ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যে মাওবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, তা কার্যত এক রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের করিগাট্টা পাহাড়ি জঙ্গলে মোতায়েন করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি সেনা। হেলিকপ্টারসহ তল্লাশি চলছে গভীর বনাঞ্চলে। ‘অপারেশন জিরো’ বা ‘অপারেশন কাগার’ নামে পরিচিত এই অভিযানকে মাওবাদী দমনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এ অভিযান সরাসরি পরিচালনা করছে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। তারা ছত্তিশগড়ের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র—উভয় স্তরেই ক্ষমতায় রয়েছে। এ বছরের শুরু থেকেই সরকার মাওবাদীদের ওপর দমন–পীড়ন জোরদার করেছে। নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০১ জন বিদ্রোহী। নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই আদিবাসী। শুধু গত বুধবারেই মারা গেছেন ২৭ জন, যাঁদের মধ্যে মাওবাদী সংগঠনের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক নম্বালা কেশবা রাও রয়েছেন।

তবে মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী দলগুলো এই অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, ‘মাওবাদী’ আখ্যায় অনেক নিরীহ আদিবাসীকেও হত্যা করা হচ্ছে। তারা সরকারের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।

সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মাওবাদী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ, যাঁদের মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। এর মধ্যে নিহত বিদ্রোহীর সংখ্যা অন্তত ৬ হাজার ১৬০ জন।

মাওবাদীরা কারা, কী চায় তারা

ভারতে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে কৃষকদের এক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এই ‘নকশাল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল প্রমুখ। তাঁদের দাবি ছিল—ভূমিহীন কৃষকদের জমি দিতে হবে এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই আন্দোলন থেকেই জন্ম নেয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী), যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে বিশ্বাস করত। চীনা নেতা মাও সে–তুংয়ের বিপ্লবী দর্শন ছিল তাদের মূল অনুপ্রেরণা। তবে সময়ের সঙ্গে এই দল ভেঙে যায় বহু অংশে। মূল সিপিআই (এমএল) এখন একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়।

যারা কয়েক যুগ ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের উন্নয়ননীতি, ভূমি অধিগ্রহণ ও আদিবাসী শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান কি স্থায়ী শান্তি আনবে?

অন্যদিকে ২০০৪ সালে দুটি বড় সশস্ত্র সংগঠন—পিপলস সেন্টার ও মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার এক হয়ে তৈরি করে বর্তমানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিদ্রোহী সংগঠন—সিপিআই (মাওয়িস্ট)। ভারত রাষ্ট্র এই দলকে বর্তমানে ভারতের ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে মনে করে।

বহু বছর ধরে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রে এদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। একসময় প্রায় ১২৬টি জেলায় সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে তাদের উপস্থিতি ৩৮টি জেলায় সীমিত হয়েছে।

বস্তার সংঘাত: মাওবাদ বনাম খনিজ লোভের রাজনীতি

২০০০ সালে পৃথক রাজ্য হিসেবে ছত্তিশগড় গঠনের পর থেকেই বস্তারে সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। সালওয়া জুদুম নামের বিতর্কিত রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর মাধ্যমে শুরু হয় আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের অভিযান। আদিবাসীদের অভিযোগ, খনিজসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে সেনা ক্যাম্প বসিয়ে সরকার আসলে করপোরেট খনন কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করছে।

দেশের ১৯ শতাংশ লৌহ আকরিক মজুত রয়েছে ছত্তিশগড়ে, যার অধিকাংশই বস্তারে। আদিবাসী নেতা মনীষ কুঞ্জম বলছেন, ২০০৫ সালে টাটা ও এসার কোম্পানি খনিজ উত্তোলনের চেষ্টা শুরু করলে অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়। তবে প্রবল প্রতিরোধের মুখে কোম্পানিগুলো পিছিয়ে যায়। আইনে বলা আছে, গ্রাম পরিষদের সম্মতি ছাড়া খননকাজ শুরু করা যায় না। যাঁরা প্রতিবাদ করেন, তাঁদের মাওবাদী বা তাঁদের সমর্থক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বস্তারে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৮০ শতাংশ।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—বস্তারে সংঘাত কি আদৌ মাওবাদ দমনের লড়াই, নাকি তা আদিবাসীদের মাটি ও অধিকার বাঁচানোর এক মরিয়া প্রতিরোধ, যার মুখে লেবেল সেঁটে দেওয়া হচ্ছে ‘নকশাল’?

বিজেপির আগ্রাসী রণকৌশল

ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকার থাকাকালীন (২০২০-২০২৩) ১৪১ জন বিদ্রোহী নিহত হন। কিন্তু বিজেপি সরকার আসার পর ২০২৪ সালেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৩ জনে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেব সাই বলছেন, ‘এখন চূড়ান্ত পর্ব চলছে, আমরা দ্রুত নকশালমুক্ত ভারতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও এই অভিযান ঘিরে নিয়মিত মাঠে যাচ্ছেন, সেনা শিবিরে রাত কাটাচ্ছেন। তাঁর ঘোষণা—২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতকে ‘নকশালমুক্ত’ করে তোলা হবে।

বর্তমানে শুধু বস্তার অঞ্চলেই রয়েছে সরকারের ৩২০টি নিরাপত্তা শিবির। শিবিরগুলোতে সব মিলিয়ে আছে প্রায় ৩০ লাখ নিরাপত্তাকর্মী। গোটা ছত্তিশগড়ে মোতায়েন রয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি নিরাপত্তাকর্মী। ড্রোন, থার্মাল ইমেজিং, উপগ্রহ-নিরীক্ষণসহ নানা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি চলছে ঘন জঙ্গলে।

অভিযোগ: আদিবাসীদের ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা

তবে এ অভিযান নিয়ে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। ‘পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ’-এর মতে, গত দেড় বছরে অন্তত ১১টি ভুয়া এনকাউন্টারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন মার্চে বিজাপুর জেলার বর্ডগা গ্রামে তিনজন বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যার দাবি করে পুলিশ। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বলেন, ওই তিনজনকে রাতে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে গুলি করে ‘মাওবাদী’ তকমা দেওয়া হয়।

২০১২ সালে সাড়েকে গুডা গ্রামে ১৭ আদিবাসী এবং ২০১৩ সালে ৮ জন আদিবাসী নিহত হন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। পরবর্তী তদন্তে উচ্চ আদালতের বিচারকেরা জানান, নিহত সবাই নিরপরাধ ছিলেন। অথচ আজও কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

মাওবাদীদের সক্ষমতা কি কমে আসছে

২০১১ সালে ছত্তিশগড়ের তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক বিশ্বরঞ্জন অনুমান করেছিলেন যে বস্তার অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র মাওবাদী এবং ৪০ হাজার জন মিলিশিয়া সদস্য সক্রিয় ছিল। যদিও এই সংখ্যাগুলো নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। সেই সময় মাওবাদীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ভয়াবহ হামলা চালাতে সক্ষম ছিল। ২০১০ সালে তারা ছত্তিশগড়ের এক বনাঞ্চলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৭৬ জন আধাসামরিক সদস্যকে হত্যা করে। তিন বছর পর আরেকটি হামলায় বহু মানুষ নিহত হন, যাঁদের মধ্যে কংগ্রেস নেতাও ছিলেন।

বর্তমানে বস্তারের আইজিপি সুন্দররাজ পি জানাচ্ছেন, এখন প্রায় এক হাজার সশস্ত্র মাওবাদী এবং তাদের সঙ্গে জড়িত আরও ১৫ হাজার ব্যক্তি সক্রিয় আছেন।

মাওবাদীদের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে তাদের সদস্য সংগ্রহ কমে গেছে। ইউনিটগুলো ছোট হয়ে গেছে এবং গোলাবারুদের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। একসময় যে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোতে ৪০ জন সদস্য ছিল, এখন তার মধ্যে কেবল ১৮ জন মুক্ত আছেন। বাকি সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন বা নিহত।

ছত্তিশগড়ে মাওবাদীরা দুর্বল হয়ে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা পাশের রাজ্য মধ্যপ্রদেশে আবার প্রভাব বিস্তার করছে। মাওবাদ হচ্ছে একটি আদর্শ—একে কেবল শক্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। যত দিন না অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ গড়া যায়, তত দিন এই আদর্শ নতুনরূপে ফিরে আসতে পারে।

সাবেক মাওবাদীদের নিয়োগ: সরকারের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’?

বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও দমন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘মূলবাসি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের একটি আদিবাসী সংগঠনকে গত বছর নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘উন্নয়নবিরোধিতা’ ও ‘সেনাবিরোধিতা’র অভিযোগে। এর সদস্য বহু তরুণ এখন কারাবন্দী।

সরকার ২০০৮ সাল থেকে সাবেক মাওবাদীদের জেলা রিজার্ভ গার্ডে (ডিআরসি) নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল—এদের স্থানীয় বন ও ভূগোল ভালোভাবে চেনা। তারা মাওবাদীদের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের শঙ্কা, এই প্রক্রিয়া আদিবাসী সমাজে বিভাজন তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতে সহিংসতা আরও বাড়াতে পারে।

শান্তি না গভীরতর সংকট

সরকার বলছে, তারা ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মাওবাদীদের দমন করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু যারা কয়েক যুগ ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের উন্নয়ননীতি, ভূমি অধিগ্রহণ ও আদিবাসী শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান কি স্থায়ী শান্তি আনবে? নাকি আরও ভীত, বিচ্ছিন্ন ও নিপীড়িত হবে ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী?

এই প্রশ্নই এখন বস্তারের গভীর বন থেকে দিল্লির উচ্চপদস্থ মহলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

অলোক পুতুল সাংবাদিক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র সশস ত র ত হয় ছ নকশ ল সদস য স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে: বিএনপি

গত সাড়ে ৯ মাসে জনপ্রত্যাশা বা গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ হয়েছে তা বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন বলে মনে করে বিএনপি। দলটির মতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। অথচ আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এই ঐক্য বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে বিএনপির পক্ষ থেকে এসব কথা তুলে ধরা হয় । প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শনিবার রাতে যমুনায় বৈঠক করেন বিএনপির চার নেতা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আবদুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ বৈঠকে যোগ দেন।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর অগণতান্ত্রিক বর্বরতম ফ্যসিবাদবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪–এর জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ফ্যসিবাদমুক্ত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা এবং জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা, বৈষম্যহীন ও সামাজিক ন্যায় বিচার ভিত্তিক একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ আপনার নেতৃত্বে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে।

বিএনপি বলেছে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের পতন হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান; কিন্তু গত সাড়ে ৯ মাসে জনপ্রত্যাশা বা গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু এর মধ্যে পূরণ হয়েছে তা একটি বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। অথচ আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এই ঐক্যকে বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখার কথা। কোনো মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ না হয়, সেদিকে সচেতন থাকা উচিত ছিল। এই বক্তব্য বারবার উচ্চারণ করা হয়েছে। অথচ সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে জনমনে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

মানবিক করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে উদ্বেগ উঠে এসেছে লিখিত বক্তব্যে। এতে বলা হয়, মানবিক করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে জাতীয় স্বার্থে রক্ষিত হচ্ছে কি না, সেটা সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। এ ছাড়াও এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকারের আছে বলে এ দেশের জনগণ মনে করে না।

লিখিত বক্তব্যে বিএনপি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা, যাঁদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার। দেশের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে যাতে দেশে অস্থিতিশীল কোনো পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত কেবল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কর্তৃক জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়াই ভালো।

নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত উপদেষ্টাদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। লিখিত বক্তব্যে এ বিষয়ে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বোঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাঁদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইতিমধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাঁকে অব্যাহতি দিতে হবে।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘সংস্কার সনদ’ তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যেই আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও একই বিষয়গুলো নিয়ে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে একটি দলের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি বিএনপি ও সরকারকে বিব্রত করে।

সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও একটি মহল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন চায় বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সব ক্ষেত্রে বিএনপির মতামত না নিলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে এই কমিশন গঠন করেছে; কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র-সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন করায় নির্বাচন কমিশনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। সরকার শিগগিরই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করানোর ব্যবস্থা নেবে এমনটা আশা করে বিএনপি। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পক্ষপাতমূলক আচরণ সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে।

আরও পড়ুনপ্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বকে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো১ ঘণ্টা আগে

বিএনপির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জুলাই-ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাশিগগির সম্ভব জন–আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জন–আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

জন–আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকারের যা করণীয়, তা যথাসময়ে না করে চাপের মুখে করার সংস্কৃতি ইতিমধ্যেই সরকারের সক্ষমতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়। এই অনভিপ্রেত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় পুরোটাই সরকারের বলে বিএনপি মনে করে। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচনপ্রক্রিয়া দুটোই একই সঙ্গে চলতে পারে। পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ব্যক্তির অর্থাৎ দল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারপ্রক্রিয়া চলমান থাকবে।

আরও পড়ুননির্বাচন ও সংস্কারের ‘রোডম্যাপ’ দরকার: যমুনা থেকে বেরিয়ে জামায়াতের আমির৪ ঘণ্টা আগে

বিএনপির লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়েছে, ‘আমরা যে বিষয়গুলো এই পত্রে উল্লেখ করেছি, সেগুলো আমাদের আগের প্রস্তাব ও পরামর্শের মত উপেক্ষিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং অনিবার্যভাবেই তা আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে পরামর্শ দিতে নিরুৎসাহিত করবে।’

দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের মধ্যে রাখতে, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে—বিএনপির পক্ষ থেকে এমন প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে, লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরা হয়।

আরও পড়ুনছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ করতে বলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক: নাহিদ১ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ