উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই আধুনিকতার আঁচ লাগতে শুরু করে পৃথিবীব্যাপী। আর তার সূতিকাগার ছিল ইউরোপ। শিল্প বিপ্লবোত্তরকালে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে মানুষের চিন্তাভাবনা ও জীবনাচরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একসময় কল্পনার যে ভাবালু জগতে মানুষ বাস করত, সেখান থেকেও বেরিয়ে আসতে থাকে এই উনিশ শতকেই। ইউরোপব্যাপী সংঘটিত নব নব আবিষ্কার ও অনুসন্ধান মানুষকে পৌঁছে দেয় জীবনবোধের নতুন পর্যায়ে। এভাবেই মানুষ রোমান্টিসিজম থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তববাদের দিকে ধাবিত হয়। উনিশ শতকের ৪৮ সালে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস প্রকাশ করেন পৃথিবীব্যাপী সাড়া জাগানো ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’। শিল্প বিপ্লবোত্তরকালে ইউরোপের মানুষ যে গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরের দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছিল, নতুনভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজে নিযুক্ত হচ্ছিল; তাদের অধিকার ও দায়িত্ববোধ নিয়ে নতুন ভাবনার সঞ্চার করেছিল এই কমিউনিস্ট চিন্তাধারা। তখন এই নব্য শ্রমিক শ্রেণিকে বলা হতো মডার্ন প্রলেতারিয়েত।

ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে এই উনিশ শতকেই তাঁর ‘পজিটিভিজম’ ভাবনার প্রকাশ ও প্রচার করতে থাকেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন অরিজিন অফ স্পিসিস গ্রন্থটি। যার মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে এক নতুন ধারণা পেল। মানুষের ধর্মবোধে পরিবর্তন এল, অলীক কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে ইহজাগতিক বাস্তব জগতের মুখাপেক্ষী হতে শুরু করল। উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে মুহুর্মুহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষকে বারংবার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে এই বাস্তব জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও স্বপ্নবিষয়ক তত্ত্ব প্রকাশিত হয় এই শতকেই। অলীক কল্পনার যে জগৎ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, সেখানেও মানুষ সদর্পে পা বাড়ায় এবার। রাশিয়ান বিজ্ঞানী ইভান পাভলভ তাঁর কন্ডিশনড রিফ্লেকস তত্ত্ব প্রকাশ করেন কাছাকাছি সময়েই।

কোঁতে, ডারউইন, কার্ল মার্ক্স, ফ্রয়েড, পাভলভসহ আরও অনেকের যুগান্তকারী আবিষ্কার এই শতকের মানুষের ভাবনার জগতে যারপরনাই পরিবর্তন করে দেয়। তাছাড়া শিল্প বিপ্লবের আশু ফল মানুষের জীবনযাত্রাকে আগের তুলনায় যন্ত্রমুখী ও শৃঙ্খলিত করে তোলে এই সময়ে এসে। শিল্প-সাহিত্যে আমরা এই পরিবর্তনকে অবলোকন করি ‘রোমান্টিসিজম থেকে রিয়েলিজমে’ বিবর্তনের মাধ্যমে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে ভাবনার বীজ রোপিত হয়, শেষার্ধে গিয়ে তা-ই যেন পূর্ণতা পায়। মানুষের জীবনবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শিল্পে নিবিষ্ট হয়েই দ্বিপাক্ষিক সৌন্দর্য তৈরি করে। বাস্তববাদও শিল্পে এসে পূর্ণতা পেয়েছে। শিল্প জীবন ঘনিষ্ঠ হয়েই প্রকৃত প্রস্তাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। বাস্তবাবাদী ধারার প্রকৃত বিকাশ ঘটেছে নাটকের বুননসুতার মাধ্যমে। শুরুর দিকে ইউরোপেই সেই ধারা পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তববাদী ধারার নাট্যকারদের মধ্যে সেইরকম একজন পথিকৃৎ নর‍ওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন। নরওয়ের শিয়েন শহরে ১৮২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পরপরই রোমান্টিসিজমের ঝাণ্ডা সরিয়ে নাটক ও শিল্পকলায় বাস্তববাদের চর্চা শুরু হয়। চিত্রকলার মাধ্যমে বাস্তববাদের যাত্রা শুরু হলেও ক্রমশ তা শিল্পের অন্যান্য অঙ্গনে সদর্পে ঢুঁ মারতে থাকে।

হেনরিক ইবসেনের বাস্তববাদী ধারার নাটক অ্যা ডলস হাউস প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালে। নাটকটির কথা প্রথম শোনা যায় ১৮৭৮ সালের মে মাসে। বন্ধু হেজেলের কাছে লেখা একটি চিঠিতে ইবসেন উল্লেখ করেন, তিনি আধুনিক মানুষের জীবন নিয়ে একটি নাটকের কাজ করছেন। ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে অ্যা ডলস হাউস নাটকটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ পাওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় সেটি মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকের ভাবনা ও গড়ন তৎকালীন ইউরোপের গোঁড়া সমাজকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

নাটকটিতে আমরা কেন্দ্রিয় চরিত্র নোরা এবং তাঁর স্বামী টোরভাল্ড হেলমারের সাজানো-গোছানো সাংসারিক জীবনের চিত্র দেখতে পাই, যেখানে নোরা যেন হেলমারের পোষমানা ছোট পাখি। কিন্তু সেই ছোট ময়না পাখিটিই যে একদিন সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে উড়ে যেতে চাইবে এবং উড়েও যাবে, সে কথা শুধু হেলমার নয়, তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থার কোনো অংশীদারই মেনে নিতে পারেনি। নোরা একজন নারী হিসেবে যা করেছে সবই তার অকুণ্ঠ ভালোবাসার সুবাদে করেছে–এই তার দাবি। অন্যদিকে হেলমারের দাবি সেও নোরাকে ভীষণরকম ভালোবাসত, কিন্তু নোরা তার সাথে ভণ্ডামি করেছে। নাটকটির এক পর্যায়ে হেলমারের সংলাপের মধ্যে নোরার প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পায় এভাবে–“এখন মানুষ ভাববে আমিও তোমার সাথে এই অসৎ কাজে যুক্ত। আমিই তোমাকে দিয়ে এসব কাজ করিয়েছি।”

নোরার স্বামী টোরভাল্ড হেলমার যাকে অসৎ কাজ বলে চিহ্নিত করেছে তা তৎকালীন ইউরোপের সমাজ-ব্যবস্থায় দৃষ্টিকটু হলেও নোরা তা করেছে কেবলমাত্র ভালোবাসার তাগিদে। সে ভেবেছিল অন্তত স্বামী তাকে বুঝবে। নয়তো কেন সে বাবার স্বাক্ষর নকল করে টাকা ধার করতে যাবে? এ সবই সে করেছে তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা থেকে, স্বামীকে সুস্থ করে তোলার জন্য।

কিন্তু নোরা যখন বুঝতে পারে হেলমার তাকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না, কেবল কলের পুতুল বানিয়ে রাখতে চায়, তখনই তার মোহভঙ্গ হয়। উপলব্ধি জাগে, সেও তো মানুষ! উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ পাই নোরার এই সংলাপটিতে–“অন্তত আর যাই হোক আমি নিজেও একজন মানুষ–যেমনটা তুমি, তেমনটা আমিও।”

অর্থাৎ নারী শুধুমাত্র পুরুষের হাতের পুতুল নয়, মানুষ হিসেবে তাঁরও স্বাধীন জীবনের অধিকার আছে। নাটকটির শেষাংশে নোরা দরোজায় সজোরে আঘাত করে পথে বেরিয়ে পড়ে; আর তা যেন ওই গোঁড়া সমাজের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ।

উনবিংশ শতকেই মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষের অধিকার সম্পর্কে ভাবতে শেখে ইউরোপ। সাংসারিক জীবনে নারী ও পুরুষের মাঝে পারস্পরিক নতুন বোঝাপড়াও তৈরি হয় এই সময়ে। আর এই বাস্তববাদী ভাবনায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল হেনরিক ইবসেনের অ্যা ডলস হাউস নাটকটি। এখানে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছে নোরা। মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষই যে সমান অধিকারের দাবিদার সে সত্যই প্রোথিত হয়েছে নাটকে। এই নোরাই পরবর্তীকালে মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিল সমগ্র ইউরোপের নারীদের প্রতিভূ হিসেবে। ইবসেনের ভাবনা-ভূমিতে নোরার জন্ম হলেও ক্রমশ নোরা হয়ে ওঠে প্রতিবাদী-সাহসী নারী, রক্ত মাংসের মানুষ।

১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরে নাটকটি প্রকাশের তিন সপ্তাহের মাথায় নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনে ডেনমার্কের থিয়েটার দল রয়াল কোপেনহেগেন। নাটকটি প্রকাশ ও মঞ্চায়নের পর ইউরোপজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। উনিশ শতকের ইউরোপে মেয়েদের জন্য স্বামীর কথা অমান্য করে স্বাধীনভাবে চলাফেলার কোনো সামাজিক অনুমোদন ছিল না। সেখানে নোরা বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার মতো সাহস দেখিয়ে ইউরোপের পুরুষতান্ত্রিক, গোঁড়া ও ধর্মান্ধ সমাজ-কাঠামোর মূলে প্রবল চপেটাঘাত করেছে। নোরার এই অকাট্য সাহস তৎকালীন ইউরোপের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নাটকটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইউরোপের তৎকালীন গোঁড়া সমাজ চেতনা এই নাটককে ভালোভাবে নেয়নি। ডেনমার্কের থিয়েটার রয়াল কোপেনহেগেন নাটকটির পূর্ণাঙ্গ মঞ্চায়ন করলেও ইউরোপের অনেক দেশেই নাট্যকার ইবসেনকে নাটকটি পরিমার্জন ও সম্পাদনা করে মঞ্চস্থ করতে হয়। নাটকটি জার্মানিতে মঞ্চস্থ হয় ১৮৮০ সালে। সেখানে জার্মানদের পুরুষতান্ত্রিক সংকীর্ণতা নোরাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয়নি। শেষ দৃশ্যে নিজের ঘুমন্ত সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নোরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে এবং তার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটি টুপ করে পড়ে যায়।

একবিংশ শতকে এসে ইউরোপ আজ পৃথিবীর বুকে আধুনিকতার তকমা জুটিয়েছে। ধর্মীয় কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক একরোখা দৃষ্টিভঙ্গির বদলে নারী অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছে। উনিশ শতকে স্বামীর ঘরে একটি ছোট্ট ময়না পাখি হয়ে থাকা নোরার সেই সাহসী পদক্ষেপই যেন আজও সারা বিশ্বের নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব স তবব দ প রক শ প ন টকট র র ইউর প ইউর প র ভ বন র শতক ই প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টস জিতে ব্যাট করছে বাংলাদেশ

নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। বিশাখাপত্তনমে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে তিনটায় মাঠে গড়িয়েছে ম্যাচটি। বাংলাদেশের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে বাংলাদেশ দুটি পরিবর্তন এনেছে। অস্ট্রেলিয়াও তাদের একাদশে দুটি পরিবর্তন এনেছে।

আরো পড়ুন:

নাঈমকে বাদ দিয়ে সৌম‌্যকে ফেরাল বিসিবি, নতুন মুখ মাহিদুল

বিশ্বকাপের আরো এক ম্যাচ বৃষ্টির পেটে

টস জিতে জ্যোতি বলেন, “আজ আমাদের মূল লক্ষ্য হলো বোর্ডে ভালো একটা স্কোর দাঁড় করানো। আগের ম্যাচে আমরা কমপক্ষে ৩০–৪০ রান কম করেছি। আজ দলে দুটি পরিবর্তন এনেছি ফারিহা তৃষ্ণা ও নিশিতা আখতার ফিরেছেন একাদশে। আমাদের বোলিং ইউনিটটা খুবই শক্তিশালী। আগের ম্যাচে নাহিদা আক্তার চোট পেয়েছে, ওর কিছুটা সময় লাগবে সেরে উঠতে। আগের ম্যাচের পর মানসিকভাবে সামলে ওঠা কঠিন ছিল, কিন্তু কোনো অজুহাত দিতে চাই না। আমরা চাই খেলা উপভোগ করতে, নিজেদের শতভাগ উজাড় করে দিতে।”

অ্যালিসা হিলি বলেন, “আমিও আসলে টস জিতলে ব্যাটিংই নিতে চেয়েছিলাম। আজ বাতাসটা মনোরম, সূর্যের আলোও ভালো—মেয়েরা খেলতে উপভোগ করবে নিশ্চয়ই। ২০১১ সালে এই মাঠটা ছিল আমার প্রিয় জায়গা, তাই এখানে খেলতে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে। নতুন প্রতিপক্ষ, নতুন চ্যালেঞ্জ। দলে দুটি পরিবর্তন এনেছি- ডার্সি ব্রাউন ফিরেছে কিম গার্থের জায়গায়, আর জর্জিয়া ওয়ারহ্যাম খেলছে সোফি মোলিনিউক্সের জায়গায়। ইন্দোরে টানা দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আছে, তাই সবাইকে সতেজ রাখতে চাই। ব্রাউনকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ও কীভাবে শুরু করে সেটা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি।”

বাংলাদেশ একাদশ:
রুবিয়া হায়দার, ফারজানা হক, শারমিন আখতার, নিগার সুলতানা (অধিনায়ক ও উইকেটকিপার), সোবহানা মোস্তারি, শর্না আখতার, ফাহিমা খাতুন, রাবেয়া খান, রিতু মনি, নিশিতা আখতার নিশি ও ফারিহা তৃষ্ণা।

অস্ট্রেলিয়া একাদশ:
অ্যালিসা হিলি (অধিনায়ক ও উইকেটকিপার), ফিবি লিচফিল্ড, এলিস পেরি, বেথ মুনি, আনাবেল সাদারল্যান্ড, অ্যাশলি গার্ডনার, তাহলিয়া ম্যাকগ্রা, জর্জিয়া ওয়ারহ্যাম, ডার্সি ব্রাউন, আলানা কিং ও মেগান শাট।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ