‘এই লও তোমার বিপাশা,’ ছয় দিন বয়সী নবজাতককে কোলে দিতে দিতে বললেন ফুফুশাশুড়ি। দিনটা ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। যেকোনো বাবার জন্যই প্রথম সন্তান কোলে নেওয়ার মুহূর্তটা আবেগের, আবুল হায়াতের জন্য মুহূর্তটা আরেকটু বিশেষ। কারণ, একাত্তরের সেই উত্তাল দিনে তিনি হাসপাতালে, কোমা থেকে সবে ফিরেছেন! জীবনে আবার এমন প্রবল অসুস্থতায় পড়েছেন পাঁচ দশক পর, ২০২১ সালে, যখন তাঁর কর্কট রোগ ধরা পড়ে। তবে এবারও স্ত্রী, পরিবার আর চিকিৎসকদের প্রেরণায় প্রবল মানসিক শক্তির জোরে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ১৮ মে সকালে আমরা যখন আবুল হায়াতের বাসায় তাঁর মুখোমুখি হলাম, তখন তাঁকে দেখে কে বলবে বয়স ৮০ পেরিয়েছে! দিব্যি চনমনে, আগের দিনই চট্টগ্রাম থেকে শুটিং করে ফিরেছেন। তবু ক্লান্তির ছাপ নেই। এক দিন বিরতি দিয়ে মাসের ১৫-১৬ দিন কাজ করেন, টানা শিডিউল। এই বয়সেও এত শারীরিক ও মানসিক শক্তির উৎস কী? চায়ে চুমুক দিয়ে হাসলেন। টি–শার্ট আর ট্রাউজার পরা আবুল হায়াত আরাম করে বসলেন। খুলে দিলেন গল্পের ঝাঁপি। সেই ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে, পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম হয়ে গল্প চলল আজকের ঢাকা পর্যন্ত।

এলাম নতুন দেশে

মুনিষের (কুলি) কাঁধে চড়ে স্টেশনে আসা, রেলের কালো ইঞ্জিনের বিকট হুইসেল আর গোয়ালন্দ ঘাটে স্টিমার—এই তিনটা জিনিস মনে আছে। বয়স তখন মোটে তিন। দেশ ছেড়ে নতুন দেশে আসার গল্প এটা। ১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম। বাবা এম এ সালাম ছিলেন রেলের চাকুরে। বদলি হলেন চট্টগ্রামে। পরিবার আর ভিটেমাটি ছেড়ে কেই–বা আসতে চায়। তবে চট্টগ্রামে গেলে রেলের কোয়ার্টার মিলবে। বাবা বলেছিলেন, ‘ভালো না লাগলে ফিরে আসব।’

তিন বছরের আবুল হায়াত তখন জানতেন না, আর ফেরা হবে না। নতুন সেই দেশই হয়ে যাবে তাঁর জীবনের ঠিকানা। পাহাড় ঘেরা পাড়া আর অনেক অনেক বন্ধু নিয়ে শুরু হবে নতুন জীবন।

আবুল হায়াতের তারকা পরিবার.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

পরিবারের মামলা নেয়নি পুলিশ, অপরাধীদের আড়াল করার অভিযোগ

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় চোর সন্দেহে পিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে মামলার বাদী গ্রাম পুলিশের এক সদস্য ও আসামি অজ্ঞাতনামা। নিহত যুবকের পরিবারের অভিযোগ, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে পুলিশ। এ জন্য হত্যা মামলায় পরিবারের কাউকে বাদী করা হয়নি।

নিহত রিপন মিয়া (৪০) উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের রেহাই পলাশতলা এলাকার মোজাম্মেল হকের ছেলে। তিনি পেশায় ট্রাকচালক ছিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে চোর সন্দেহে গাছের সঙ্গে বেঁধে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে ওই ইউনিয়নের রেহাই পলাশতলা এলাকা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় ৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় গ্রাম পুলিশের সদস্য খোকন রবিদাস বাদী হয়ে মেলান্দহ থানায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন। এ দিকে ৯ সেপ্টেম্বর নিহত ব্যক্তির বাবা মোজাম্মেল হক আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন। মামলার আরজিতে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ সাত থেকে আটজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

মামলার বাদী গ্রাম পুলিশ শ্রী খোকন রবিদাস বলেন, ‘স্থানীয় মেম্বারের মাধ্যমে খবর পাই, একজনকে গণধোলাই দিয়ে মাইরে ফালাইয়্যা রাখছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলাম। পরে পুলিশ লাশ নিয়ে গেল। এ সময় তদন্ত ওসি স্যার আমাকে থানায় যেতে বলেন। আমি থানায় যাওয়ার পর ওসি স্যার আমাকে মামলার বাদী হতে বলেন।’ খোকন রবিদাস জানান, তিনি পুলিশকে নিহত যুবকের পরিবারের সদস্যদের বাদী করার কথা বলেছিলেন। তবে ওসি তখন বলেছিলেন, ‘আচ্ছা অভিযোগ বানিয়ে দিলাম, তোমার কোনো সমস্যা নাই।’ মামলার এজাহারে কী লেখা আছে, এমন প্রশ্নে রবিদাস বলেন, ‘এজাহারের বিষয়টি আমি সঠিকভাবে বলতে পারি না। মামলার এজাহার লেখা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’

এই বিষয়ে মেলান্দহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) স্নেহাশীষ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাদী স্থানীয় গ্রাম পুলিশ। তাঁকে তো বাই–ফোর্স করে বাদী করার সুযোগ নেই। বাদীর কথাগুলো সত্য নয়। আর নিহত ব্যক্তির পরিবার যে বলছে তাঁদের আদালতে মামলা করতে পরামর্শ দিয়েছি—এই বিষয়ও সত্য নয়। ওই সময় নিহত ব্যক্তির পরিবার নাম উল্লেখ করে মামলা করতে চেয়েছিল। যেহেতু বিষয়টি একটা গণপিটুনি ছিল। ফলে অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মামলা হয়েছে।’

খোকন রবিদাসের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রিপন মিয়া ওই এলাকার বোরহান উদ্দিনের বাড়িতে গরু চুরি করতে ঢোকেন। এ সময় বাড়ির লোকজন রিপন মিয়াকে দেখতে পেয়ে ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকেন। এতে এলাকার ২০০ থেকে ২৫০ জন লোক ওই বাড়িতে গিয়ে রিপনকে এলোপাতাড়ি কিল–ঘুষি, লাথি ও লাঠি দিয়ে পিটান। পরে এই পিটুনিতে তিনি মারা যান।

এদিকে মোজাম্মেল হকের আরজিতে উল্লেখ হয়েছে, একই এলাকার মো. মাওলানা তিন বছর ধরে সৌদি আরবে থাকার সময় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রিপন মিয়ার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। মাওলানা বিষয়টি জানতে পেরে দেশে চলে আসেন। ওই বিষয়ে রিপনের সঙ্গে মাওলানার তর্কাতর্কি হয়। এর পর থেকে মাওলানা রিপনকে মারধর ও হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। ৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে রিপন একই এলাকার নুর ইসলামের বাড়িতে যান। পরে দিবাগত রাত একটার দিকে রিপন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। রাস্তার মধ্যে মাওলানা ও তাঁর লোকজন রিপনকে টানাহেঁচড়া করে বাড়িতে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে ব্যাপক মারধর করেন। এ সময় রিপন ডাক-চিৎকার করতে চাইলে তাঁরা (মাওলানা) চোর ধরেছে বলে চিৎকার শুরু করেন। এ সময় আরও লোকজন গিয়ে রিপনকে পিটিয়ে হত্যা করেন।

মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে যখন শুনছি, আমার ছেলেকে মাইরে ফেলছে। তখন আমি থানায় গিয়েছি। তখন পুলিশ বলে, “আপনারা বসেন, আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ নিয়ে আসি।” পরে সেখান থেকেই লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তাঁরা থানায় এসে আমাকে বলে, “আপনারা আগে মর্গে যান।” আমি মর্গে চলে যাই। সেখান থেকে আবারও থানায় যাই। তখন পুলিশ আমার মামলা নেয়নি। তখন পুলিশ আমাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়। পরে শুনি থানায় মামলা হয়েছে। দুই দিন পর মামলার কপি পাই। তখন দেখি, মামলার বাদী একজন গ্রাম পুলিশ। পরে আমি আদালতে মামলা করছি।’ মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, প্রকৃত আসামিদের আড়াল করতেই পুলিশ এই কাজ করেছে।

মোজাম্মেল হকের আইনজীবী মো. তাজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ ৭ থেকে ৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করা হয়। পরদিন বিচারক অভিযোগ আমলে নিয়ে মেলান্দহ থানাকে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছেন।

মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা আসামি হলেও ইতিমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম আমরা পেয়েছি। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে। নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা যে অভিযোগ করেছেন, কাউকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। বিষয়টি সেই রকম নয়। এই ঘটনার সঙ্গে যাঁরাই জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় অবশ্যই আনা হবে।’

থানায় করা মামলায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে বাদী না করার বিষয়ে ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির পরিবারকে বাদী না করার বিষয়টি ঠিক হয়নি, এটি আমি বলব না। বাদী বা তথ্যদাতা যে কেউ বাদী হতে পারেন। বাদী যে–ই হোক না কেন, অপরাধীদের পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ