কয়েক মাস ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। আন্দোলন ও দাবিদাওয়ার কারণে স্বাভাবিক শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। এ অবস্থায় আমাদের চিন্তা করা দরকার, প্রতিবাদ ও দাবি জানানোর প্রক্রিয়া কী হতে পারে। কিংবা কর্তৃপক্ষ ও সরকারের তরফ থেকেও কী ধরনের আচরণ আমরা আশা করতে পারি।

কিছু আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সবশেষ চব্বিশের জুলাই আন্দোলন এ ধরনের। এসব আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি আগে থেকে বোঝা সম্ভব হয় না। সেগুলো নিয়ে কথা বলা এই আলোচনার উদ্দেশ্যও নয়। কিন্তু যেসব আন্দোলন একেবারেই প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এবং দাবিগুলোও সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের—সেগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার।

রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা এমনিতেই যানজটের নগর। এর ওপর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধের কারণে অন্যান্য রাস্তা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। হাসপাতাল, অফিস-আদালত, দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম এর ফলে ভীষণভাবে ব্যাহত হয়।

আন্দোলনকারী পক্ষ হয়তো মনে করে, তাদের দাবির ব্যাপারটি দ্রুত সবার নজরে আনার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। মানতেই হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা চরম কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি হয়, এমন কর্মসূচিকে আমরা সাধুবাদ জানাতে পারি না।

দাবি জানানোর প্রক্রিয়া শুধু অবরোধ আর বিক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে সীমিত রাখা ঠিক নয়। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্ল্যাকার্ড হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েও অধিকারের কথা জানানো যায়। দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে কারণ ও যুক্তি দিয়েই। প্রয়োজনে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করা যেতে পারে। কিন্তু শুরুতেই আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলনকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এভাবে অধিকার আদায় কারও কাঙ্ক্ষিত নয়, এমনকি এ ধরনের আচরণ গণতান্ত্রিকও নয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোয় দুই ধরনের দাবি দেখা যাচ্ছে। কিছু দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, কিছু দাবি সরাসরি সরকারের কাছে। দুই ক্ষেত্রেই দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা দরকার। সংক্ষুব্ধ পক্ষ দাবি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অন্যদের মতও যাচাই করে নিতে পারে। অনলাইন জরিপের যুগে এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। বড় অংশ দাবির পক্ষে থাকলে তবেই সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা উচিত।

দাবি উপস্থাপনের ভাষা হবে লিখিত এবং সেখানে এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে, এটি কত ভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষা। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার জন্য বিদ্যমান অবস্থার বিবরণ দিতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কী করা যেতে পারে, সেই সুপারিশও থাকবে। প্রয়োজনে তারা প্রতিনিধিদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করব আমরা।

সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে কিছু নির্দেশনা জারি করা। সেই নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা থাকবে, লিখিত সব ধরনের দাবির কথাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সরকার মনোযোগ দিয়ে দেখবে এবং বিবেচনা করবে। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিকতার সঙ্গে নজর দেওয়ার জন্য বলতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবাদের ভাষা জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত হতে দেখা যায়। সংক্ষুব্ধ অংশ দলবদ্ধ হয়ে কিংবা বড় জমায়েত নিয়ে প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাবি আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগানো হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের ‘টনক নড়েনি’ এই অজুহাতে ঘেরাও বা অবরোধজাতীয় কর্মসূচি দেওয়া হয়। প্রতিবাদের ভাষা এমন হতে পারে না। এভাবে যে আলোচনা হয় না, সেটা নিশ্চয় আন্দোলনকারী পক্ষও বোঝে।

বিপরীত দিকে দেখা যায়, অবস্থা চরম আকার ধারণ করলেই যেন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। যে সমস্যার সমাধান হয়তো আগেই ডেকে কথা বলে করে ফেলা সম্ভব ছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। পরে বড় জমায়েতের সামনে যখন কথা বলতে দাঁড়ায়, তখন ধাক্কাধাক্কি ও বিতণ্ডা ছাড়া কিছু হয় না। এর সূত্র ধরে সড়ক অবরোধ করে টানা আন্দোলন কিংবা আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার নতুন কর্মসূচি দেয় সংক্ষুব্ধ পক্ষ। এ পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে বর্তমানে নতুন কৌশল অনুসরণ করার বিকল্প নেই। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে সমাধান করতে চাইলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে কিছু নির্দেশনা জারি করা। সেই নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা থাকবে, লিখিত সব ধরনের দাবির কথাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সরকার মনোযোগ দিয়ে দেখবে এবং বিবেচনা করবে। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিকতার সঙ্গে নজর দেওয়ার জন্য বলতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত কমিটি গঠন করে দিয়ে দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করা। ক্ষেত্রবিশেষে সংক্ষুব্ধ অংশের প্রতিনিধিও এই কমিটিতে থাকতে পারে। কমিটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন পেশ করবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনটি দেখে সেটি প্রকাশ করতে পারে কিংবা সেটি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে।

যেসব দাবিদাওয়া সরাসরি সরকারের কাছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা যাচাই করার জন্যও উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, কমিটিতে সুবিধাভোগী বা অগ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি যেন না থাকেন। কমিটির পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো কিছু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিলে একই সঙ্গে সেটির সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোন সময়ে কতটুকু কাজ করা হবে, তারও একটি বিবরণ থাকতে পারে। তাতে সংক্ষুব্ধ অংশও আশ্বস্ত হবে।

যাঁরা দাবির পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদেরও খেয়াল রাখা দরকার, সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে কোনো পক্ষ কাজ করছে কি না। তাঁদের এটাও খেয়াল রাখা দরকার, তাঁদের দাবি অন্য কোনো পক্ষের স্বার্থের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কি না। তবে দাবি মানে এই নয়, সেটি এক বা একাধিক পক্ষের অধিকার। দাবি উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রের বৃহত্তর পটভূমি এবং সামগ্রিক অবস্থাও বিবেচনায় রাখা উচিত।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য অবস থ দরক র অবর ধ ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

বিলাসবহুল প্রমোদতরিতে খুন, এরপর...

গল্প যখন জাহাজের রহস্যময় খুন, তখন সবার আগে মাথায় আসে ১৯৭৮ সালের ‘ডেথ অন দ্য নাইল’-এর কথা। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য লাস্ট অব শিলা’ সিনেমাটিও এগিয়ে থাকবে এদিক দিয়ে।
তবে রুথ ওয়ারের উপন্যাসভক্তদের জন্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি হতে পারত এমনই এক অভিজ্ঞতা। রুথের উপন্যাস ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেটফ্লিক্সে এসেছে একই নামের নতুন সিনেমা। তবে সাইমন স্টোন পরিচালিত সিনেমাটির শুরুটা আশা জাগানিয়া হলেও শেষপর্যন্ত রোমাঞ্চ ধরে রাখতে পারেনি।

একনজরে সিনেমা: ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স ধরন: ড্রামা, ক্রাইম থ্রিলার রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট পরিচালক: সাইমন স্টোন অভিনয় : কিরা নাইটলি, গাই পিয়ার্স, ডেভিড আজালা, গিটে উইট, আর্ট মালিক, হান্নাহ ওয়াডিংহাম, কায়া স্কোডেলারিও

লন্ডনের এক খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরা ব্ল্যাকলক (কিরা নাইটলি)। তিনি একটি হাইপ্রোফাইল অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর সোর্সকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য তিনি কাজে ফিরে এসেও ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎই তিন দিনের সমুদ্রযাত্রার আমন্ত্রণ পান। নরওয়েজীয় এক বিলিয়নিয়ার দম্পতি অ্যান লিংস্টাড (লিসা লোভেন কংসলি) ও তাঁর স্বামী রিচার্ডের (গাই পিয়ার্স) দাতব্য সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কাজ ও ছুটি কাটানোর এমন দারুণ সুযোগ লুফে নেন লরা।

‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ –এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

সম্পর্কিত নিবন্ধ