বিদেশযাত্রার সময় গত রোববার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 

ভাটারা থানার হত্যাচেষ্টা মামলায় গতকাল সোমবার ফারিয়াকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে অভিনেত্রীকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তারকাদের মধ্যে যারা সোচ্চার ছিলেন, তারাও ফারিয়ার গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। 

গতকাল রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনার বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে। জুলাই গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় না এনে এ ধরনের লোক দেখানো, ঢালাওভাবে আসামি করা মামলায় গ্রেপ্তার ও জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে লঘু করে দেখানোর প্রবণতা সৃষ্টি করছে।

হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় ঢালাও আসামি এবং গ্রেপ্তার নিয়ে অনেক দিন ধরে মানবাধিকার সংস্থাসহ নানা মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। এরপর ঢালাও মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার বন্ধ হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, ফারিয়ার গ্রেপ্তারের ঘটনা ‘প্রতিহিংসামূলক’ আচরণ। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীনির্ভর চলচ্চিত্র ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয় করেন ফারিয়া। ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয়ের ‘অপরাধে’ রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। 

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অবশ্য বলছেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী হওয়ার কারণে নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফারিয়াকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। সকাল ১০টার পর তাঁকে হাজির করা হয় আদালতে। এ সময় তাঁকে সাদা মাস্ক, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানো হয়েছিল। নারী পুলিশ সদস্যরা তাঁকে আদালতের দোতলায় হাঁটিয়ে নিয়ে যান। এরপর তাঁর হেলমেট খুলে কাঠগড়ায় তোলা হয়। তখন সাদা মাস্ক মুখ থেকে একটু নামিয়ে তিনি হাঁপাতে থাকেন। পরে পুলিশের কাছ থেকে বোতল নিয়ে পানি পান করেন। এরপর তিনি উল্টো দিকে ফিরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন।

এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক মো.

বিলাল ভূইয়া তাঁকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন। এদিকে ফারিয়ার জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা। উভয়পক্ষের আংশিক শুনানি শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁর জামিন আবেদনের ওপর অধিকতর শুনানির জন্য আগামী ২২ মে দিন ধার্য করা হয়।

তবে এদিন আদালতে শুনানি চলাকালে কোনো কথা বলেননি অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া। শুনানিতে মাথা নিচু করে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আদালতেও কথা বলেননি।

শুনানিতে যা হলো
আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী ফারিয়ার জামিন আবেদন করেন। তাদের মধ্য ফারহান মোহাম্মদ আয়াজ আদালতে কথা বলেন। তিনি বলেন, ফারিয়া দেশের স্বনামধন্য নায়িকা। তাঁর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। তিনি রাজনৈতিক দলের সদস্যও না। জুলাই আন্দোলনের সময় তিনি কানাডায় ছিলেন। সেজন্য আমরা তাঁর পাসপোর্ট আদালতে দাখিল করেছি। আন্দোলনের পরও সিনেমা ও শুটিংয়ের কাজে তিনবার বিদেশে যান। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তিনি কোনো অপরাধ করেননি। আন্দোলনের সময় ছাত্রদের পক্ষেও স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফারিয়াকে নির্দোষ দাবি করে আইনজীবী আয়াজ বলেন, ২৫৮ আসামির মধ্যে নুসরাত ফারিয়ার ক্রম ২০৭ নম্বরে। 

এ পর্যায়ে ঢাকা মহানগর জজ আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘হাসিনার পক্ষে ছিল, সে একজন ফ্যাসিস্টের সমর্থক। আন্দোলনের সময় ছাত্রদের বিরোধিতা করে এবং মদদ দেয় অন্যদের মতো। বিভিন্ন ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।’ শুনানি চলাকালে কাঠগড়ায় চোখ মুছতে দেখা যায় ফারিয়াকে।

মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি
ফারিয়াকে একনজর দেখার জন্য ঢাকার আদালত চত্বরে এসেছিলেন মা ফেরদৌসী বেগম। তিনি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আদালত চত্বরে আসেন। অবস্থান করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চত্বরে। পরে তিনি যান হাজতখানার সামনে। তবে গণমাধ্যমকর্মীর ভিড় দেখে তিনি আবার চলে যান জেলা প্রশাসক চত্বরে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। ফারিয়াকে আদালতে তোলার সময় উপচে পড়া ভিড় দেখে তাঁর মা আর আদালতের সামনে যাননি।

হরেদরে মামলা
এনসিপি বিবৃতিকে বলছে, বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রশাসনের মধ্যে থাকা একটি পক্ষ এ ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘জুলাই গণহত্যা’ এবং এর বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। অথচ এখন পর্যন্ত এই গণহত্যার বিচারে আমরা দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়নে আমরা কোনো প্রজ্ঞাপন দেখতে পাইনি।

এনসিপি আগামী জুলাইয়ের মধ্যে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায় উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানাই আমরা।’ এ ছাড়াও হরেদরে মামলা এবং মামলা-বাণিজ্যের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে মামলা গ্রহণের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এনসিপি।

যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
মামলা থাকায় ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাঁর নামে মামলা থাকলে কী করবেন। ছাইড়া দিলে আপনিই বলবেন ছাইড়া দিছেন। বিদেশযাত্রায় নিষেধ আছে কিনা, একটা পলিসি আছে।’

‘গ্রেপ্তার বিব্রতকর’ 
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ফারুকী লেখেন, ‘আমি সাধারণত চেষ্টা করি আমার মন্ত্রণালয়ের কাজের বাইরে কথা না বলতে। কিন্তু আমার তো একটা পরিচয় আছে, আমি এই ইন্ডাস্ট্রিরই মানুষ ছিলাম এবং দুই দিন পর সেখানেই ফিরে যাবো। নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার বিব্রতকর একটা ঘটনা হয়ে থাকল আমাদের জন্য।’

মামলা
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রদল নেতা এনামুল হক। গত ৩ মে ভুক্তভোগী এনামুল বাদী হয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় তিনি নুসরাত ফারিয়াকেও আসামি করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও ১৭ অভিনয় শিল্পীকে আসামি করা হয়। মামলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের অর্থ জোগানদাতা হিসেবে আসামি করা হয়েছে ফারিয়াকে। 

ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
ফারিয়ার গ্রেপ্তারকে অনেকেই দেখছেন ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন দেশের অভিনয় শিল্পী, নির্মাতা ও সংস্কৃতিকর্মীরা।

জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেওয়া অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন ফারিয়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, “কী এক লজ্জা! ফ্যাসিস্ট সরকার যা করেছে, সেখানে এই মেয়েটির কিছুই করার ছিল না। আমি এই সিস্টেম নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ‘ন্যায্য অধিকার’ শব্দটা আজ অপার্থিব মনে হয়।” 

নির্মাতা আশফাক নিপুণ লিখেছেন, ‘আসল অপরাধী বাদ দিয়ে সফট টার্গেট তৈরি করা হচ্ছে।’ ছোট পর্দার অভিনেতা খায়রুল বাসার প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, ‘শুধু একটি সিনেমায় অভিনয়ের কারণে একজন শিল্পীকে কেন হেনস্তা হতে হবে? রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াও কি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে শিল্পীদের জন্য?’

বরেণ্য নির্মাতা শিহাব শাহীন এটিকে সরাসরি ‘হয়রানি’ বলেছেন। গিয়াস উদ্দিন সেলিম ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ!’ নির্মাতা ও অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন লিখেছেন, ‘মুজিব সিনেমায় অভিনয় করা কি অপরাধ? আমি হলে আমিও করতাম।’

সংগীতশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী লিখেছেন, ‘জেলখানার আর দরকার কী? চারপাশটাই তো জেলখানা!’ অভিনেতা সোহেল রানা বলেন, ‘এই রাষ্ট্রে শিল্পী কীভাবে কাজ করবে– দায়িত্ব নিয়ে কেউ বলেন।’

চিত্রনায়িকা পরীমণি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘কথা হচ্ছে, কোনোকালেই কথা বলতে পারবা না মনু। ঘুমাও, ঘুমাও। ঘুমই উত্তম।’ চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘কী লজ্জা! তিনি একজন শিল্পী!’ নায়ক বাপ্পী চৌধুরী লিখেছেন, ‘যদি সত্যিই অপরাধে জড়িত থাকেন, তবে আইন অনুযায়ী বিচার হোক। কিন্তু মিথ্যা মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হলে তা দুঃখজনক।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব চ র প রক র য় গণহত য র উপদ ষ ট আইনজ ব র জন য ন কর ন অপর ধ র ঘটন র সময় এনস প গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন

গত মাসের শুরুতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন বিশ্বনেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানাতে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের মালিক শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘অঢেল টাকার মালিক।’

চারপাশে হাসি আর করতালির রোল পড়ে গিয়েছিল। আবারও ট্রাম্প মুখ ফসকে এমন কথা বলে ফেললেন, কিন্তু তাতে কীই–বা যায় আসে?

সুদানের এল-ফাশের শহরটি সংযুক্ত আরব আমিরাত–সমর্থিত আধা সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের রাজনীতিকেরা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, সেটি দেখে আপনি ট্রাম্প ও আল নাহিয়ানের হাত চেপে ধরার দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন।

সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করুন, যখন ট্রাম্প সরকারের আরব ও আফ্রিকাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাসাদ বোলস আরএসএফের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে ও আরও দুর্ভোগ এড়াতে’। অথচ এই বাহিনীকেই যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন, যখন ব্রিটিশ মন্ত্রী ব্যারোনেস জেনি চ্যাপম্যান ‘উদ্বেগ প্রকাশ’ করছেন এবং বলছেন যে আরএসএফের উচিত ‘নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা’।

ট্রাম্প যখন আল নাহিয়ানের হাত চেপে ধরে তাঁর ‘সীমাহীন অর্থের’ প্রশংসা করছিলেন, তখনো সুদানের উত্তর দারফুর প্রদেশের রাজধানী এল-ফাশের ৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ ছিল। শহরটির বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। আরএসএফ কাদামাটির প্রাচীর তুলে পুরো শহরকে ঘিরে ফেলেছিল, যাতে সাধারণ মানুষ এক ভয়ংকর হত্যার ফাঁদে আটকা পড়েন।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে এই আধা সামরিক বাহিনী সুদানের সরকারি সেনাবাহিনীর (এসএএফ) সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। দারফুরজুড়ে তারা যা করেছে, এল-ফাশেরেও সেটি করতে তারা প্রস্তুত হচ্ছিল। মানে নিরীহ সুদানি নাগরিকদের গণহত্যা।

২০২৪ সালের মে মাস থেকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে আসছিল, এল-ফাশের আরেকটি স্রেব্রেনিৎসা (বসনিয়ার এই শহরে ১৯৯৫ সালে গণহত্যা হয়েছিল) হতে যাচ্ছে। তারা সতর্ক করে দিয়েছিল, সারা বিশ্বের সামনে আবারও ভয়াবহ গণহত্যা ঘটবে, অথচ কেউ কিছুই করবে না।

বাস্তবেও সেটিই ঘটেছে।

৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ এল-ফাশেরের বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে যখন প্রাণপণ পালানোর চেষ্টা করছেন, যখন সারি সারি লাশ পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে, তখন রাজনীতিকেরা গণহত্যাকারী আরএসএফকে বলছে ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে’! মনে রাখবেন, তারা এটি করতে পেরেছে কারণ, আরব আমিরাতের শাসকদের হাতে ‘অঢেল অর্থ’ আছে।

আরএসএফ যোদ্ধারা তাঁদের তৈরি করা নরক থেকে পালাতে চাওয়া সাধারণ মানুষদের গুলি করে হত্যা করেছেন। তাঁরা ত্রাণকর্মীদের নির্যাতন করেছেন। গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মতো করেই তাঁরা গণহত্যার ভিডিও করেছেন। তাঁদের হত্যার শিকার দুর্ভাগা মানুষের রক্তস্রোত এমনভাবে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে, যেটি স্যাটেলাইটের ছবি থেকেও দেখা যাচ্ছে।

যে সুদানি সেনাবাহিনীর এল-ফাশের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, তারা বহু মাস ধরে নিজেদের ঘাঁটির চারপাশে মাইন পুঁতে বসে আছে, যাতে তারা নিজেরা নিরাপদে থাকতে পারে।

আরএসএফের জন্ম হয়েছে এই শতাব্দীর প্রথম দশকে দারফুরের জঞ্জাওয়িদ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে। এরা একসময় সুদানের সেনাবাহিনীর অংশ ছিল। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী অগণতান্ত্রিক ও বিপ্লববিরোধী শক্তি। তারা সুদানের অভিজাত সম্প্রদায়ের ধন-সম্পত্তি রক্ষা করার চেষ্টা করত।

কিন্তু এল-ফাশেরে এখন যেটি ঘটেছে, সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া সম্ভব হতো না। আরব আমিরাত সব সময় অস্বীকার করে এলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরএসএফের সংঘাতে তারা সব সময় অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে।

সুদানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি ঘাঁটি রয়েছে। দক্ষিণ দারফুরের নিয়ালা ও এল-ফাশের থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের আল-মালহায়। এ ছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য দেশ সোমালিয়ার বোসাসো, দক্ষিণ লিবিয়ার আল-কুফরা ও উগান্ডার কাজ্জানসি বিমানঘাঁটি থেকেও আরব আমিরাত তাদের অস্ত্র ও রসদ আরএসএফের কাছে পৌঁছে দেয়।

আরএসএফের প্রধান মোহামেদ হামদান দাগালো। তিনি হেমেদতি নামে বেশি পরিচিত। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতকে খনির সোনাগুলো দিয়ে দিয়েছেন। পশ্চিম সুদানসহ অন্য অঞ্চল থেকে ভাড়াটে সেনাদের তিনি তাঁর বাহিনীতে নিয়েছেন, যাঁরা আরব আমিরাতের জন্য কাজ করছেন। সুদানের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পদে পূর্ণ একটি দেশে তিনি আরব আমিরাতের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন।

সুদানের লোহিত সাগরের উপকূল, উর্বর কৃষিজমি, যুবক যোদ্ধা—এসব কিছুই আরব আমিরাতকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আরব আমিরাত চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবকে ছাড়িয়ে প্রধান বহিরাগত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ২০১৯ সালে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক ওমর আল-বাশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সুদানে রক্তাক্ত দমন–পীড়ন চালিয়ে সেটিকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।

সুদানে সাম্প্রতিক যুদ্ধে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহারা হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও পশ্চিমা রাজনীতিকেরা মাঝেমধ্যে হাত নেড়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও কপাল ভাঁজ করে দুশ্চিন্তা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করছেন না।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর আরব আমিরাত আরএসএফের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ফলে আরএসএফকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধে আবুধাবিকে কখনোই কার্যকর চাপ দেওয়া হয়নি। ফলে যুদ্ধ শেষ কিংবা অন্তত বিরতির প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।

যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে যে সামরিক সরঞ্জাম আরব আমিরাত কিনছে, তা সুদানে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রিটিশ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছিল। তার কারণ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সুদান যুদ্ধে যুক্তরাজ্য আবুধাবির পক্ষে দাঁড়ায়নি। সে সময় যুক্তরাজ্যের একজন মন্ত্রীর উড়োজাহাজ আরব আমিরাত যাওয়ার পথে মাঝ আকাশে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল।

৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ এল-ফাশেরের বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে যখন প্রাণপণ পালানোর চেষ্টা করছেন, যখন সারি সারি লাশ পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে, তখন রাজনীতিকেরা গণহত্যাকারী আরএসএফকে বলছে ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে’! মনে রাখবেন, তারা এটি করতে পেরেছে কারণ, আরব আমিরাতের শাসকদের হাতে ‘অঢেল অর্থ’ আছে।

অস্কার রিকেট, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শাহরুখ খান: গণহত্যার সময় বিলিয়নিয়ার হওয়ার অর্থ কী
  • অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল
  • আপিল বিভাগের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
  • সুদানে গণহত্যার প্রতিবাদে জাবি ও জবিতে মানববন্ধন
  • খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন স্থগিত
  • জুলাইবিরোধী শক্তির শাস্তি দাবিতে ইবিতে বিক্ষোভ
  • সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
  • এখন দেখছি নতুন প্রতারকের জন্ম হয়েছে: কায়সার কামাল
  • ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি ডলার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ