বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে জাপান দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হবে—এমনটাই আশা করে জাপান। নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতার লক্ষ্যে জাপান জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মাধ্যমে বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে চার ভাগে দুই দেশের সম্পর্কের নানা বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ২৯ মে অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সফরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির আশা করছে উভয় দেশ।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এক সদস্য প্রথম আলোকে জানান, দুই দেশ অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট–ইপিএ) খসড়া চূড়ান্ত করা নিয়ে আলোচনা যতটা এগিয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ইপিএ সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়ে যাবে বলে দুই পক্ষ আলোচনায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
বৈঠকের পর দুই দেশের প্রচারিত পৃথক পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ‘জাপান-বাংলাদেশ কৌশলগত অংশীদারত্বের’ আওতায় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জনগণের মধ্যে সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।
বিকেলে টোকিও থেকে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, হঠাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক পত্র দিয়ে বৈঠক স্থগিতের প্রস্তাব দেওয়ার পর পররাষ্ট্রসচিবদের আলোচনা নিয়ে সাময়িক একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকটি হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সচিব মো.
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম টোকিও থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে আলোচনার ব্যাপ্তি তিন ঘণ্টা হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু পূর্বনির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষ নানা বিষয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেছে।
রাজনৈতিক সমর্থন পুনর্ব্যক্ত
দুই দেশের গতকালের বৈঠকের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এরই ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে সংস্কারের বিষয়ে সরকারের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক উত্তরণ, নির্বাচনের সময় ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়।
নির্বাচন নিয়ে জাপানের প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হয়; সেই আশাবাদের কথা জানিয়েছে জাপান। এ সময় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এবং সরকারের সংস্কারের প্রতি জাপান সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। জাপানের প্রতিনিধিদলের নেতা জানান, আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হয়, সে জন্য ইউএনডিপির মাধ্যমে কিছু তহবিল দেওয়া হবে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে।
বাংলাদেশের প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দুই দেশ রাজনৈতিক আস্থা গভীরতর করা, উন্নয়ন কৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে একমত হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধের বিষয়ে জাপান ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে।
প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতা
দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, টোকিওর আলোচনায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রসঙ্গ তোলে জাপান। এ সময় বাংলাদেশকে সরকারি নিরাপত্তা সহযোগিতার (অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স–ওসিএ) আওতায় সহায়তা দেওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। ওসিএর আওতায় বাংলাদেশের কোস্টগার্ডকে চারটি টহলযান দিচ্ছে জাপান। ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষার কথা উঠে আসে। এ জন্য ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথাও উল্লেখ করে জাপান।
বৈঠকে জাপান জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগের (বিগ-বি) অধীন, জাপান উচ্চমানসম্পন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। বিগ–বির আওতায় জাপানি উৎপাদন ও শিল্পকারখানাগুলোকে বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ততার জন্য উৎসাহিত করবে। অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (এফওআইপি) ও বিগ-বির অধীন জাপান এ অঞ্চলে টেকসই উন্নয়ন দেখতে আগ্রহী।
বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগে (বিগ-বি) বাংলাদেশ ও জাপানের পাশাপাশি যুক্ত আছে ভারত। কিন্তু গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চরম টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক। ফলে এই টানাপোড়েন বিগ–বির বাস্তবায়নে প্রশ্নচিহ্ন জুড়ে দিয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পরর ষ ট রসচ ব র পরর ষ ট র সহয গ ত র দ শ র পর র জন ত ক সরক র র ত র জন
এছাড়াও পড়ুন:
শি-পুতিন দৃঢ় ঐক্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পশ্চিমা বিশ্ব
বিশ্বের দিকে দিকে যখন চলছে যুদ্ধের উন্মাদনা, তখন চীন-রাশিয়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ‘ইস্পাত কঠিন’ ঐক্য। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উত্তেজনাসহ পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে মস্কো-বেইজিং বন্ধুত্ব আরও সুসংহত হয়েছে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরে বিষয়টি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ দুটির এমন দৃঢ় ঐক্য চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে পশ্চিমা বিশ্বকে।
গত ৭-১০ মে রাশিয়া সফর করেন শি জিনপিং। নাৎসি জার্মানির পরাজয় স্মরণে রাশিয়ার ৮০তম বিজয় দিবস উদযাপনে বন্ধু ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে ছুটে যান তিনি। চায়ের আড্ডায় কাটিয়েছেন প্রায় ১০ ঘণ্টা। বিশ্লেষকরা বলছেন, শি জিনপিংয়ের এবারের মস্কো সফর চীন-রাশিয়া সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা করেছে।
মস্কোতে শি প্রায় ২০টি দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন চীনের প্রেসিডেন্ট। অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মনে করেন, চীনের প্রেসিডেন্টের রাশিয়া সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে বর্তমান বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা চীন-রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি রচিত করেছে।
গত তিন বছর ধরে চীন-রাশিয়ার প্রতিরক্ষাগত সামঞ্জস্যতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণ শুরুর সময় থেকেই তাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত দ্বৈততা ছিল। এছাড়া চীন ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে প্রকাশ্যে সমর্থনও করেনি। তবে সংঘাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয় এমন বগু খাতে মস্কো-বেইজিং কৌশলগত ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বেড়েছে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ডিস্টিংগুইশড ফেলো থমাস গ্রাহাম মনে করেন, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল-গ্যাস বেশি করে কিনছে চীন। যাতে পুতিন সেই টাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন। ২০২৩ সাল থেকে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা হয়ে উঠেছে বেইজিং। পাশাপাশি মাইক্রোচিপের মতো যেসব যন্ত্রাংশ অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হয় তা রাশিয়াকে দিয়েছে চীন।
শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব
চীন-রাশিয়ার শক্তিশালী অংশীদারিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক সম্পর্ক। চীনের কাস্টমস অফিসের তথ্য বলছে, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানে রেকর্ড ২৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মস্কো-বেইজিং উভয়ই নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পশ্চিমা প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যের অধিকাংশই বর্তমানে ডলার বা ইউরোর পরিবর্তে রুবল ও ইউয়ানে পরিচালিত হচ্ছে। এই পদক্ষেপ দেশ দুটির অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করছে।
রাশিয়ার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং চীনের উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দুই দেশের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ শিল্প ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ প্রযুক্তিগত দক্ষতার ক্ষেত্রগুলোতে চীন-রাশিয়ার অংশীদারিত্ব ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চীন-রাশিয়া ঐক্যের ভূ-রাজনৈতিক সফলতাও স্পষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্ক সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, দুই দেশের ঐক্যে ফাটল ধরানোর প্রচেষ্টা, যে কারোর জন্যই দুরাশার কারণ হবে। বহিরাগত কোনো জোটও এই ঐক্যের ভিত নড়াতে সক্ষম নয়।
রাশিয়ার জন্য ভুগতে হচ্ছে চীনকেও
মস্কোর সেনারা ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে চীনকেও ভুগতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে বেইজিংও। রাশিয়াকে সমর্থন করায় চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চীনের চাংশা তিয়ানয়ি স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওয়াশিংটন। অভিযোগ ইউক্রেনে ওয়াগনার গ্রুপের কার্যক্রম সহজ করতে রাডার স্যাটেলাইট চিত্র সরবরাহ করত প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহায়তার অভিযোগে চীনের দুটি ড্রোন কোম্পানি ‘জিয়ামেন লিম্বাচ এয়ারক্র্যাফ্ট ইঞ্জিন কোং’ এবং ‘রেডলেপাস ভেক্টর ইন্ডাস্ট্রি শেনজেন কোং’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৩ সাল থেকে শি ও পুতিন ৪০ বারেরও বেশি সাক্ষাৎ করেছেন, যা দু’দেশের গভীর পারস্পরিক আস্থা এবং আন্তরিক বন্ধুত্বকে আরও জোরদার করেছে। দেশ দুটি এখন বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশের মডেল হয়ে উঠেছে।
সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট, পিপলস ডেইলি অনলাইন