চতুর্দশ শতাব্দীর মালি সাম্রাজ্যের সম্রাট মানসা মুসার হজযাত্রা (১৩২৪-২৫) একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই যাত্রা শুধু মালি সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রকাশই ঘটায়নি, বরং পশ্চিম আফ্রিকার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। মানসা মুসার এই হজ তাঁকে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে সুপরিচিত করে এবং মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
‘মানসা’ শব্দটি স্থানীয় ভাষায় সম্রাট বা সুলতান বোঝায় এবং মানসা মুসার পুরো নাম ছিল ‘মুসা কিতা’। ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী মুসা ১৩১২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মালি সাম্রাজ্যের শাসক হন। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং সম্রাট হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর ধনসম্পদের মূল উৎস ছিল স্বর্ণ ও খনিজ লবণের বাণিজ্য। তৎকালীন বিশ্বের স্বর্ণ ও লবণের অর্ধেকই মালি সাম্রাজ্য থেকে আহরিত হতো এবং মানসা মুসা এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে অগাধ সম্পদের মালিক হন। তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক ছিলেন, যিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর উপাধির মধ্যে ছিল ‘প্রথম মুসা’, ‘মালির আমির’, ‘ওয়াংগারা খনির সম্রাট’, ‘কনকান মুসা’, ‘মালির সিংহ’ ইত্যাদি।
মানসা মুসা একজন ধার্মিক মুসলমান ছিলেন এবং তাঁর হজযাত্রার পেছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় উদ্দেশ্য ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, দুটি প্রধান কারণ ছিল:
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন১৯ এপ্রিল ২০২২মানসা মুসা ভুলবশত তাঁর মাকে হত্যা করেছিলেন, যার জন্য তিনি গভীর অনুশোচনায় ভুগতেন। প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তিনি ব্যাপক দান করতেন এবং সারা বছর রোজা রাখতেন। তবু মানসিক শান্তি না পেয়ে তিনি আলেমদের পরামর্শে হজ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। আলেমগণ তাঁকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
এ ছাড়া মানসা মুসা তাঁর হজযাত্রার মাধ্যমে মালি সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ ও শক্তি বিশ্বের কাছে প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোট গঠন এবং মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দেওয়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।
১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে মানসা মুসা মালি থেকে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় তিনি একটি বিশাল কাফেলা নিয়ে রওনা হন, যা ইতিহাসে তাঁর সমৃদ্ধি ও মহানুভবতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর কাফেলায় ছিল প্রায় ৬০ হাজার পুরুষ ও নারী, যার মধ্যে ১২ হাজার ক্রীতদাস ছিল। তাঁর প্রথম স্ত্রী, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সরকারি কর্মকর্তারাও সফরসঙ্গী ছিলেন। ধনসম্পদ ছিল অঢেল। ৮০টি উটে ৩০০ পাউন্ড ওজনের স্বর্ণ বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া ছিল ৫০০ ক্রীতদাস, যারা স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণখণ্ড, খনিজ লবণ এবং মূল্যবান মণিরত্ন বহন করছিল।
যাত্রাপথে মানসা মুসা গরিব ও দরিদ্রদের অর্থ, খাদ্য ও বস্ত্র দান করেন। শহরের শাসকদের প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেন এবং বিভিন্ন স্মারক ক্রয় করেন। তিনি প্রতি শুক্রবার একটি করে মসজিদ নির্মাণ করেন।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫কাফেলাটি সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করে মিসরের কায়রোতে পৌঁছায়। সেখানে তাঁর সম্পদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বণিকেরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। মানসা মুসা এত বেশি স্বর্ণ ব্যয় করেন যে মিসরের বাজারে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতিতে ধস নামে। ফেরার পথে তিনি উচ্চ সুদে স্বর্ণ ধার করে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে মিসরের স্বর্ণের বাজার স্বাভাবিক হতে প্রায় এক দশক লাগে।
মক্কায় পৌঁছে মানসা মুসা হজ পালন করেন। মক্কার জ্ঞানবিজ্ঞানের সমৃদ্ধি তাঁকে মুগ্ধ করে। ফেরার সময় তিনি চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত ও আইনের বই, সেই সঙ্গে মক্কার শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থপতিদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই স্থপতিরা মালিতে পোড়া ইট দিয়ে পাঁচটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা ইসলাম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মানসা মুসার হজযাত্রা মালি সাম্রাজ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। যেমন এই যাত্রা ইসলামকে পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়। মানসা মুসা তাঁর শাসনপদ্ধতিতে ইসলামিক নীতি ও সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন, যা শিক্ষা ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।
মালির শহরগুলোতে নতুন স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণকৌশল প্রবর্তিত হয়, যা পশ্চিম সুদানে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে ছিল সাংকোরে মাদ্রাসা (ইউনিভার্সিটি অব সাংকোরে), হল অডিয়েন্স এবং গ্র্যান্ড প্যালেস। মানসা মুসা মরক্কোর মারাকেচ, মিসরের কায়রো ও আন্দালুসিয়ার টোলেডোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি তিউনিস ও মিসরের সঙ্গে মালির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরে টিম্বাক্টু ও গাওকে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়। সাংকোরে মাদ্রাসা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে।
মানসা মুসার সম্পদ ও খ্যাতি মালিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দেয়। কার্টোগ্রাফার অ্যাঞ্জেলিন ডুলসার্ট তাঁর প্রতিকৃতি মানচিত্রে অঙ্কন করেন এবং বিখ্যাত কাতালান অ্যাটলাস-এ তাঁকে স্বর্ণখণ্ড ও রাজদণ্ড হাতে সাহারার মধ্যবিন্দুতে চিত্রিত করা হয়।
(সূত্র: পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ,মুহাম্মদ সাঈদ হাসান শিকদার, প্রথমা প্রকাশন)
আরও পড়ুনঅতি মূল্যবান ও পবিত্র হাজরে আসওয়াদ১০ জুন ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র হজয ত র র স বর ণ ন কর ন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রাস্তা খারাপ তাই কেউ বিয়ে করতে চায় না!
‘‘এই রাস্তায় দশ চাহার (চাকা) গাড়ি চলে। রাস্তাঘাট ভাঙা। সরকার কোনো কাম করে না। ধরেন, ১২-১৪ বছর কেউ মিয়া ছোয়ালপাল বিয়া দিবার পারে না। এদেশে কেউ বিয়ে করতিও চায় না, দিতিও চায় না।’’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব সাদেক আলী। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের উত্তর মুলগ্রামের বাসিন্দা।
একই ইউনিয়নের হিজলাকর গ্রামের তরিকুল ইসলামের স্ত্রী শিলা খাতুন বলেন, ‘‘ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখতে এসে বলে, গ্রামের রাস্তা ভালো না। পরিবেশ ভালো না। এইটা বলে বিয়ে ভেঙে দেয়।’’
তার ভাষ্য, দেড় মাস আগে সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে তার ননদের বিয়ে ভেঙে গেছে।
২০০৬ সালে সদকী ইউনিয়নের জিলাপীতলা বাজার থেকে গড়াই নদীর বালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিটার গ্রামীণ সড়ক পাকা করা হয়। প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি টাকার বালুর ঘাট ইজারা দেয় স্থানীয় প্রশাসন। প্রতিদিনই এই সড়ক দিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ বালুভর্তি ছয় চাকা ও দশ চাকার ডাম্প ট্রাক চলে। এতে সড়কের কার্পেটিং উঠে অসংখ্য খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালু আর বর্ষায় জমে থাকে কাদাপানি। এতে সারাবছরই চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় জিলাপীতলা, হিজলাকর, উত্তর মুলগ্রামসহ আশপাশ এলাকার অন্তত প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দাকে।
সড়কটি সংস্কারের দাবিতে সম্প্রতি কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক সড়কের জিলাপীতলায় মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। পরে ভাঙা ও জরাজীর্ণ সড়কে ধানের চারা রোপণ করে প্রতিবাদ জানান তারা।
সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের কার্পেটিং উঠে গেছে অনেক আগেই। অসংখ্য খানাখন্দে ভরে আছে গোটা সড়ক। ভারী যানবাহন চলায় সড়কের দুই পাশে নালার মতো গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তাতে জমে আছে কাদাপানি।
এলাকার কৃষক নাজমুল হোসেন বলেন, ‘‘দিন-রাত শত শত বালুর গাড়ি চলে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি কাঁচা নাকি পাকা সড়ক। কাদাপানির কারণে এই সড়ক দিয়ে অটোভ্যান, সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ কোনো গাড়ি আসতে চায় না। মাথায় করে কৃষি পণ্য আনা-নেওয়া করা লাগে। এতে খরচ ও ভোগান্তি উভয়ই বেশি হয়।’’
স্থানীয় গৃহিণী নাজমা খাতুন বলেন, ‘‘শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালুতে বাড়িঘরে টেকা যায় না। নোংরা খাবার খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়িও পাওয়া যায় না।’’
একাধিকবার স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান ও প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি বলে জানিয়েছেন সদকী ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘এলাকার মানুষ এই ৭০০ মিটার সড়কের কাছে অসহায়।’’
ভ্যাটসহ প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে জিলাপীতলা বালুর ঘাট ইজারা নিয়েছেন কুমারখালী পৌর বিএনপির সভাপতি মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘নদীতে পানি বাড়ায় বালু তোলা বন্ধ আছে। যেহেতু সরকার রাজস্ব আয় করছে, সেহেতু সরকারকেই রাস্তা মেরামত করতে হবে।’’
গ্রামীণ সড়কে ভারী যানবাহন চলা নিষিদ্ধ হলেও ঘাটের কারণে বালুর গাড়ি চলাচল করে জানিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ নাজমুল হক বলেন, ‘‘সিসি ঢালাই ছাড়া কার্পেটিং করে লাভ হবে না। বরাদ্দ পেলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’
কাঞ্চন//