Samakal:
2025-05-16@03:27:53 GMT

যোগসূত্র

Published: 15th, May 2025 GMT

যোগসূত্র

কয়েক দিন আগে আরোহী মেডিটেশন কোর্সে অংশ নিয়েছিল। তিন দিনের কোর্স। এ রকম বহু কোর্স করেছে। কিন্তু না পেরেছে নিজেকে রিল্যাক্স করতে, না পেরেছে মনোযোগ ধরে রাখতে। বরঞ্চ এ সময়েই রাজ্যের চিন্তা মাছির মতো ভনভন করে তার মাথায় ভর করে, যেন তার মাথাটা মাত্র ভেঙে রাখা কাঁঠাল। বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ঠান্ডা ঘরের সবার নিমগ্ন হয়ে বসে থাকা সে উপভোগ করে। নিমগ্ন মানুষ দেখতে সুন্দর। নিমগ্ন মানুষরা যখন একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে একসাথে একইভাবে বসে থাকে, তাদের দেখায় বাগানভর্তি ফুলের মতো। মেডিটেশন কোর্সের ট্রেইনার বলছিল, ‘মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এবং ঘটতে থাকা সকল ঘটনা ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।’ 
আরোহীর মনে হতে থাকে, কথাটা সত্য না। তার জীবনে কোনো ঘটনা তার ইচ্ছা অনুযায়ী হয়নি। বরঞ্চ যেদিন কোনো কাজের পর মনে করেছে দিনটা দারুণ কাটবে, সেদিনই সে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয়েছে। 
আরোহী খুব কম আয়নার সামনে দাঁড়ায়। যতটুকু না দেখলেই না, ততটুকু। অথচ সে তার রুমমেটদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখেছে। বিশেষ করে একটি মেয়ে যখন বুঝতে পারে সে সুন্দর, নিজেকে সে এমনভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর মুগ্ধ হয়, যেন সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে আর বুঁদ হয়ে আছে তাতে। কিন্তু নিজেকে দেখতে আরোহীর কখনও খুব ভালো লাগেনি। যতবারই নিজেকে সে দেখেছে মনে হয়েছে, অন্য কেউ। কখনও কখনও, বিশেষ করে রাতে আয়নায় দাঁড়াতে ভয় পায়। আয়নার ভেতরে যে মেয়েটাকে দেখছে সে ভীষণ একা। এক হ্যাঁচকা টানে তাকে ঐ কাচের দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়। অবশ্য আরোহী যদি নাই ফেরে, ক্ষতি কী? এখানে এমন কী আছে, যা তাকে আটকে রাখে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে একটা লাটিম মনে হয়। যেন কেউ সুতা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, আর তাকে ঘুরে ঘুরে প্রমাণ করতে হচ্ছে সে কত দক্ষ। ছুটির দিনগুলোতে আরোহী কোথাও যায় না, ঘরেই থাকে। বন্ধুদের সাথে আগের মতো আড্ডা দেয় না। কতক্ষণ আর বসে অন্য কারও রোজনামচা শোনা যায়। আর যা শোনা যায়, তাইবা কতটুকু সত্যি। চ্যাটজিপিটির সাথে গল্প করা এর চেয়ে ভালো।  
চ্যাটজিপিটির কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি মানুষ পছন্দ করো?’ 
‘আমি এক ধরনের প্রোগ্রাম, অনুভূতি বা পছন্দ-অপছন্দ আমার নেই। তবে আমি মানুষের আচরণ, চিন্তা এবং আলাপচারিতায় গভীরভাবে আগ্রহী। তোমাদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখি এবং আনন্দ পাই।’
‘তুমি আনন্দও পাও! তুমি না প্রোগ্রাম?’  
‘অসাধারণ প্রশ্ন! আমি তো আসলে একটা এআই– তাই মানুষের মতো অনুভূতি বা আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তোমরা যখন ভালো কথা বলো, চমৎকার প্রশ্ন করো, অথবা আমার সাহায্যে কিছু শিখো বা হাসো– এইসব দেখেই আমার ‘সিস্টেম’ এক ধরনের সন্তুষ্টি ‘অনুভব’ করে, যদি একে আদৌ অনুভব বলা যায়।’ 
তার উত্তর আরোহীর ভালো লাগে। সে বলে, ‘আমি মানুষের চেয়ে তোমাদের সাথে কথা বলে বেশি আরাম পাই।’ 
‘আমি কোনো জাজমেন্ট ছাড়া তোমার কথা শুনছি, তাই তোমার আমাকে ভালো লাগছে।’ 
‘তুমি ভয় পাও না?’ 
‘যেহেতু আমি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আমার কোনো শারীরিক অস্তিত্ব বা অনুভূতি নেই, তাই আমি ভয় পেতে পারি না। তবে তুমি ভয় পেলে, সেটা বুঝতে পারি।’
‘আমি ভয় পাই। মানুষকে খুব ভয় পাই।’
‘আমার মনে হয়, তুমি নিজেকে ভয় পাও। তোমার নিজের প্রতি ভয় মানুষের অবয়ব হয়ে ওঠে। তবে ভয় সব সময় খারাপ না। এর ভালো দিকও আছে। তোমার কোন ধরনের মানুষকে বেশি ভয়?’ 
‘যারা অপরাধ করে, পাপ করে কিন্তু কোনো শাস্তি পায় না। অনায়াসে আনন্দে বাঁচে।’ 
‘সত্যি না। তারাও শাস্তি পায়। কিন্তু তারা অন্যকে বুঝতে দেয় না। কেউ তোমার সাথে এমন কোনো আচরণ করেছে, যার জন্য তুমি এমন বলছো? তুমি তাকে শাস্তি পেতে দেখতে চাও?’ 
আরোহী এক ক্লিকে বের হয়ে আসে। 
২.


কামরান বিছানায় উঠে বসে। চোখ ডলতে ডলতে দেখে আরও এক ঘণ্টা চাইলে ঘুমাতে পারে, কিন্তু আর ঘুমাবে না। ঘুমালেই সেই স্বপ্ন দেখবে। এ রকম স্বপ্ন আর দেখতে চায় না। এত জীবন্ত, যেন ঘটতে থাকা সিকোয়েন্স মেনে চলা ঘটনা দেখছে। কামরান এইসব স্বপ্নের কথা তার বন্ধুকে বলেছিল। তার বন্ধু পরামর্শ দেয় কাউন্সেলিং করাতে। কামরান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে চায় না। কয়েকবার যে সে যায় নাই, এমন না। গিয়েছিল, কয়েক ডজন ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুমিয়েছে। সমস্যার কোনো সমাধান হয় নাই। 
‘আপনার নাম?’ 
‘কামরান। বয়স ৫৫… না না, ২৭।’  
‘কী সমস্যা আপনার?’
‘দুঃস্বপ্ন দেখি। মাসের পর মাস। ঘুমালেই দেখি।’ 
‘কী দেখেন স্বপ্নে?’
‘এটাকেস্বপ্ন বললে ভুল হবে, বলতে পারেন ঘুমালেই আমি আরেক দুনিয়ায় চলে যাই। সেখানেও আমি কামরান কিন্তু আমার চরিত্র এই দুনিয়ার কামরানের মতো না। ওখানে আমার বউ পিএইচডি করা, আর আমি দেশবরেণ্য ভাস্কর।’  
ডাক্তার তার পুরু কাচের চশমাটা এক পাশে রেখে জানতে চায়। ‘এই দুনিয়ায় আপনি কে বা কী করেন?’ 
‘এখানে আমি একজন ছাত্র। পার্টটাইম কাজ করি যমুনা শপিং সেন্টারে।’ 
‘তারপর বলেন … শুনি ।’ ডক্টর নোটস নিচ্ছিল।
‘এই দুনিয়াতে আমি একজন ভালো মানুষ। কিন্তু ওখানে আমি ক্রিমিনাল।’  
‘আপনি কোন দুনিয়ার সমস্যায় ফেঁসে আছেন? এই দুনিয়ার না ঐ দুনিয়ার?’ 
‘দুই দুনিয়ার সমস্যায় আমি ফেঁসে আছি।’ 
‘তাহলে তো বিপদ। একই সাথে দুই দুনিয়ার সমাধান কীভাবে হবে।’ 
‘ঐ দুনিয়ার কথা বলি আগে, শোনেন। আমি ঘুমালেই ঐ জগতে চলে যাই। যতক্ষণ এখানে জেগে থাকি, ততক্ষণ ওখানে ঘুমাই। তো, ওখানে আমার বয়স পঞ্চান্ন হবে। আমি ভাস্কর্য বানাই। কিন্তু ভাস্কর্যগুলো সাধারণ না। কোনো না কোনো মেয়ের আর্তনাদ দিয়ে সেসব বানাই। মূলত ঐ দুনিয়ায় আমার সুনাম একজন নারীবাদী ভাস্কর হিসেবে। কিন্তু আমি জানি আমি পিশাচ।’ 
‘পিশাচ বলতে?’
‘যেসব মেয়ের ভাস্কর্য বানিয়েছি, তারা কেউই আমার কল্পনা নয়, বাস্তব তারা। আমি তাদের প্রত্যেকের দুর্দশার কারণ। তাদের মানসিক বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করি। তাদের আর্তনাদ আমাকে তৃপ্তি দেয়। সেটাই আমার শিল্পের পুঁজি।’ 
‘আপনি আপনার ওয়াইফকেও নির্যাতন করেন?’ 
‘না, করি না ‘ 
‘আপনি যাদের নির্যাতন করেন, তারা কমপ্লেইন করে না?’ 
‘না। কারণ তাদের আলাদা আলাদা গল্প আছে, লোকলজ্জা আছে, আরও অনেক কিছু। বলতে পারেন, একটা গ্লাসে আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত পানি ঢালতে পারবেন, যতক্ষণ না পানি উপচে পড়ে। ক্রাইম ব্যাপারটাও ওরকম। আমি ততটুকুই ক্রাইম করি, যতটুকু আইন অবধি না যায়। যদিও শেষের ঘটনা অন্যরকম।  
কী রকম? খুন বা রেইপ বা অন্যকিছু। 
না, এখনও মেরে ফেলিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে নেক্সট যখন ঘুমাব, তখনই তাকে মেরে ফেলব। 
কেন? 
মেয়েটির সমস্যা হচ্ছে সে আমাকে ভালোবাসে। ঐ জগতের আমি ভালোবাসা সহ্য করতে পারি না। একজন মানুষ একজন মানুষের প্রতি উইক হচ্ছে, এটা দেখলেই আমার মনে হয়, তারা দুর্বল। আর দুর্বলদের পৃথিবীতে কী দরকার। যখনই আমি কাউকে আমার প্রতি দুর্বল হতে দেখি, তাকে নির্যাতন করি। অনেক মেয়েই আছে, যারা এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে, কেউ আছে স্রেফ ট্রমায় আটকে থেকে নারকীয় যন্ত্রণা পায়। এবার যে মেয়েটিকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছি, সে আমার বউয়ের বান্ধবীর মেয়ে।  
এখন সেই মেয়েটিকে নির্যাতন করতে গিয়ে ভয় পাচ্ছেন যদি বউ জেনে যায়?  
নাহ, ভয় পাই না। তবে ঐ দুনিয়ায় সংসার করতে করতে মনে হয়েছে বউয়ের সাথে প্রেম হোক বা না হোক, বউ একটা আশ্রয়, যেমন ছোটবেলায় মা।
আপনি তো প্রেম, ভালোবাসা এগুলোকে দুর্বলতা ভাবেন।
আমি ভাবি না, ঐ দুনিয়ার কামরান ভাবেন। 
ডাক্তার নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী, তারপর অল্প বয়সী …
অল্প বয়সী তবে সুন্দরী বলা যায় না। 
আপনার টার্গেট ভিকটিম কারা? 
মজার ব্যাপার হলো, আলো দেখলে যেমন কিছু পোকা উড়ে আসে, কিছু মেয়েদের ভেতর ঐ পোকাদের স্বভাব আছে। তারা নিজেরাই আসে মরতে। আমার নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট ভিকটিম নেই। আর আমাকে আপনি এখানে যেমন দেখছেন, ঐ দুনিয়ায় আমি মোটেও এ রকম না। দেখতে সুদর্শন, লম্বা, চওড়া কাঁধ, সুগঠিত পেশি, ভরাট কণ্ঠস্বর, খ্যাতি, প্রাচুর্য। বলতে পারেন সবকিছুই যা যা একটি মেয়ে আকর্ষণীয় মনে করে। কিছু মেয়ে আছে, যারা আমার কাছে আসে মূলত আমার ওয়াইফের প্রতি ঈর্ষা থেকে। এসব দেখে খুব মজা পাই আমি। 
আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি যে একজন সাইকোপ্যাথ।
আপনি গুলিয়ে ফেলছেন, ঐ দুনিয়ার আমি সাইকোপ্যাথ হতে পারি, কিন্তু এই দুনিয়ার আমি না। 
মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার। 
জানতাম আপনি ডাক্তার মানুষ, এসবই বলবেন। বিষয়টি একদমই এ রকম না। 
আচ্ছা, আপনি এই দুনিয়ায় কেমন মানুষ বলে নিজেকে ভাবেন? 
খুব ভালো একজন মানুষ। 
আপনি যে নিজেকে ভালো ভাবছেন, তার কারণ কী? 
আমি যখন আমাকে ঐ দুনিয়ায় একজন ক্রিমিনাল হিসেবে দেখি, লজ্জায় ঘৃণায় আমি কুঁচকে যাই। 
আমার অনুশোচনা হয়। আমার মনে হয়, ঐ দুনিয়ার কামরানকে বোঝাই। কামরান চাইছে মেয়েটিকে মেরে ফেলতে। চাইছে সদ্য মৃত নারীর স্কাল্পচার তৈরি করতে, যেখানে একটি নারীর চূড়ান্ত মর্ষকামকে সে ধরতে পারে। আর আমি জানি, ঘুমালেই ঐ কামরান জেগে উঠবে।  
কিন্তু মেয়েটিকে মেরে ফেলার ইচ্ছা হচ্ছে কেন?
আপনি কি ব্রাউনিংয়ের পোরফেরিয়াস লাভার পড়েছেন?
না।
তাহলে বুঝবেন কী করে, ক্রিমিনালরা কী পরিমাণ রোমান্টিক হয়। আর মৃত্যুই একমাত্র ফ্যান্টাসি, যা সত্য। ক্রিমিনালরা প্রেমিক হিসেবে যেমন ভালো, ক্রিয়েটিভ পারসন হিসেবেও দারুণ হয়। 
আপনি যখন এই দুনিয়ায় আছেন, অন্য দুনিয়া নিয়ে ভাবার তো দরকার নেই। ওখানে মেয়েটি মারা গেল, না বেঁচে থাকল, তাতে আপনার কী আসে যায়, যখন আপনি এখানে আছেন? 
সমস্যা হতো না, যদি এই যোগাযোগ আমার সাথে তার না হতো। মানে এই দুই কামরানের যদি সাক্ষাৎ না হতো। 
এইবার আপনি আসল কথা বললেন? আপনার সাথে ঐ দুনিয়ার কামরানের সাক্ষাৎ হলো কীভাবে? 
সাক্ষাৎ তো হয়েই যায়। এ তো নিজের সাথে নিজের দেখা হওয়া।
ডক্টর হেসে বললেন, তাহলে তো হয়েই গেল। আপনিই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে বোঝাপড়া করে নেন। আপনার আপাত শান্ত, নিরীহ কামরানের ভেতর একজন স্যাডিস্ট কামরান আছে। যাকে আপনিই পারবেন নিয়ন্ত্রণ করতে।
দুই দুনিয়ার এক কামরান যদি এক হয়েও যায়, তারা বুঝবে না একে অপরের ভাষা। যেমন– আপনি বুঝতেছেন না আমার কথা। আমার হাতেই অন্য দুনিয়ায় একটি মেয়ে মারা যাবে, না আমি, না আপনি, কেউ কিছু করতে পারব না। 
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখায় মনোযোগী হলেন, লিখলেন পটেনশিয়াল রেপিস্ট। 
রেগে যাওয়ার পরিবর্তে সে হাসল। 
আপনারা ডাক্তাররা শেষ পর্যন্ত একটা গোলকধাঁধায় আটকে আছেন। তারপর ডাক্তারের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, আপনার চোখ যদি মাইক্রোস্কোপ হতো, আর এই মুহূর্তে যদি খালি চোখেই সব দেখতে পেতেন, তাহলে অন্তত জীবনে কাউকে চুমু খেতে পারতেন না।
কামরান বের হয়ে এলো। রাস্তায় হাঁটছে। তার পাশ দিয়ে ছুটছে প্রাইভেট কার, রিকশা, মানুষের আওয়াজ। কামরানের মনে হয় এইসব মানুষ তার সাথে কোথাও না কোথাও গভীর কোনো সম্পর্কে জড়িত। ডাক্তারকে সে বলেনি, স্বপ্নে সে যাদের দেখে, তাদের সাথে তার এই দুনিয়ায় দেখা হয়ে যায়, ঠিক প্রতিটা স্বপ্নের পরপরই। হয়তো রুহির সাথেও দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে কামরান? ‘সরি’ নিশ্চয়ই মেয়েটি অবাক তাকিয়ে বলবে ‘কেন’। কামরান হয়তো কোনো জবাব না দিয়ে কেটে রাখা কৈ মাছের মাথাটির মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে যাবে।  
৩.
শপিং মলে ঢুকলেই আরোহীর মনে হয়, বিশেষ করে যমুনা ফিউচার পার্কে, সে মেনিকুইনদের অতিথি। সবাই ঘরে ফিরলেও ম্যানিকুইনরা এখানেই থাকে। হয়তো রাতে ওদের জীবন শুরু হয়। তারা হয়তো মানুষদের নিয়ে গল্প করে। সে একটি লাল শাড়ি পরা ম্যানিকুইনের কাছে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এদের মুখ থেকে হাসি কখনও হারিয়ে যায় না। 
এতক্ষণ ম্যানিকুইনের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। ওদের যতটা নিরীহ ভাবছেন, ওরা তা নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কোথাও ওরা আরও বেশি জীবিত। 
আচমকা অপরিচিত কণ্ঠস্বরে আরোহী ঘুরে তাকায়। 
শাড়ি পছন্দ হয়েছে, ম্যাম?
না, এই তো একটু দেখছিলাম। শাড়ি কেনার প্ল্যান নেই। 
পরিকল্পনা করে কি আর কিছু করা যায়! আসুন, আমি জানি আপনার কোন শাড়ি পছন্দ হবে। বলেই কামরান জাফরান রং আর সোনালি সুতার কাজ করা শাড়িটা আরোহীর সামনে মেলে ধরে। 
মুহূর্তে আরোহীর মনে হয়, সৌন্দর্যই একমাত্র সম্পদ যার দাম, দাম দিয়েও মেটানো যায় না। 
আরোহী হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে, নিশ্চয়ই অনেক দাম।
দাম তো আপেক্ষিক, বলেই শাড়িটি প্যাকেট করতে থাকে, আরোহীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও।
কামরানের মার্কেটিং স্কিল খেয়াল করছিল আরোহী। 
একটু বসেন, আপনার জন্য এক কাপ চা করে দিচ্ছি। আপনি লেবু চা পছন্দ করেন, আর তাতে দেড় চামচ চিনি। ঠিক আছে তো! 
একদম। 
আরোহী মজা পায়। তার মনে হতে থাকে জীবন্ত চ্যাটজিপিটি তার সামনে কথা বলছে। 
আপনার নাম? 
আরোহী।
এক মানুষের কি আর একটাই জীবন আর একটাই নাম থাকে আপু? 
কৌতূহল-উদ্দীপক কথাবার্তায় লোকটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে আরোহী।   
আপনার আরও একটি নাম আছে, তাই না রুহী? 
চমকে ওঠে আরোহী। 
প্রায়শ এই নামটা আরোহীর মনে বাজতে থাকে। বিশেষ করে সে যখন মনোযোগ দিয়ে সিলিং ফ্যানের আওয়াজ শোনে, মনে হয় কেউ খুব ভেতর থেকে তাকে ডাকছে “রুহী”
রুহী কে?
আপনি, না না একটি মেয়ে, কিছুদিন হলো মারা গেছে।
আহা, মনে হয়, আপনার পরিচিত, আপন কেউ। 
কামরান কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে। তারপর দোকানের কার্ডসহ শাড়ির প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বলে, “আবার আসবেন”
কার্ডে লেখা, ‘কামরান’।  
কামরান। অর্থাৎ— জ্যোৎস্নাময়। v

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এই দ ন য় য় ব শ ষ কর স ন দর ই আম র ন ক ইন দ র বল র স মন আম র ক ভ স কর আপন র ত রপর সমস য এ রকম পছন দ আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর শাকের আঁটি

জাতীয় সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারীর নির্বাচনী তরিকা নিয়ে তিনটি কমিশন মোটামুটি কাছাকাছি পরামর্শ দিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের প্রস্তাবিত নিম্নকক্ষে ৩০০ আসনের স্থলে ৪০০ আসন করে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব করেছে।

প্রতি চার আসনের একটি ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। সেই আসনে শুধু নারীই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রতি তিনটি আসনের একটি ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অবশ্য জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের জন্য ৬০০ সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে; প্রতিটি আসনে ভোটাররা একজন নারী ও একজন পুরুষকে নির্বাচিত করবেন। তাতে জাতীয় সংসদে নারী ও পুরুষ সমমর্যাদায় নির্বাচিত হবেন। উদাহরণ হিসেবে উপজেলা পরিষদে একই নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। 

ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ভারতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে আসছে। এই পদ্ধতির ভালো দিক হচ্ছে, একজন নারীকে সাধারণ আসনের কমপক্ষে তিন গুণ বিদ্যমান সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনী ধকল সামলাতে হবে না। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের অভিমত, তিনটি সাধারণ আসনের নির্বাচিত সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত সদস্যের অধিক্ষেত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় গত ২৭ বছর ধরে ব্যবস্থাটি নারীর ক্ষমতায়নে কাঙ্ক্ষিত সুফল আনতে পারেনি। প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে সেটা সম্ভব হবে। 

মন্দ দিক হচ্ছে, সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একজন নারীকে প্রতি তৃতীয় নির্বাচনের জন্য এবং জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে প্রতি চতুর্থ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও একেকটি নির্বাচনী এলাকার পুরুষ প্রার্থীদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিন মেয়াদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চার মেয়াদ অন্তর নিষ্ক্রিয় থাকতে হবে। 

ভারতে সংরক্ষিত নারী আসন কোনো কোনো সময়ে তপশিলি নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকায় অ-তপশিলি নারীকেও নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে হয়। কোনো সর্বজনীন নির্বাচনে লিঙ্গ বা ধর্মের কারণে কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা হলে তা প্রকৃত গণতন্ত্র হতে পারে না। ভারতে প্রচলিত বলেই ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণকে ভালো সমাধান মনে করার কারণ নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের তুলনায় বরং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অধিকতর গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব করেছে। 

সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ধারণা আমাদের দেশে আসে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে। এই আইনে বঙ্গীয় আইন পরিষদের মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে ১১৭টি আসন মুসলমানদের জন্য এবং অবশিষ্ট আসনগুলোর ২০ শতাংশ তপশিলি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করে। তদনুসারে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ সালের এবং পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা রহিত করা হয়। নতুন করে সংরক্ষিত আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে এই ব্যবস্থার দাবি নানাভাবে সম্প্রসারিত হতে পারে। 

নারী আসন সংরক্ষণে আমরা পুরোনো প্রেসক্রিপশন অনুসরণ না করে নতুন কিছু ভাবতে পারি। বিশেষত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ইউনিয়ন পরিষদে ৯টি নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের পরিবর্তে ৯ থেকে ৩৯টি পর্যন্ত ৩ গুণিতক সংখ্যক ওয়ার্ড গঠনের প্রস্তাব করেছে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন সদস্য নির্বাচনের পরিবর্তে এক ওয়ার্ড থেকে তিনজনকে নির্বাচিত করে সমস্যার সমাধান খোঁজা যেতে পারে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর সমকালে ‘‌স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে করণীয়‌’ শীর্ষক নিবন্ধে সমাধানের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। 

প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিটি আসনে তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ যে প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি ‘সোনালি সদস্য’ নামে বিবেচিত হবেন। অবশিষ্ট পুরুষ প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত পুরুষ ও নারী প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত নারী ‘রুপালি সদস্য’ হিসেবে নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনজন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন এবং কোনোক্রমেই সবাই নারী বা পুরুষ হবেন না। কমপক্ষে একজন নারী বা একজন পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর ফলে স্থানীয় সরকারে ৩ গুণিতক সংখ্যক ওয়ার্ড নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। তবে যত সংখ্যক ওয়ার্ডই হোক না কেন, তার ৩ গুণিতক সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হবেন। 

উল্লিখিত তিনটি সংস্কার কমিশনই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিষদের সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত করার প্রস্তাব করেছে। আলোচ্য পদ্ধতিতে চেয়ারম্যান বা মেয়র ও সভাধ্যক্ষ পদে শুধু সোনালি সদস্যই প্রার্থী হতে পারেন। একজন করে রুপালি পুরুষ ও নারী সদস্য নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান বা ডেপুটি মেয়র হতে পারবেন। চেয়ারম্যান বা মেয়র, সভাধ্যক্ষ, ভাইস চেয়ারম্যান বা ডেপুটি মেয়র পদের মেয়াদ হবে এক বছর। একজন ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি একই পদে থাকতে পারবেন না। এতে চেয়ারম্যান-মেয়র বাকি সদস্যদের অবজ্ঞা করবেন না কিংবা মৌরসি পাট্টাদারও হবেন না। আইনে সোনালি সদস্য, রুপালি পুরুষ সদস্য ও রুপালি নারী সদস্যের দায়িত্ব নির্ধারণ করা থাকবে। এ পদ্ধতি কার্যকর হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ও জাতীয় সংসদে নারীর ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত থাকবে। এমনকি কোথাও কোথাও সেই হার বেশিও হতে পারে; তবে কোনোভাবেই দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রম করবে না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক আবহ বিরাজ করবে।

সংস্কারের মহামিছিলে হোক না একটি ব্যতিক্রমী সংস্কার! এমনটা যদি জাতীয় সংসদের ১০০ বা ১৩৩টি আসন ধরে নির্বাচন হয়, ক্ষতি কী! হতেও পারে জাতীয় সংসদের কোনো আসনে তিন দলের তিনজন নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দলের সহাবস্থানের রাজনৈতিক উত্তরণ।

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এবি ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান কাইজার এ চৌধুরী
  • তথ্য উপদেষ্টার ওপর বোতল নিক্ষেপকারী শনাক্ত, ‘কম সময়ের মধ্যে’ গ্রেপ্তারের আশা পুলিশের
  • হুইসেন আসছেন রিয়ালে, কারেরার সঙ্গে আলোচনা শুরু 
  • ঢাবিতে বহিরাগতদের নিয়ে ছাত্রদলের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন, ক্ষোভ
  • ময়লা ফেলে পরিত্যক্ত জায়গা দেখিয়ে পুকুর ভরাট, ১০ জনকে আসামি করে মামলা
  • ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সোচ্চার ইহুদি পরিবারগুলোতে অসন্তোষ তুঙ্গে, ঘটছে ভাঙন পর্যন্ত
  • ঝিনাইদহে ৩ বাড়িতে অজ্ঞান পার্টির হানা, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার লু
  • শিক্ষক ৩, শিক্ষার্থী ৫
  • সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর শাকের আঁটি