনিদের অনিঃশেষ নাকবা তৈরির সুদীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে ইসরায়েলের পত্তন ও বিকাশের ইতিহাসও নিবিড়ভাবে যুক্ত। সাধারণভাবে ইসরায়েলি তথা জায়নাবাদী বয়ানে ফিলিস্তিনের নাকবাকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আরবদের দায়ী করা হয় নবগঠিত রাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করার জন্য। দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূমি থেকে একসময় বিতাড়িত হওয়া হিব্রুরা ফিরে এসে তাদের জন্য স্বাধীন দেশ গঠন করেছে, যা তাদের কাছে ‘ঈশ্বরের দেওয়া প্রতিশ্রুতির’ বাস্তবায়ন।
তিন.তবে জায়নাবাদী ভাষ্যে গড়ে ওঠা ইসরায়েলের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ জানান খোদ ইসরায়েলেরই কয়েকজন ইতিহাসবিদ।
মূলত ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ বেন্নি মরিসের দ্য বার্থ অব দ্য প্যালেস্টিনিয়ান রিফিউজি প্রবলেম: ১৯৪৭-১৯৪৯; ইলান পেপের ব্রিটেন অ্যান্ড দ্য আরব-ইসরায়েল কনফ্লিক্ট: ১৯৪৮-১৯৫১ এবং আভি শ্লেইমের কলিসন অ্যাক্রোস দ্য জর্ডান: কিং আবদুল্লাহ, দ্য জায়নিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব প্যালেস্টাইন বইগুলো প্রকাশিত হলে ইসরায়েলজুড়ে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এর এক বছর আগে সিমহা ফ্লাপানের দ্য বার্থ অব ইসরায়েল: মিথস অ্যান্ড রিয়েলিটিস প্রকাশিত হয়। তাঁর আরেকটি বই জায়নিজম অ্যান্ড দ্য প্যালেস্টিনিয়ানস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তো, এই চারজনকে ‘নিও-হিস্টোরিয়ান’ (নয়া ইতিহাসবিদ) হিসেবে অভিহিত করা হয় সেই আশির দশকেই। এই ঘরানায় আরও যুক্ত হন টম সেগেভ, বেনইয়ামিন হাল্লাহমি, ইউরি মাইলস্টেইন, ইয়োসি আমিতাই, শ্লোমো স্যান্ড প্রমুখ।
ধরা হয়, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সিমহা ফ্লাপানই প্রথম ‘জায়নাবাদী পুরাকথা’-কে আক্রমণ করেন। বলেছিলেন, তিনি ইসরায়েলের ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চান এ জন্য যে বিদ্যমান প্রচারণার কাঠামো দেশটিতে শান্তিবাদী শক্তির বিকাশে বিশাল বাধা তৈরি করে রেখেছে।
এভাবে নয়া ইতিহাসবিদেরা ইসরায়েলের জন্ম–ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা বলেন, জায়নবাদ বড়জোর একটি আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের একটি রূপ। এই জায়নাবাদীরাই ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আরব-ইসরায়েল সংঘাত বজায় রেখেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার পেছনেও জায়নবাদের ভূমিকা আছে।
নিউ হিস্ট্রি’ (নয়া ইতিহাস) অভিধাটি বেন্নি মরিসের কাছ থেকে প্রথম আসে; যদিও এর মানে এই নয় যে এর আগের ইতিহাস সব পুরোনো; বরং ইসরায়েলের পত্তন ও ফিলিস্তিনের বিপর্যয়কে নতুনভাবে দেখার ও বিশ্লেষণের তাগিদ থেকে এই নামকরণ।
আভি শ্লেইমের ভাষায়, ‘আমরা রিভিশনিস্ট (সংশোধনবাদী) বা নিউ (নতুন) ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিতি পাই। কারণ, আমরা (ফিলিস্তিন-ইসরায়েল) সংঘাতের প্রামাণ্য জায়নাবাদী বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করি, আমরা এই সংঘাত বাড়ানো ও জিইয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলকে অধিকতর দায়ী করি। এর আগপর্যন্ত যা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ভাষ্য’ (জাদালিয়া, অক্টোবর ২৩, ২০১৭)।
এই নয়া ইতিহাসবিদেরা আশির দশকে ইসরায়েল সরকার কর্তৃক অবমুক্ত করা বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ ও নথি পর্যালোচনা ও নিরীক্ষা করে মোটাদাগে তিনটি উপসংহারে উপনীত হন। প্রথমত, ইহুদি রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে আদিবাসী ফিলিস্তিনি আরবদের চড়া মূল্যের বিনিময়ে; দ্বিতীয়ত, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে যায়নি, বরং তাদের জোরপূর্বক বিতাড়ন করা হয়েছে; তৃতীয়ত আরব-ইসরায়েলি বিরাজমান সংঘাতের জন্য প্রধানত দায়ী ইসরায়েল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইলান পেপে বলেন, ‘নয়া ইতিহাসবিদেরা অতীতকে যে দৃষ্টিতে দেখেন, তা জায়নবাদীদের বয়ানের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক বয়ানের সঙ্গে অনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ। তাঁদের কাজে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর দাবি ও ঐতিহাসিক বঞ্চনার বিষয়টিও ঠাঁই পেয়েছে।
এই পণ্ডিতেরা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের জাতীয় প্রতিবাদকে বৈধ ও যৌক্তিক মনে করেন, যেমন মনে করেন মিজরাহিদের (আরব-ইহুদি) সামাজিক ক্ষোভকে। প্রথমে জায়নাবাদী আন্দোলন, তারপর ইসরায়েল রাষ্ট্র তাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে ও চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ ও প্রতিবাদ।’ (মিডল ইস্ট রিপোর্ট ২০৭, সামার, ১৯৯৮, মিডল ইস্ট রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রজেক্ট)
পেপের মতে, নয়া বা সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদেরা জায়নবাদের ইতিহাস পর্যালোচনা ও সমালোচনা করার আগপর্যন্ত ইসরায়েলের মূলধারার ইতিহাসবিদদের কাছে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের অধিকার অবধারিত ছিল। তাঁরা এই অধিকারের সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে মনোনিবেশ করেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। অথচ নিরপেক্ষ পদ্ধতি ও তুলনামূলক তাত্ত্বিক পন্থা ব্যবহার করে নয়া ইতিহাসবিদেরা দেখিয়েছেন, জায়নবাদ আসলে একটি উপনিবেশবাদী আন্দোলন। এটাকে কোনোভাবেই দুই হাজার বছর নির্বাসিত থাকার পর ইহুদিদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায় না।
একইভাবে নয়া ইতিহাসবিদেরা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে বিতাড়ন তথা নাকবাকে দেখেছেন দুভাবে।
বেন্নি মরিসের মতে, এই সময়ে ফিলিস্তিনিরা যে নৃশংসতা ও বিতাড়নের শিকার হয়ে শরণার্থীজীবন বেছে নেয়, তা ছিল যুদ্ধের অনিবার্য ফল। তবে ইলান পেপের মতে, এটা ছিল যুদ্ধের আগে ইহুদি নেতৃত্বের পরিকল্পনার ফসল। তিনি তাঁর এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন (২০০৬) বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। অন্যদিক ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদেরা এই নাকবাকে দেখেছেন ফিলিস্তিনি জায়নাবাদী বসতি স্থাপনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে। আর এই বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই ১৮৯০ সাল থেকে।
সমালোচনা, সীমাবদ্ধতা, বিচ্যুতি ও অসম্পন্নতা সত্ত্বেও নয়া ইতিহাসবিদেরা ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার ও ঐতিহাসিক নিষ্ঠুর বঞ্চনাকে ইসরায়েলের ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, জায়নবাদকে এই অবিচার-অনাচারের জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন।
তাঁদের কাজ ফিলিস্তিনি তথা আরব ইতিহাসবিদের অনুপ্রাণিত করেছে, অনেক ইসরায়েলিকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও বেন্নি মরিসের মতো নয়া ইতিহাসবিদ পরবর্তীকালে এই ঘরানা থেকে সরে গিয়ে ঘুরেফিরে ইসরায়েলের উগ্র জাতীয়তাবাদী বয়ানে ফিরেছেন।
সে কারণেই তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অভিযানে ৫০ হাজারের বেশি প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞকে জেনোসাইড মনে করেন না। কিন্তু আভি শ্লেইম একে শেষ পর্যন্ত জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন যে এটাই হলো প্রথম জেনোসাইড, যা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে।
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]