বাংলাদেশের শিল্পকলাজগতের সবার প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় বেগম জাহানারা আবেদিন চলে গেলেন। আর কয়েকটা দিন পার হলেই ৯৩ বছর পূরণ হতো। পারিবারিকভাবে সেই দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজনের ইচ্ছা ছিল শুনেছিলাম। প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। সেটির সুযোগ আর হলো না। তিনি প্রায় নিঃশব্দে চলে গেলেন।
জাহানারা আবেদিন শিল্পী ছিলেন না। ইদানীং শিল্পকলাজগতের সর্বত্র প্রতিনিয়ত পদচারণও ছিল না বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায়। কিন্তু জীবনের প্রায় শুরু থেকে দেশের শিল্পকলা চর্চার, প্রসারের ক্ষেত্র নির্মাণে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সহধর্মিণী হওয়ার সুবাদে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ খণ্ডিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে শিল্পকলার সাবলীল চর্চার, সমাজ-সংসারে আধুনিক যুগোপযোগী শিল্পিত ভাবনার বিস্তারে ব্যস্ত স্বামী জয়নুলের পাশে প্রধান সমর্থক হওয়া, ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য শিল্পাচার্যের যে ব্যস্ততায় জড়িয়ে থাকা, তা মেনে নেওয়াই শুধু নয়, ক্ষেত্রটিকে নিয়ে শিল্পাচার্যের ভাবনার বাস্তবায়নে উজ্জীবনী শক্তি ছিলেন। কখনো সরাসরি, কখনোবা প্রচ্ছন্নে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন। স্যারকে কঠিন ও প্রায় দুরূহ কাজটি থেকে পিছু হটতে দেননি, হতাশ হতে দেননি। কোনো কোনো দিকের পরামর্শকও ছিলেন। এ কথা আবেদিন স্যার বলতেন সবাইকে। এই স্বীকৃতি আবেদিন স্যার ক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপার নিয়ে আলোচনায় বসলেই ব্যক্ত করতেন। বলতেন, ‘সহধর্মিণী হিসেবে সংসারের স্বাভাবিক চলমানতা বজায় রাখার চিন্তায় যদি আমার শিল্পকলাবিষয়ক কাজটিতে বাগড়া দিতেন, বৈরী হতেন, তাহলে সবটাই ভন্ডুল হতে পারত। আমি উৎসাহ হারাতাম।’
জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন সময়ে বলা বক্তব্য থেকে তো এসব আমরা শিল্পীরা জেনেছিলামই, সেই সঙ্গে নিজেরা প্রত্যক্ষও করেছি বেগম জাহানারা আবেদিনের শিল্পীসমাজের বহুবিদ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তি।
আবেদিন স্যার কলকাতা ছেড়ে দেশে (পূর্ব পাকিস্তান নামের পূর্ববঙ্গে) ফিরে এখানকার শিল্পকলাচর্চার খরা কাটাতে সর্বক্ষেত্রের মানুষের মধ্যে সুরুচিবোধ সঞ্চার করা এবং শিল্পী ও শিল্পীদের চর্চাকে গ্রাহ্য করাতে যে বিশাল কর্মকাণ্ডে হাত দিয়েছিলেন, তাতে বেগম জাহানারা পুরো যুদ্ধটিকে অতি কাছ থেকে দেখেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন। শিল্পকলাজগতের ক্রমান্বয়ে সবার পছন্দের হওয়া, শিল্পী ও শিল্পকলার অঙ্গনটির দিনে দিনে সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সম্মানীয় হয়ে ওঠার পর্যায়গুলোতে পরোক্ষে যুক্তও ছিলেন।
বড় শিল্পীর গৃহিণী হয়ে উপমহাদেশের পুরো শিল্পকলাজগতে জড়িয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলতেন যে আঁকিয়েদের, ভাস্করদের সম্বন্ধে বিয়ের আগে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। স্বামীর শিল্পীসুলভ হাবভাব, চালচলন, আঁকাআঁকি, ব্যস্ততা, সাংস্কৃতিক জগতের খ্যাতিমান সব বন্ধুবান্ধবের শিল্প-সাহিত্য-সংগীত, রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনাকে দুর্বোধ্যই মনে হতো নববধূ হিসেবে। একে তো আঁকাআঁকির দিকটি ছিল পুরোই অজানা, তার সঙ্গে আবার সমাজ–সংসারের বড় বড় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে স্বামীর ওঠাবসা, কতশত প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে কথা আর কাজ দেখে বিস্মিত হতেন।
এসবকে মানিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকাকালীন পর্বটিকে তিনি রসিকতা করে বলতেন ‘স্টাডিটাইম’। তবে সে সময়কে নিয়ে তিনি সহজে কোনো কথা বলতেন না। অবশ্য কখনো কখনো হাসি ছড়িয়ে বলতেন, শিল্পীদের জগৎটিকে নাকি অদ্ভূত মনে হতো, টানাপোড়েনের সংসার আর শিল্পী স্বামীর হাবভাবগুলোকে চিনতেই মনোযোগী থাকতে হতো প্রথম দিকে।
স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ুয়া বয়সটিতে ওই রকম গুরুত্বপূর্ণ আর অচেনা পরিবেশে নতুন জীবনে প্রবেশ, সেই সঙ্গে কলকাতার মতো অত বড় শহরে গিয়ে সংসার গোছানোর ব্যাপার—রীতিমতো হিমশিম অবস্থার দিনকাল ছিল। বলা বাহুল্য, এসব তিনি অতি আপনজন ভাবা মানুষদের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রকাশ করতেন কখনো কখনো। স্মৃতিচারণা করতে চাইতেন না তেমন। তারপরও বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারে তাঁর বলা কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানার সুযোগ হয়েছে আমাদের। সেসবের কয়েকটি উল্লেখ করছি।
বিয়ের পর কলকাতায় বসবাস শুরু করেছেন মাত্র। বছরটি ছিল ১৯৪৬। সে সময়, তখনই স্বামী বিখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদিন, তাঁকে অর্থাৎ নববধূকে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। কলকাতায় সব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, নাটক-সিনেমার বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন আবেদিন স্যার। এ রকমের কয়েকজন ছিলেন, যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নায়ক প্রদীপ কুমার, ছবি বিশ্বাস, কানন দেবীসহ আরও অনেকে। আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন তাঁর বলা তালিকায়।
তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যেটিকে উল্লেখ করতেন, তা ছিল বিশ্বখ্যাত শিল্পী যামিনী রায়ের বলা কিছু কথাকে। স্বামী জয়নুল নববধূকে নিয়ে যামিনী রায়ের প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। পরিচয় হতেই যামিনী রায় তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে আবেদিন স্যারকে বলেছিলেন, ‘বাহ, জয়নুল! এই সুন্দরী বউটিকে কোথায় পেলে?’
যামিনী রায় বেগম জাহানারাকে সেদিন প্রাণঢালা আশীর্বাদ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘গুণী স্বামীপ্রবরটিকে যত্নে রেখো। তার সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের সব ভার কিন্তু তোমার ওপর ন্যস্ত। খেয়াল রেখো, নজরে রেখো।’
যামিনী রায়ের সেই কথাগুলোকে চিরকাল স্মরণ করতেন বেগম আবেদিন। কলকাতার সেই শুরুর দিনগুলোর কথা উঠলেই তিনি বলতেন, ‘আমি সারা জীবন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি যামিনীবাবুর বলা কথা অনুযায়ী সেই দায়িত্ব পালন করতে। জানি না কতটুকু সফল। আমি সাংসারিক কর্মকাণ্ডে শিল্পীকে ব্যস্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতাম, ভারমুক্ত রাখতাম, যাতে তাঁর চিত্রকলাচর্চায়, শিল্পকলাবিষয়ক কাজগুলো ব্যাহত না হয়, সেদিককে শিরোধার্য জ্ঞান করে এসেছি।’
বেগম জাহানারা শিল্পাচার্যের ব্যাপারেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তা–ই নয়, অতসব ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সার্থক জননী হিসেবে তিন পুত্রকে শিক্ষিত সুমানুষ করে তৈরি করেছিলেন।
জাহানারা আবেদিন ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের হাহাকার অবস্থাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দেশ ভাগাভাগিতে কলকাতার শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের নিজ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান ফেরার ইচ্ছা পোষণে আবেদিন স্যারের যে মানসিক বিপর্যস্ততা দেখেছিলেন, তাতে সিদ্ধান্ত নিতে সাহস জুগিয়েছিলেন জাহানারা।
সেই সাহসকে পাথেয় করে এ অঞ্চলে ফিরে আসা শিল্পী জয়নুল আবেদিন নিজের চিত্রকলাচর্চা, ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা, মানুষকে শিল্পীমনা করে তোলা, শিল্পীদের শিল্পকলাচর্চাকে বেগবান করা এবং সম্মানজনক পেশার ক্ষেত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। আর এ সবকিছুর জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কারস্বরূপ ‘শিল্পাচার্য’ আখ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছাত্র হিসেবে পুরো পরিবারের সান্নিধ্য প্রাপ্তিতে অনেকের মতো গর্বিত আমিও একজন। বিশেষ করে বেগম জাহানারা আবেদিনের স্নেহধন্য হতে পারা ছিল অসাধারণ প্রাপ্তি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে তৎকালীন আর্ট কলেজের শিক্ষক ও তরুণ শিল্পী হিসেবে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন কারণে ডাক পড়ত স্যারের বাসায় যাওয়ার। ১৩ নম্বর শান্তিনগরের নবনির্মিত বাসায় গিয়ে হাজির হতাম। এ রকমেরই একদিন ডাক পেয়েছিলাম স্যারের ‘মনপুরা স্কুল’ চিত্রটি আঁকার সময়। স্যারকে অত বড় ছবি আঁকতে দেখার বিরল অভিজ্ঞতা লাভের আশায় উপস্থিত হয়েছিলাম। সেই যাওয়া ছিল উদ্দীপনাময় লাগাতার কয়েক দিনের।
তখন আবিষ্কার করেছিলাম স্যারকে বেগম জাহানারা আবেদিনের উৎসাহদাত্রীর ভূমিকা। সেই সঙ্গে উপস্থিত সবার প্রতিদিনের চা-নাশতা এবং দুপুরের মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা করার উদ্দীপনা। যত দূর মনে পড়ছে, বরেণ্য শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক ও শিল্পকলা বিশ্লেষক নজরুল ইসলাম, নাট্যজন ও আমার সহপাঠী কেরামত মওলা। আমরা সবাই ছিলাম সার্বক্ষণিক দর্শক।
মনে আছে, রাজ্জাক স্যার বলেছিলেন যে অত দীর্ঘ, অপূর্ব আর কঠিন কষ্টসাধ্য কাজ আগে দেশে কেউ করেনি। এ কথা শুনে আতঙ্কিত অথচ ঠাট্টার ছলে আবেদিন স্যারের সহধর্মিণী বলেছিলেন, ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ছবি তো যত বড় হইব আপনাগো স্যারের সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারও তত বড় হইতাছে। দুই দিনেই তো দেড় কার্টন শেষ। যত তাড়াতাড়ি ছবি শেষ হয়, তত ভালো।’ এ কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু স্যারকে নিরস্তও করেননি স্যারের আঁকার সময়ের টেনশন দেখে। তবে জেনেছিলাম, কয়েক কার্টন তিনি সরিয়ে রেখেছিলেন। কথিত ছিল যে স্যার সিগারেট দিয়েই আরেকটি ধরাতেন। আর দিনে দেশলাইয়ের একটি কাঠিই শুধু খরচ হতো সকালে শুরুর সময়।
আবেদিন স্যার ও তাঁর সহধর্মিণী দুজনই রসিকতা মিশিয়ে, মজা করে কথা বলতেন। আমার শোনা এ রকমের অসংখ্য অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে একটির উল্লেখ করছি।
১৯৭৩ সালে গ্রিক সরকারের বৃত্তিতে এথেন্সে যাওয়ার আগের দিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম সস্ত্রীক। আবেদিন স্যার বিদেশে লেখাপড়ার ব্যাপারে কিছু উপদেশ দেওয়া শেষে বলেছিলেন আমার স্ত্রীকে, ‘এই না ক মাস আগে তোমাগো বিয়া খাইলাম। মন খারাপ লাগে না?’
আসলে আমরা অতটা নবদম্পতি ছিলাম না। প্রায় বছর দেড়েক পার হওয়া ছিল। তো স্যারের কথা শুনে বেগম জাহানারা একগাল হাসি ছড়িয়ে বলেছিলেন স্যারের উদ্দেশে, ‘কার মুখে কী কথা! নিজের কথা মনে নাই? বিয়া পড়ানি শেষ হইতেই বাক্স-প্যাটরা নিয়া নতুন বউ রাইখ্যা সোজা কলকাতায় পাড়ি। কী যে ঘটনা ছিল সেইটা, বলার মতো না!’
এসব কথার পর তিনি মজা করতে আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘শোনো, ইউরোপে যাইতাছ, বেশি দিন একা রাইখো না। মেম গো দেশ। শিল্পীদের ভাবসাবে বিশ্বাস নাই। আর পারলে সব সময় বেল্টে আঁচল বাইন্ধা চইল।’
এ কথা শুনে স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘ডর দিতাছে। আরে শিল্পীরা নিরীহ। যেখানেই যাক ঠিক ফিরা আসে আপন ঘরে। আর ঘরে যে থাকে, তার কাছেই তো আসে, নাকি?’ শেষ বাক্যটি হেসে হেসে নিজ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন।
আমার স্ত্রী এখনো প্রসঙ্গ এলে স্মরণ করেন সেই কথা। অন্যদের শোনান।
স্যারের বিয়ে নিয়ে সিনিয়র শিল্পীদের বেশ মজা করে বলতে শুনতাম যে তাঁর নাকি বিয়ের ব্যাপারে অনীহা ছিল। অনেকে সেটাকে ভীতিও বলতেন। এসব নিয়ে একটি গল্প কথিত ছিল। সেটি সত্যিও ছিল বটে। গল্পটি ছিল এই রকম: যখনই কেউ বিয়ের কথা বলতে আসতেন, স্যার কাগজে খসখস করে অপরূপ সুন্দরী মেয়ের কল্পিত মুখ এঁকে বলতেন যে ঠিক এই রকমটা খুঁজে পেলে তবেই তিনি বিয়েতে রাজি হবেন।
তো স্যারের সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। বেগম জাহানারার কলকাতাবাসী এক আত্মীয় ছিলেন। তাঁর নাম শফিকুল। তিনি ছিলেন আবেদিন স্যারের ঘনিষ্ঠ। তাঁর প্রস্তাবে স্যার ছবি দেখে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তার মানেই বেগম জাহানারার মধ্যে স্যার তাঁর কল্পনার সুন্দরীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। মিলে গিয়েছিল ড্রইংয়ের মুখ।
তো, শিল্পাচার্যের সব সাফল্যের প্রচ্ছন্নে যাঁর অবদান বিশাল, তিনি ছিলেন সহধর্মিণী বেগম জাহানারা। শিল্পীর ঘরনি হয়ে, জুটি হয়ে দেশের শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে যে শিল্পকলার সুষ্ঠু ও গৌরবময় জগতের সৃষ্টি, সেই ইতিহাস, তার আদ্যোপান্ত জানা ও অংশীদার হওয়া পরম শ্রদ্ধেয় জাহানারা আবেদিন চলে গেলেন সবার স্মৃতিতে নিজেকে চিরস্মরণীয় করে রেখে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব গম জ হ ন র র শ ল পকল সহধর ম ণ বল ছ ল ন কর ছ ল ন ল চর চ র কয় ক স য রক আম র স কলক ত জগত র বলত ন করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী
চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’
মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।
মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
নিখুঁত নয়
জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।
গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’
জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।
জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।
তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।
আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনতবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।
ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।
আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।
বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’
তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’
কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’
আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’
আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫