যানজটের কবলে পড়ে আরেকটি দুঃসহ দিন পার করল রাজধানীবাসী। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে গত ১৪ মে থেকে চলছে এই অবস্থা। সেই সঙ্গে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্দোলন তো আছেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিনের প্রথম ভাগে হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। কর্মসূচি-বৃষ্টি-জলাবদ্ধতার সঙ্গে যানজটে কার্যত অচল হয়ে যায় রাজধানী।
আন্দোলন শুরুর পর বিকেল ৫টা থেকে প্রতিদিন রাস্তা ছেড়ে দিলেও গত বুধবার থেকে আর রাস্তা থেকে সরেনি আন্দোলনকারীরা। ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা গুলিস্তান থেকে শুরু করে হাইকোর্ট, প্রেস ক্লাব, মৎস্য ভবন হয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন-সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। এক পর্যায়ে তারা যমুনার পাশে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে জমায়েত হতে থাকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। ফলে সকাল থেকেই পুরো এলাকায় যান চলাচল ছিল বন্ধ। সেই সঙ্গে শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে শাহবাগে সড়কে অবস্থান নেয় ছাত্রদল। এর প্রভাব পড়তে শুরু করে প্রায় পুরো রাজধানীতে।
এদিকে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ছিল অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ সমাবেশ। পাশাপাশি যাত্রাবাড়ীতে সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। সড়কগুলোতে পানি জমে কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। বাড়তি হিসেবে ছিল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস ও ভিভিআইপি মুভমেন্ট। সব মিলিয়ে গত ক’দিনের চেয়ে গতকাল যানজটের ভয়াবহতা ছিল বেশি। এতে বিপাকে পড়েন সাধারণ যাত্রী ও গাড়িচালকরা।
তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা নিগার সুলতানা ১০ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মালিবাগে যাওয়ার জন্য ফার্মগেট থেকে রিকশায় ওঠেন। যানজটের কারণে বিভিন্ন পথ ঘুরে যখন তিনি ইস্কাটনের মগবাজার ফ্লাইওভারে ওঠার পয়েন্টে পৌঁছান, তখন দুপুর আড়াইটা। ক্ষোভ প্রকাশ করে নিগার সুলতানা বলেন, ‘দেশে যে কী এক অবস্থা শুরু হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারি না! যেভাবে রিকশা এগোচ্ছে, তাতে কয়টায় গিয়ে পৌঁছাব, জানি না। আবার ব্যাগবোঁচকা নিয়ে হেঁটে যে যাব, সে অবস্থাও নেই। কী যে বিপদে পড়েছি!’
দুপুরে গাজীপুর থেকে গুলিস্তানগামী বনশ্রী পরিবহনের বাসচালক ইসমাইল মোল্লা বলেন, ‘সকাল ৯টায় গাজীপুর থেকে রওনা হয়েছি। এখন দুপুর আড়াইটা বাজে। মগবাজার সিগন্যালও পার হতে পারিনি। অন্যদিন দুটি করে রাউন্ড ট্রিপ দিতাম। আজকে এক ট্রিপই মনে হয় দিতে পারব না।’
গুগল ম্যাপ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম গ্রুপ ট্রাফিক অ্যালার্টের মাধ্যমে জানা যায়, অবরোধ আর বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট যানজট মগবাজার, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, এয়ারপোর্ট রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, হাতিরঝিল, মহাখালীসহ আরও অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বিপাকে পড়েন রোগীরা।
অ্যাম্বুলেন্সগুলোও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে। পুরান ঢাকার সদরঘাট, বাবুবাজার, সায়েদাবাদ থেকে শুরু করে মতিঝিল, গুলিস্তান, বিজয়নগর, নীলক্ষেত, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় যানজট পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
মোহাম্মদপুর থেকে রামপুরাগামী রমজান পরিবহনের যাত্রী ইকবাল ইসলাম বলেন, ‘সংসদ ভবনের সামনে থেকেই যানজট শুরু হয়েছে। বাস আর এগোয় না। ফার্মগেট থেকে বাংলামটর হয়ে মগবাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে লেগেছে দুই ঘণ্টা। ফ্লাইওভারের ওপরেও একই অবস্থা।’
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা অটোরিকশাচালক ইশারফ হোসেন বলেন, ‘গত কয়দিন ধরে এত যানজট, দৈনিক জমার টাকা তোলাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একেক দল তাদের স্বার্থে রাস্তা বন্ধ করে। আর আমাদের সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। এ দেশে সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবে না।’
সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের রমনা জোনের উপপুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অবরোধ তুলে নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে খারাপ অবস্থা হয়েছিল। মগবাজার ফ্লাইওভারের যেসব পয়েন্টে দোতলা আছে, বৃষ্টির সময় সব মোটরসাইকেল চালক তার নিচে আশ্রয় নেন। কেউ বৃষ্টিতে ভিজতে চান না। ফলে ফ্লাইওভারও ব্লক হয়ে যাওয়ায় অন্য যানবাহনগুলো যেতে পারছিল না। এতে অবস্থার বেশি অবনতি হয়।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ ল ইওভ র মগব জ র এল ক য় য নজট অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।