ঢাকার রাজপথে এখন এক ভিন্ন দৃশ্য। কোথাও একঝাঁক পুলিশ, কোথাও জব্দকৃত অটোরিকশা, কোথাও আবার ফাঁকা রাস্তায় এক কোণে বসে থাকা একজন রিকশাচালক, যার চোখে আতঙ্ক, মুখে ক্লান্তি, আর বুকভরা প্রশ্ন— ‘এখন কী করবো?’ এই প্রশ্ন শুধু তার নয়, তার পরিবারের, তার সন্তানের, এবং শেষ পর্যন্ত পুরো সমাজের। কারণ প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরেকটি বৃহত্তর গল্প।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা মানুষের ওপর নির্ভরশীল। এই খাতের অন্তর্ভুক্ত অগণিত অটোরিকশা চালক জীবিকা নির্বাহ করেন প্রতিদিনের আয়ে। অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন শুধু রিকশা চালিয়ে পরিবারের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার আশায়। কেউ হয়তো কৃষি ছেড়ে এসেছেন, কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভিটেমাটি হারিয়ে শহরে পাড়ি দিয়েছেন এই আশায়—একটা গাড়ি চালিয়ে অন্তত সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবেন।
কিন্তু সম্প্রতি পুলিশি অভিযানে ঢাকার অনেক এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা জব্দ, জরিমানা এবং চালকদের হয়রানির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। উদ্দেশ্য অবৈধ যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো। উদ্দেশ্যটি অবশ্যই জরুরি, তবে প্রশ্ন হলো, প্রয়োগের পদ্ধতি কতটা মানবিক?
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার চালক ঘরে ফিরে যাচ্ছেন খালি হাতে। একজন চালকের কথায়, ‘রাতে ফিরি, বউ বলে বাজার আনোনি কেন? কী বলবো তাকে? পুলিশ গাড়ি নিয়ে গেছে—এই কথা বললে তো ক্ষুধা মেটে না।’
রিকশা বন্ধ মানে শুধু যান চলাচল বন্ধ হওয়া নয়, একেকটি পরিবারের রোজগারের পথ বন্ধ হওয়া, এবং অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবন শুরু হওয়া। প্রশ্ন ওঠে, যদি এই যানগুলো অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে এতদিন কীভাবে সেগুলো চলে এসেছে? কারা এই যানবাহন আমদানি করেছিল, কারা এগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করেছে? চালকেরা তো কেবল একটি ব্যবস্থা পেয়ে তাতে যুক্ত হয়েছেন, কেউ অবৈধ ব্যবসা করতে নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য।
এছাড়াও, পুলিশের অভিযান অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্যহীন ও হঠাৎ করে হয়, যাতে চালকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পূর্বনির্ধারিত ঘোষণা ছাড়া বা বিকল্প কোনো কর্মপরিকল্পনা ছাড়াই যেভাবে অভিযান চলছে, তাতে দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সমস্যার সমাধান অবশ্যই জরুরি। তবে তা হতে হবে সুচিন্তিত, ধাপে ধাপে এবং মানুষের জীবিকা রক্ষা করে। সেক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনা হলো:
ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ: একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে অটোরিকশা চলাচল ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা, যাতে চালকেরা প্রস্তুতি নিতে পারেন।
আলাদা রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈধতা প্রদান: একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া চালু করে বৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশাকে লাইসেন্স প্রদান এবং অপ্রয়োজনীয় যানবাহন বন্ধের ব্যবস্থা।
পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান: সরকার বা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ট্রেনিং ও ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যারা রিকশা চালাতে পারবেন না, তারা যেন অন্য কোনো কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারেন।
অভিযান পরিচালনায় মানবিকতা: প্রতিটি অভিযান চালানোর আগে সামাজিক কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি মানবিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
আমরা উন্নয়নের কথা বলি, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সে স্বপ্ন তখনই পূর্ণতা পাবে যখন শহরের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষগুলোকেও সে স্বপ্নে অংশীদার করা হবে। উন্নয়নের মূল দর্শন হওয়া উচিত—কাউকে পিছনে ফেলে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
এখন সময়, আমরা যেন শুধু সড়কের শৃঙ্খলা নয়, সমাজের শৃঙ্খলাও নিশ্চিত করি। তাদের জীবনের চাকাও যেন ঘুরতে পারে, সম্মানের সঙ্গে, নিরাপদে। শহরের শৃঙ্খলা জরুরি, কিন্তু মানুষের জীবিকার পথ বন্ধ করে সেই শৃঙ্খলা অর্জন টেকসই নয়। আইন বাস্তবায়নের চেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক রাষ্ট্র চাই, তবে এখনই সময়, রিকশাচালকদের জীবনে মানবতার আলো পৌঁছে দেওয়ার।
লেখক: সাংবাদিক
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ চ লক র র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
একজনের প্রেমে পড়েছিলাম, এখন সে আমার বউ
প্রথম আলো