বঙ্গীয় বদ্বীপের প্রকৃতি যেন বিশেষভাবে ধরা দেয় ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, তিস্তার মতো বড় নদীর মধ্য ও তীরবর্তী চরাঞ্চলে। চরাঞ্চলের বাইরের বাকি বাংলাদেশের কেন্দ্র ও প্রান্তের সংগ্রাম, সংঘাতের অভিঘাতও সেখানে উপস্থিত হয় ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। এই প্রবণতা কেবল আজকের নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন কিংবা তারও আগে থেকে। যেমন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাকারী মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গীয় বদ্বীপের চরাঞ্চলীয় প্রকৃতি আমাদের সামনে ধরা পড়ে লিখিত ও মৌখিক বর্ণনায়। তবে এ ইতিহাসচর্চায় জলপ্রকৃতিকে মানুষের তৈরি এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের সহ-উৎপাদনশীল বাস্তবতা হিসেবে ভাবনার ঘাটতি রয়েছে।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে সাড়ে পাঁচটিই বর্তমানে নদীতে বিলীন। সেখানে জেগে ওঠা চরগুলোতে দশক দশক ধরে মানুষের বসতি। চরবাসীরা দেশের অন্যান্য মানুষের মতো মুক্তিযুদ্ধের বৈরী সময়ের স্মৃতি বহন করে। তবে মূলধারার ইতিহাস যেখানে ৯ মাসের গণহত্যাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত অধ্যায় বলে চিহ্নিত করে, সেখানে চরবাসী ‘হুজুগ’ শব্দটি ব্যবহার করে, কুড়িগ্রামের আঞ্চলিকতায় যার অর্থ প্রায়ই ‘দুর্যোগ’। 

তারও আগে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ– এসব ঘটনা চরবাসীর চোখে একসূত্রে গাঁথা: ক্ষুধা, বঞ্চনা ও রাষ্ট্রের প্রান্তে অসুরক্ষিত জীবন। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতো চরবাসীও রাজনৈতিক অস্থিরতার চরম ভোগান্তি সহ্য করেছে। তাদের ভাষায়, যখন নদীর গতিপথ সামলানোর স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে পড়ে, তখনই হুজুগের উদ্ভব ঘটে।
চরবাসীর কাছে নদীই প্রতিরোধ ও বাঁচার অবলম্বন। একদিক দিয়ে ‘জলপ্রকৃতি’ নিছক প্রকৃতি নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রও বটে। চরবাসীর কাছে 
নদীই একমাত্র আশ্রয় যখন অন্য সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৮০ বছর বয়সী চরবাসী ফরিদ উদ্দিন স্মরণ করেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে নদীর জলস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তিনি তখন পাশের এক চরে জমি চাষ করছিলেন। সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরার সময় হঠাৎ আকাশে বিকট শব্দ বেজে ওঠে। যুদ্ধের কথা শুনলেও এ ধরনের সাইরেন তারা কখনও শোনেননি। এর পর চোখ ধাঁধানো আলো নৌকার চারপাশ ঘিরে ফেলে। একটি বিশালাকৃতির সামরিক জাহাজ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে উর্দু ভাষায় ঘোষণা আসে: ‘খতরা, খতরা। কাশতি ভেরাও’। অর্থাৎ বিপদ, বিপদ। নৌকা ঘোরাও। ভাষা, প্রযুক্তি ও পরিস্থিতির এই অচেনা অভিজ্ঞতা তাদের হতভম্ব করে দেয়।

ফরিদরা অবশেষে ছোট ছোট খাল ঘুরে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলেও সেই অভিজ্ঞতা তাদের মনে নদীর নতুন তাৎপর্য গেঁথে দেয়– বাঁচতে হলে নদীর নাড়ি-নক্ষত্র আরও গভীরভাবে বুঝতে হবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একই অভিজ্ঞতা আরও তীব্রভাবে ফিরে আসে। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ কয়েক মাসের উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থার পর চরবাসী আবারও নদীকে ব্যবহার করার আহ্বান শুনল। বাজারে বাজারে তারা শুনতে পেল, দেশের নানা অঞ্চলে বাঙালি হিন্দুদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। পাশাপাশি জানা গেল, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্ত খুলে দিয়েছে এবং উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করেছে। যদিও ফরিদ স্বয়ং মুসলমান, তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠার আতঙ্কে ছিল।
ফরিদ খুঁজে বের করেছিলেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রৌমারী হয়ে ভারতীয় জনপদ মানকারচরে যাওয়ার দীর্ঘতর পথ, যেখানে আশপাশের অনেকে ইতোমধ্যে পালিয়ে গিয়েছিল। পথটি দীর্ঘ হলেও নদীর পূর্বপারে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল না বললেই চলে। 

পশ্চিমপারের চিলমারীতে অবশ্য এমন বিপদ ছিল অহরহ। একবার পাকিস্তানি মিলিটারি নদীতীরে গুলি চালানোর জন্য সার বেঁধে বাংকার খুঁড়ে তৈরি ছিল। কিছু ভুক্তভোগী, যারা নদী সম্পর্কে প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ, জলে ঝাঁপ দিয়ে স্রোতের টানে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়।
চরবাসী মনে করে, প্রবল ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্র নদই একাত্তরে পাকিস্তানের নৃশংস সৈন্যদের হাত থেকে তাদের বাঁচিয়েছিল। চরবাসী মনে করত, সৈন্যদের নদী সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। এমন চিন্তা পুনরায় নদীর প্রাণসঞ্চারী শক্তির বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল, বিশেষ করে মৃত্যুশঙ্কা যখন ঘনিয়ে আসে। ফরিদ চার-পাঁচবার যাতায়াত করে বহু পরিবারকে নিরাপদে পার করে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ সীমান্ত পার হওয়ার পর এতটাই কৃতজ্ঞ হয়েছিল; কৃতজ্ঞতাবশত ফরিদকে তাদের জমিই দিয়েছিল। ‘আমি বিনিময়ে কিছুই চাইনি। আমি শুধু নদীকে চিনতে শুরু করেছিলাম, আর তারা আমাকে বিশ্বাস করেছিল।’ মূলত তারা ফরিদের নদীপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দক্ষতায় আস্থা রেখেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে উদ্বাস্তু চরবাসী ফিরেছিল বদলে যাওয়া আর্থসামাজিক বাস্তবতায়। তাদের স্মৃতির শুরু থেকে জমি যদিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, রাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু ফিরে এসে দেখে, সেই সম্পর্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বহু জমির মালিক, যাদের অধিকাংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু, আর ফিরে আসেনি। এতে সামাজিক সাম্যাবস্থা ভেঙে পড়ে। দখলদারি, মালিকানা কিংবা উত্তরাধিকারের বিরোধের মীমাংসা করার উদ্যোগ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রেও কার্যকর ছিল না।

আইন অনুসারে, ভাঙন ও চর জাগার পরিমাপ জরিপকারীরা নির্ধারণ করে। চরবাসীর স্মৃতি অনুসারে, ১৯৭২ সালে তেমন জরিপ সম্পন্ন হয়নি। বহিরাগতরা, যাদের জমির সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক ছিল না, নিজেদের মালিক দাবি করে চাষাবাদ শুরু করে। জেলেরা তাদের দৈনন্দিন মাছ বিক্রির জন্য দালালদের ওপর নির্ভর করত, যারা মাছ বাজারে নিয়ে যেত। পুরোনো বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেই দালালরাও অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথম কয়েক মাসে সবাই শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। 
১৯৭২ সালে প্রথম যে সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে, চরবাসী চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থার চাপে পড়েছিল। তারা ভাবতে শুরু করে– আমরা কী শ্রম দেব, সময়-শক্তি ব্যয় করব, যদি ফসল ও মজুরি ভাগাভাগি করা না যায়। কেউ কেউ নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় চলে যায়; কেউ কেউ আয়ের উৎস খুঁজে পায় না। দ্বিতীয়ত, ১৯৭২ সালে বিপর্যস্ত সামাজিক কাঠামো কৃষি উৎপাদনের ন্যূনতম উপকরণ সংগ্রহের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বীজের অভাব দেখা দেয়। প্রচলিতভাবে বীজ ঘরেই সংরক্ষিত থাকত, কিন্তু যুদ্ধকালে সেগুলো লুট হয়ে গিয়েছিল; নতুন বীজ সংগ্রহে কয়েক মৌসুম লেগে যেত। পর্যাপ্ত লাঙল, কাস্তেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে ক্ষুদ্র চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের সম্ভাবনা সংকুচিত হতে থাকে। যুদ্ধের পরিণতি দৈনন্দিন জীবনে প্রকট হয়। 

চরবাসীর দৃষ্টিতে অর্থনীতি তখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত। পৃষ্ঠপোষকতার ধারা পুনর্গঠিত হয়ে অনাহারের এক সুস্পষ্ট পথ তৈরি হয়। নতুন রাষ্ট্রও তখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যদিও ১৯৭৪ সালে ফলন ভালো হয়েছিল; কিন্তু চিলমারী অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা আঘাত হানে। খাদ্যশস্য সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমনিতেই দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ অনাহারের নতুন পর্বের মুখোমুখি। এই সময়ে আবারও নদীর সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক স্পষ্ট হয়। অনেকে ভারতে গিয়ে ফিরে আসে। এক নারী স্মরণ করেন, অনাহারে ক্লান্ত হয়ে নদীতীরে গিয়ে জলে পড়ে গিয়েছিলেন। ছোট মাছ গিলে বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। সাহায্যকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাঁর স্মৃতি যাই হোক না কেন, তাঁর মনে নদীর সঙ্গেই জীবনের সংযোগ দৃঢ় হয়। 
আরও একটি কথা প্রচলিত; দুর্ভিক্ষকালে পোশাকহীন নারীরা গভীর বনঘেরা চরে আশ্রয় নেয়। সাহায্যকর্মীরা জামাকাপড় নদীতীরে রেখে গেলে তারা সেই পোশাক পরে ঘরে ফেরে।
চরবাসী এখনও স্মরণ করে সেই বিক্ষিপ্ত দিনগুলোকে। তাদের কাছে নদী এখনও জীবনদাতা; বিপদে রক্ষাকর্তা। যখন রাষ্ট্র বা সমাজের অন্যান্য সহায়তা ব্যর্থ হয়, তখন জলপ্রকৃতিই হয়ে ওঠে প্রতিরক্ষার হাতিয়ার। চিলমারীর মতো জনপদের ইতিহাস তাই যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতেও নদী ও জীবনের অন্তর্গত সম্পর্কের কথাও বলে।

ড.

সাদ কাশেম: ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের লেকচারার 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সম জ চরব স র প রক ত কর ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

চরাঞ্চলের জলজ জীবন ও ‘হুজুগের’ দিনগুলো

বঙ্গীয় বদ্বীপের প্রকৃতি যেন বিশেষভাবে ধরা দেয় ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, তিস্তার মতো বড় নদীর মধ্য ও তীরবর্তী চরাঞ্চলে। চরাঞ্চলের বাইরের বাকি বাংলাদেশের কেন্দ্র ও প্রান্তের সংগ্রাম, সংঘাতের অভিঘাতও সেখানে উপস্থিত হয় ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। এই প্রবণতা কেবল আজকের নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন কিংবা তারও আগে থেকে। যেমন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাকারী মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গীয় বদ্বীপের চরাঞ্চলীয় প্রকৃতি আমাদের সামনে ধরা পড়ে লিখিত ও মৌখিক বর্ণনায়। তবে এ ইতিহাসচর্চায় জলপ্রকৃতিকে মানুষের তৈরি এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের সহ-উৎপাদনশীল বাস্তবতা হিসেবে ভাবনার ঘাটতি রয়েছে।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে সাড়ে পাঁচটিই বর্তমানে নদীতে বিলীন। সেখানে জেগে ওঠা চরগুলোতে দশক দশক ধরে মানুষের বসতি। চরবাসীরা দেশের অন্যান্য মানুষের মতো মুক্তিযুদ্ধের বৈরী সময়ের স্মৃতি বহন করে। তবে মূলধারার ইতিহাস যেখানে ৯ মাসের গণহত্যাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত অধ্যায় বলে চিহ্নিত করে, সেখানে চরবাসী ‘হুজুগ’ শব্দটি ব্যবহার করে, কুড়িগ্রামের আঞ্চলিকতায় যার অর্থ প্রায়ই ‘দুর্যোগ’। 

তারও আগে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ– এসব ঘটনা চরবাসীর চোখে একসূত্রে গাঁথা: ক্ষুধা, বঞ্চনা ও রাষ্ট্রের প্রান্তে অসুরক্ষিত জীবন। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতো চরবাসীও রাজনৈতিক অস্থিরতার চরম ভোগান্তি সহ্য করেছে। তাদের ভাষায়, যখন নদীর গতিপথ সামলানোর স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে পড়ে, তখনই হুজুগের উদ্ভব ঘটে।
চরবাসীর কাছে নদীই প্রতিরোধ ও বাঁচার অবলম্বন। একদিক দিয়ে ‘জলপ্রকৃতি’ নিছক প্রকৃতি নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রও বটে। চরবাসীর কাছে 
নদীই একমাত্র আশ্রয় যখন অন্য সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৮০ বছর বয়সী চরবাসী ফরিদ উদ্দিন স্মরণ করেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে নদীর জলস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তিনি তখন পাশের এক চরে জমি চাষ করছিলেন। সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরার সময় হঠাৎ আকাশে বিকট শব্দ বেজে ওঠে। যুদ্ধের কথা শুনলেও এ ধরনের সাইরেন তারা কখনও শোনেননি। এর পর চোখ ধাঁধানো আলো নৌকার চারপাশ ঘিরে ফেলে। একটি বিশালাকৃতির সামরিক জাহাজ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে উর্দু ভাষায় ঘোষণা আসে: ‘খতরা, খতরা। কাশতি ভেরাও’। অর্থাৎ বিপদ, বিপদ। নৌকা ঘোরাও। ভাষা, প্রযুক্তি ও পরিস্থিতির এই অচেনা অভিজ্ঞতা তাদের হতভম্ব করে দেয়।

ফরিদরা অবশেষে ছোট ছোট খাল ঘুরে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলেও সেই অভিজ্ঞতা তাদের মনে নদীর নতুন তাৎপর্য গেঁথে দেয়– বাঁচতে হলে নদীর নাড়ি-নক্ষত্র আরও গভীরভাবে বুঝতে হবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একই অভিজ্ঞতা আরও তীব্রভাবে ফিরে আসে। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ কয়েক মাসের উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থার পর চরবাসী আবারও নদীকে ব্যবহার করার আহ্বান শুনল। বাজারে বাজারে তারা শুনতে পেল, দেশের নানা অঞ্চলে বাঙালি হিন্দুদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। পাশাপাশি জানা গেল, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্ত খুলে দিয়েছে এবং উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করেছে। যদিও ফরিদ স্বয়ং মুসলমান, তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠার আতঙ্কে ছিল।
ফরিদ খুঁজে বের করেছিলেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রৌমারী হয়ে ভারতীয় জনপদ মানকারচরে যাওয়ার দীর্ঘতর পথ, যেখানে আশপাশের অনেকে ইতোমধ্যে পালিয়ে গিয়েছিল। পথটি দীর্ঘ হলেও নদীর পূর্বপারে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল না বললেই চলে। 

পশ্চিমপারের চিলমারীতে অবশ্য এমন বিপদ ছিল অহরহ। একবার পাকিস্তানি মিলিটারি নদীতীরে গুলি চালানোর জন্য সার বেঁধে বাংকার খুঁড়ে তৈরি ছিল। কিছু ভুক্তভোগী, যারা নদী সম্পর্কে প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ, জলে ঝাঁপ দিয়ে স্রোতের টানে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়।
চরবাসী মনে করে, প্রবল ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্র নদই একাত্তরে পাকিস্তানের নৃশংস সৈন্যদের হাত থেকে তাদের বাঁচিয়েছিল। চরবাসী মনে করত, সৈন্যদের নদী সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। এমন চিন্তা পুনরায় নদীর প্রাণসঞ্চারী শক্তির বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল, বিশেষ করে মৃত্যুশঙ্কা যখন ঘনিয়ে আসে। ফরিদ চার-পাঁচবার যাতায়াত করে বহু পরিবারকে নিরাপদে পার করে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ সীমান্ত পার হওয়ার পর এতটাই কৃতজ্ঞ হয়েছিল; কৃতজ্ঞতাবশত ফরিদকে তাদের জমিই দিয়েছিল। ‘আমি বিনিময়ে কিছুই চাইনি। আমি শুধু নদীকে চিনতে শুরু করেছিলাম, আর তারা আমাকে বিশ্বাস করেছিল।’ মূলত তারা ফরিদের নদীপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দক্ষতায় আস্থা রেখেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে উদ্বাস্তু চরবাসী ফিরেছিল বদলে যাওয়া আর্থসামাজিক বাস্তবতায়। তাদের স্মৃতির শুরু থেকে জমি যদিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, রাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু ফিরে এসে দেখে, সেই সম্পর্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বহু জমির মালিক, যাদের অধিকাংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু, আর ফিরে আসেনি। এতে সামাজিক সাম্যাবস্থা ভেঙে পড়ে। দখলদারি, মালিকানা কিংবা উত্তরাধিকারের বিরোধের মীমাংসা করার উদ্যোগ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রেও কার্যকর ছিল না।

আইন অনুসারে, ভাঙন ও চর জাগার পরিমাপ জরিপকারীরা নির্ধারণ করে। চরবাসীর স্মৃতি অনুসারে, ১৯৭২ সালে তেমন জরিপ সম্পন্ন হয়নি। বহিরাগতরা, যাদের জমির সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক ছিল না, নিজেদের মালিক দাবি করে চাষাবাদ শুরু করে। জেলেরা তাদের দৈনন্দিন মাছ বিক্রির জন্য দালালদের ওপর নির্ভর করত, যারা মাছ বাজারে নিয়ে যেত। পুরোনো বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেই দালালরাও অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথম কয়েক মাসে সবাই শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। 
১৯৭২ সালে প্রথম যে সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে, চরবাসী চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থার চাপে পড়েছিল। তারা ভাবতে শুরু করে– আমরা কী শ্রম দেব, সময়-শক্তি ব্যয় করব, যদি ফসল ও মজুরি ভাগাভাগি করা না যায়। কেউ কেউ নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় চলে যায়; কেউ কেউ আয়ের উৎস খুঁজে পায় না। দ্বিতীয়ত, ১৯৭২ সালে বিপর্যস্ত সামাজিক কাঠামো কৃষি উৎপাদনের ন্যূনতম উপকরণ সংগ্রহের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বীজের অভাব দেখা দেয়। প্রচলিতভাবে বীজ ঘরেই সংরক্ষিত থাকত, কিন্তু যুদ্ধকালে সেগুলো লুট হয়ে গিয়েছিল; নতুন বীজ সংগ্রহে কয়েক মৌসুম লেগে যেত। পর্যাপ্ত লাঙল, কাস্তেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে ক্ষুদ্র চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের সম্ভাবনা সংকুচিত হতে থাকে। যুদ্ধের পরিণতি দৈনন্দিন জীবনে প্রকট হয়। 

চরবাসীর দৃষ্টিতে অর্থনীতি তখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত। পৃষ্ঠপোষকতার ধারা পুনর্গঠিত হয়ে অনাহারের এক সুস্পষ্ট পথ তৈরি হয়। নতুন রাষ্ট্রও তখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যদিও ১৯৭৪ সালে ফলন ভালো হয়েছিল; কিন্তু চিলমারী অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা আঘাত হানে। খাদ্যশস্য সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমনিতেই দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ অনাহারের নতুন পর্বের মুখোমুখি। এই সময়ে আবারও নদীর সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক স্পষ্ট হয়। অনেকে ভারতে গিয়ে ফিরে আসে। এক নারী স্মরণ করেন, অনাহারে ক্লান্ত হয়ে নদীতীরে গিয়ে জলে পড়ে গিয়েছিলেন। ছোট মাছ গিলে বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। সাহায্যকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাঁর স্মৃতি যাই হোক না কেন, তাঁর মনে নদীর সঙ্গেই জীবনের সংযোগ দৃঢ় হয়। 
আরও একটি কথা প্রচলিত; দুর্ভিক্ষকালে পোশাকহীন নারীরা গভীর বনঘেরা চরে আশ্রয় নেয়। সাহায্যকর্মীরা জামাকাপড় নদীতীরে রেখে গেলে তারা সেই পোশাক পরে ঘরে ফেরে।
চরবাসী এখনও স্মরণ করে সেই বিক্ষিপ্ত দিনগুলোকে। তাদের কাছে নদী এখনও জীবনদাতা; বিপদে রক্ষাকর্তা। যখন রাষ্ট্র বা সমাজের অন্যান্য সহায়তা ব্যর্থ হয়, তখন জলপ্রকৃতিই হয়ে ওঠে প্রতিরক্ষার হাতিয়ার। চিলমারীর মতো জনপদের ইতিহাস তাই যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতেও নদী ও জীবনের অন্তর্গত সম্পর্কের কথাও বলে।

ড. সাদ কাশেম: ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের লেকচারার 

সম্পর্কিত নিবন্ধ