Samakal:
2025-07-08@17:21:12 GMT

বাণিজ্যিক আঙুর চাষে সফলতা

Published: 23rd, May 2025 GMT

বাণিজ্যিক আঙুর চাষে সফলতা

দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে। দেশের বাজারে চাহিদা থাকার কারণে অনেকে এসব ফল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। অনেক তরুণ চাকরির পেছনে না ছুটে গ্রামে ফিরে বাণিজ্যিক চাষে সফলতাও পেয়েছেন। বিদেশ থেকে ফিরে অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন এসব ফল চাষে। তাদের যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেছেন সাহসী উদ্যোক্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় তরুণ উদ্যোক্তাদের আঙুর চাষের সাফল্য নিয়ে লিখেছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাহিদুর রহমান

চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, তুরস্ক, চিলি, আর্জেন্টিনা, ইরান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি আঙুর উৎপাদন হয়। ফলটি প্রায় সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশের বাজারেও পাওয়া যায় সবুজ ও লাল বা বেগুনি রঙের আঙুর। এ দেশের শহর থেকে গ্রামাঞ্চল প্রায় সর্বত্রই এই ফলটির চাহিদা রয়েছে। আবহাওয়া, মাটি ও বাণিজ্যিক চাষের জ্ঞানের অভাবসহ নানা কারণে ফলটি চাষে আগ্রহ খুব একটা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি এই ফল দেশেই চাষ হচ্ছে। জনপ্রিয় এই ফলটি চাষে সফলও হয়েছেন দেশের অনেক চাষি। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জেলায় চাষিরা লাভজনক এই ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। 

কৃষি কর্মকর্তা ও চাষিরা বলছেন, বাংলাদেশের মাটিতেও আঙুর চাষ করে সফল হওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নাটোর, ময়মনসিংহ, খাগড়াছড়ি, চাঁদপুর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ঠাকুরগাঁও জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষ হচ্ছে। একদল সাহসী তরুণ উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন আঙুরের বাগান। 

দেশে আঙুর চাষে গবেষণার শুরু যেভাবে
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে গাজীপুরের বিএডিসির উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আঙুর চাষের চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যক্তি বা বেসরকারি উদ্যোগে খুব বেশি প্রচেষ্টার কথা আগে শোনা যায়নি। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি আঙুর চাষের ওপর একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয় ১৯৯৯ সালের দিকে। এর আওতায় দেশের প্রান্ত থেকে দেশি-বিদেশি জাত সংগ্রহ করে একাডেমির ২ নম্বর নার্সারিতে ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ট্রায়াল দেওয়া হয়। আশাব্যঞ্জক জাতগুলো ২০০৪ সালে ১ নম্বর নার্সারিতে স্থানান্তর করা হয়। নার্সারি স্থানান্তরের পর ২০০৭ সালে ৩টি, ২০০৮ সালে ৫টি, ২০০৯ সালে ৬টি, ২০১০ সালে ৭টি, ২০১১ সালে ৮টি, ২০১২ সালে ১০টি ও ২০১৩ সালে ১১টি জাত নিয়ে উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়। এসব জাতের মোট ৫৫টি গাছের মধ্যে ৪৪টিতে ফুল-ফল ধরে।

জেলায় জেলায় আঙুর চাষ
যশোরের চৌগাছা উপজেলার কামরুজ্জামান এমিল দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসজীবনে আঙুর চাষ দেখে মুগ্ধ হন। সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা। দেশে ফিরে এসে কৃষিকে জীবনের লক্ষ্য বানান। ভাবনায় প্রথমেই ছিল আঙুর চাষ। একা পথচলা সহজ ছিল না। পাশে এসে দাঁড়ান চুয়াডাঙ্গার অভিজ্ঞ কৃষি উদ্যোক্তা মোকারম হোসেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে আঙুরের জাত ও উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন।
দুজনের উদ্যোগের ফসল আজ দুই বিঘা জমিতে রাশিয়ান জাতের বাইকুনুর আঙুর। লতায় লতায় থোকা থোকা মিষ্টি রসালো আঙুর। এলাকার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন সেই বাগান। কাছের জেলা থেকে দূরের জেলা কৃষি উদ্যোক্তারা আসছেন দেখতে, শিখতে।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে আঙুর চাষ। বিদেশি বাইকুনুর জাতের আঙুর চাষে সফলতা পেয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তারা। গাছ লাগানোর এক বছর পর পরিপূর্ণভাবে ফুল ও ফল ধরতে শুরু করে। এ বছর উপজেলায় ৩৫ বিঘা জমিতে আঙুর চাষ হয়েছে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, এ মৌসুমে ওই জমি থেকে প্রায় ৩০০ মণ আঙুর উৎপাদন হবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের পেয়ারাতলা গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা রুহুল আমিন রিটন ২০১৯ সালে অল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে আঙুর চাষ শুরু করেন। শুরুতে ফলন ভালো হতো না। আঙুর গাছের জাত পরিবর্তন করেও সফলতা পাচ্ছিলেন না এই কৃষি উদ্যোক্তা। সবশেষ বাইকুনুর জাতের আঙুর চাষ করে সফলতা পান তিনি। এর পর বেশ কয়েকজন কৃষক উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ছোট-বড় পরিসরে আঙুর বাগান গড়ে তোলেন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার জন্য।

২০২৪ সালে আঙুর বাগানে ফুল আর ফল আসে। বাগান মালিকরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন ওই এলাকার আবহাওয়া ও মাটিতে আঙুর চাষ করে সফলতা পাওয়া যাবে। এ বছর এসব বাগানে ফুল আসে অনেক। ফুল থেকে ফলে পরিণত হয়। বাগানজুড়ে থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর। এ বছর বাইকুনুর জাতের আঙুর বাগানে মার্চ মাসের শুরু থেকে গাছে ফুলে ভরে যায়। ফুল আসার ২০-২৫ দিনের মধ্য ফলে রূপ নেয়। এখন ফল পেকে গেছে, বিক্রি শুরু হয়েছে। 

আঙুর চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর বাগানে পরিপূর্ণ ফল আসে; যা দেখে আমরা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রতিটি গাছে ১৫-২০ কেজি ফল ধরেছে। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হচ্ছে। বাজারে আঙুরে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ৩৫ বিঘা জমি থেকে এ মৌসুমে প্রায় ৩০০ মণ আঙুর উৎপাদন হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা।’
লাল, কালো আর সবুজ রঙের আঙুরে ভরে উঠেছে ময়মনসিংহের একটি ছোট্ট বাগান। মাত্র ৭ শতাংশ জমিতে ১৩ জাতের বাহারি আঙুর চাষ করে নজর কেড়েছেন কলেজপড়ুয়া তরুণ সুমন মিয়া। সুমন মিয়া বলেন, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিভিন্ন দেশের চাষ পদ্ধতি দেখে ২০২২ সালে যশোর থেকে ভারতীয় জাতের ২৭টি আঙুরের চারা এনে তিনি নিজ বাড়ির পাশে রোপণ করেন। প্রথম বছর ফলনে আশানুরূপ মিষ্টতা না থাকায় হতাশ হন সুমন। এর পর দুই বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে চলতি বছর নতুনভাবে বাগান সাজান। নাটোর, রাজশাহী, ফরিদপুর, জামালপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৩ জাতের ৬০টি চারা সংগ্রহ করেন। ২৫টি গাছ নষ্ট হয়ে গেলেও বাকি ৩৫টি গাছে এবার ফলন ভালো হয়েছে। আঙুর বাগানে শুধু ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া অন্য রাসায়নিকের প্রয়োজন হয় না। এ মাসের শুরু থেকে পাকতে শুরু করেছে আঙুর। আগামী মাসের শেষে পুরো বাগানের ফল বিক্রি শেষ হবে।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাছরিন আক্তার বানু বলেন, জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষের উদাহরণ নেই। অনেকের ধারণা, এখানকার মাটিতে আঙুর টক হবে। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে সুমনের বাগান। তাঁর বাগানের আঙুর মিষ্টি। আঙুরের চারা তৈরিতেও সুমন দক্ষ হয়ে উঠছেন।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার হরিকুমার মহাজনপাড়া (মায়াফাপাড়া) এলাকার বাসিন্দা বিভাস ত্রিপুরা (৪৮)। শখের বশে ২০১২ সালে নিজ বসতবাড়ির পেছনে একটি আঙুর গাছ লাগিয়েছিলেন। সে আঙুর গাছে পাঁচ বছর পর থেকে ফলন আসছে। একটি গাছে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ কেজি আঙুর হয়। এ বছর তাঁর গাছে বেশ আঙুর ধরেছে।

প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে বাণিজ্যিক চাষে সফল হয়েছেন চাঁদপুরের যুবক কামরুজ্জামান প্রধানিয়া। মাত্র ২০ শতক জমিতে আঙুর চাষ করেছেন তিনি। তাঁর সংগ্রহে এখন পর্যন্ত ১৮ দেশের ৮৫টি জাতের আঙুর গাছ আছে। এরই মধ্যে ফলন ভালো হওয়ায় আঙুর বাজারজাত করেছেন। প্রতিদিন জেলা-উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই বাগান দেখতে আসেন।
শেরপুরের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে আঙুর ফল। ভারত থেকে চারা সংগ্রহ করে নিজের ১৫ শতাংশ জমিতে রোপণ করেছেন উদ্যোক্তা জলিল মিয়া। এরই মধ্যে সুমিষ্ট ফল এসেছে বাগানে। জলিল মিয়ার আশা, এবার বাগান থেকেই ফল বিক্রি করে লাভবান হবেন। তাঁর আঙুর বাগান দেখে অনেকেই এর আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন।
এ ছাড়া ঝিনাইদহের আব্দুর রশিদ, রানা, যশোরের রুহুল আমিন, মনসুর, চুয়াডাঙ্গার মো.

সজল, মোকারম হোসেন, মাজেদুল, নুর কাদির, সাদ্দাম, নাটোরের আমজাদ হোসেন, নওগাঁর আবুল কালাম আজাদ, কুড়িগ্রামের রুহুল আমিন, ফরিদপুরের শেখ ফরিদ আঙুর চাষে সফলতা পেয়েছেন। প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান সয়েল চার্জার টেকনোলজিও আঙুর নিয়ে কাজ করছে।  

চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ
উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের পরিচালক তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, আমাদের পরিচিত মাটি, আলো, বৃষ্টিতেই চাষ হচ্ছে বিদেশি ফল আঙুর। বাণিজ্যিক আকারে চাষ হওয়া আঙুরের স্বাদ ও চেহারা প্রায় অবিকল সেই আমদানি করা আঙুরের মতো। আঙুর চাষে সঠিক পরিচর্যার গুরুত্ব অপরিসীম। কিছু বিষয় কঠোরভাবে মানতে হয়– নির্দিষ্ট সময়ে প্রুনিং ও ট্রেনিং, শুষ্ক মৌসুমে হালকা সেচ, বর্ষায় পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে স্প্রে, পুষ্টিতে ভার্মিকম্পোস্ট ও অনুখাদ্য ব্যবহার জরুরি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো থেকে আঙুরের নিজস্ব জাত এখনো উদ্ভাবন হয়নি। আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে ৯টি হর্টিকালচার সেন্টারে বিভিন্ন জাতের আঙুরের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় এসব জাতের চারা তৈরির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আঙুরের মতো লাভজনক ফসলের চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।   

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, সঠিক জাত নির্বাচন ও উদ্যোক্তাভিত্তিক চাষ ব্যবস্থাপনার ওপর। বাইকুনুর জাতের আঙুর চাষ একটি পরীক্ষিত সাফল্য। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সহায়তা ও কারিগরি পরামর্শ দিয়ে এসব চাষ সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে। তাঁর মতে, বাইকুনুর আঙুর শুধু একটি ফলই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষিতে এক সাহসী পদক্ষেপ। সরকারের প্রকল্প ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রম আরও জোরদার হলে আগামীতে বাইকুনুরসহ অন্যান্য জাতের আঙুর হতে পারে দেশের অর্থকরী রপ্তানিযোগ্য ফলের অন্যতম প্রতিনিধি। রঙে কালচে-বেগুনি, ফলনে ভারী, স্বাদে মিষ্ট বাইকুনুর জাতটি রাশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়। প্রতিটি ফলের গড় ওজন ১০–১২ গ্রাম, একটি থোকা ৭০০-৯০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি ৮০-৯০ দিনের মধ্যেই পরিপক্ব হয়। ফলে বর্ষাকাল শুরুর আগেই ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প পর ক ষ র র মত এ বছর উপজ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণেরা চান শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সংস্কার, ‘মব’ ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মব (সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) নিয়ে উদ্বিগ্ন তরুণেরা। তাঁরা চান সাধ্যের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা। সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকারে দেখতে চান।

তরুণদের এই মনোভাব উঠে এসেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও একশনএইডের একটি জরিপে। জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের ভাবনা–সম্পর্কিত এই জরিপ গতকাল সোমবার প্রকাশ করা হয়।

জরিপে তরুণদের কাছে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ‘নিচের আর্থসামাজিক অবস্থা জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে—আপনি কি একমত?’ জবাবে বারবার অগ্নিসংযোগ, দস্যুতা (ছিনতাই) ও চুরি নিয়ে উদ্বেগের ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছেন ৮০ শতাংশ তরুণ উত্তরদাতা। দ্বিমত পোষণ করেছেন ৮ শতাংশের কম। বাকিদের মতামত ছিল না।

‘মব’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রায় ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা। জনপরিসর নিরাপত্তাহীন (বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে)—এ বিষয়ে একমত ৬১ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা। বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন ১৬ শতাংশ। অন্যায্য ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন ৫৬ শতাংশ তরুণ। এ প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছেন ১৫ শতাংশ।

জরিপে তরুণদের কাছে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ‘নিচের আর্থসামাজিক অবস্থা জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে—আপনি কি একমত?’ জবাবে বারবার অগ্নিসংযোগ, দস্যুতা (ছিনতাই) ও চুরি নিয়ে উদ্বেগের ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছেন ৮০ শতাংশ তরুণ উত্তরদাতা। দ্বিমত পোষণ করেছেন ৮ শতাংশের কম। বাকিদের মতামত ছিল না।

জরিপে উঠে এসেছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর ৭৮ শতাংশ তরুণের ব্যক্তিগতভাবে সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা ছিল। সাধ্যের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যাশা ছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ তরুণের। ৬৭ শতাংশ তরুণের প্রত্যাশা সাধ্যের মধ্যে উন্নত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা। এরপর রয়েছে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করা। এই প্রত্যাশার কথা বলেছেন ৬৫ শতাংশের বেশি তরুণ। তরুণদের প্রত্যাশার মধ্যে শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, জনপরিসর ও অনলাইনে নিরাপত্তা, সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতি, ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ ইত্যাদিও রয়েছে।

দেশের আট বিভাগের ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার তরুণের (নারী ও পুরুষ) ওপর জরিপটি করা হয়েছে। গত ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত জরিপে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে গ্রাম ও শহরাঞ্চল থেকে উত্তরদাতা নেওয়া হয়েছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপে আমরা দেখেছি, তরুণেরা আইনশৃঙ্খলা ও মব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটা নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি।’

তরুণেরা কোন সংস্কার চান

জরিপে কর্মসংস্থান, অভিবাসন, রাজনীতি, নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের পারদর্শিতা, সংস্কার ইত্যাদি নানা বিষয়ে তরুণদের প্রশ্ন করা হয়।

জরিপে প্রশ্নের জবাবে ৫৬ শতাংশ তরুণ সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন মাত্রায় অবহিত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। ৪৪ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের এ বিষয়ে মোটেও ধারণা নেই। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ নিয়ে সংস্কারের কথা জানার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ৫০ শতাংশ বা তার বেশি তরুণ। বাকি ক্ষেত্রে হার ৫০ শতাংশের কম। শ্বেতপত্র কমিটি সম্পর্কে শুনেছেন সবচেয়ে কম, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ।

সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে কি না, এ প্রশ্নে অর্ধেকের কম তরুণ কমবেশি আশাবাদ দেখিয়েছেন। বাকিরা তেমন আশাবাদী নন অথবা নিশ্চিত নন। তরুণেরা কোন কোন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার চান, সেই প্রশ্নও করা হয়েছিল। উত্তরে সবচেয়ে বেশি জোর এসেছে শিক্ষা (৯৪ শতাংশ), স্বাস্থ্য (৯২ শতাংশ), শ্রমবাজার (৯০ শতাংশ), মানবাধিকার, অর্থাৎ নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (৮৯ শতাংশ), প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার (৮৫ শতাংশ) ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

অনুষ্ঠানে সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কারের একটি সুযোগ এখন এসেছে। এটা কাজে লাগাতে না পারলে বড় পরিবর্তন আনা যাবে না। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন হবে না।

জরিপে আমরা দেখেছি, তরুণেরা আইনশৃঙ্খলা ও মব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটা নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি।সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হানসরকার কেমন করছে

জরিপে ১৩টি বিষয় উল্লেখ করে সে ক্ষেত্রে সরকার কেমন করছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে, তিনটি ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি তরুণ সরকারকে সফল উল্লেখ করেছেন—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষা (৫৬ শতাংশ), সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা (৫৩ শতাংশ) ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা (৫১ শতাংশ)।

বেশি সংখ্যক তরুণ সরকারকে ব্যর্থ বলে উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ (৪০ শতাংশ), নারীর নিরাপত্তা (৩৯ শতাংশ), কর্মসংস্থান সৃষ্টি (৩৮ শতাংশ), স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ (৩৮ শতাংশ) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় (৩৫ শতাংশ)। উল্লেখ্য, সফলতা ও ব্যর্থতার প্রশ্নে বড় অংশের উত্তরদাতা কোনো মতামত দেননি।

৪০ শতাংশের কম উত্তরদাতা সরকারকে সফল বলেছেন, এমন খাতের মধ্যে আরও রয়েছে বিনিয়োগ পরিবেশ, আমলাতন্ত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

জরিপে প্রশ্নের জবাবে ৭৭ শতাংশ তরুণ বলেছেন, তাঁরা আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না, সেই প্রশ্নে আশাবাদের মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। ৪১ শতাংশ মোটামুটি, ২৮ শতাংশ অত্যন্ত ও ১২ শতাংশ পুরোপুরি আশাবাদী। ১৩ শতাংশ আংশিক আশাবাদী। ৬ শতাংশ মোটেও আশাবাদী নয়।

জরিপের তথ্যমতে, তরুণদের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজনীতির তথ্য পান। এরপর রয়েছে টেলিভিশন (৪৮ শতাংশ), বন্ধুবান্ধব (৩৭ শতাংশ), সংবাদপত্র (১৩ শতাংশ) এবং বাকিরা অন্যান্য মাধ্যম থেকে তথ্য পান।

কোন দল কত শতাংশ ভোট পাবে, সে সম্পর্কে ধারণা জানতে চাওয়া হয়েছিল তরুণদের কাছে। উত্তরদাতাদের মতে, আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি—৩৮ দশমিক ৭৬ ভোট বিএনপি পাবে। এরপর জামায়াতে ইসলামী ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পাবে। এ ছাড়া বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায় তাহলে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পাবে বলে ওই তরুণেরা মনে করেন। তাঁদের মতে, জামায়াতের বাইরে অন্য ইসলামিক দলগুলো ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট পেতে পারে। জাতীয় পার্টি পাবে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভোট।

সেলিম রায়হান বলেন, এখানে যে মতামত এসেছে, তা শুধু বাছাই করা ওই তরুণদের মতামত। এটাকে দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর বা অন্যান্য বয়সের মানুষের মতামত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। বিশেষ করে রাজনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে তা কখনোই করা সংগত হবে না।

জরিপের তথ্যমতে, তরুণদের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজনীতির তথ্য পান। এরপর রয়েছে টেলিভিশন (৪৮ শতাংশ), বন্ধুবান্ধব (৩৭ শতাংশ), সংবাদপত্র (১৩ শতাংশ) এবং বাকিরা অন্যান্য মাধ্যম থেকে তথ্য পান।

রাজনীতিতে যেসব তরুণ আসেন, তাঁরা সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার আশায় নাকি সত্যিকারের পরিবর্তন বা আদর্শ নিয়ে আসেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবিররাজনীতিতে আগ্রহ নেই

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা সহযোগী সাফা তাসনীম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভূঁঞা এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ কুদ্দুছ আলী সরকার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

জরিপে ৮৩ শতাংশ তরুণ বলেছেন, তাঁরা রাজনীতিতে যোগ দিতে আগ্রহী নন। এর বড় তিনটি কারণ হলো রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনীতিতে দুর্নীতি ও নৈতিকতার ঘাটতি এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা। পেশাজীবনে তরুণেরা সরকারি চাকরিতে বেশি আগ্রহী।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, রাজনীতিতে যেসব তরুণ আসেন, তাঁরা সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার আশায় নাকি সত্যিকারের পরিবর্তন বা আদর্শ নিয়ে আসেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব সব সময় তরুণেরাই দিয়েছেন, কিন্তু নীতিনির্ধারণে গিয়ে আর এই তরুণেরা থাকেন না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাত দফা আদায়ের মাধ্যমেই গণ-অভ্যুত্থানের সফলতা অর্জন সম্ভব 
  • তরুণেরা চান শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সংস্কার, ‘মব’ ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ
  • গণ–অভ্যুত্থান সফল না হলে হয়তো আমাদের অনেককে পরে শহীদ হতে হতো: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
  • ব্যাংক খাত সংস্কার: সফলতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর
  • ৭৩ বছরে রাবি: গবেষণা-উচ্চশিক্ষাসহ চাকরি ক্ষেত্রে গৌরবময় যাত্রা