চলতি বছর স্বাভাবিক সময়ের এক সপ্তাহ আগেই মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর ধীরে ধীরে সারা দেশসহ পুরো উপমহাদেশজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করবে। ১৬ বছর পর এবার এত আগে দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে।

দেশে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে আসা নিয়ে আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ুবিদদের মধ্যে ভাবনা বাড়ছে।‌ বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে আগমন এবং দেরিতে চলে যাওয়া বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিশেষ করে কৃষি এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।

তবে এবার আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, আজ শনিবার বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে। আজই ভারতের কেরালা উপকূলেও মৌসুমি বায়ুর আগমনের খবর পাওয়া গেছে। সাধারণত মৌসুমি বায়ু ভারতের কেরালা উপকূল স্পর্শ করলে প্রায় একই সময় বাংলাদেশের উপকূলেও তা এসে পড়ে।

এভাবে এত আগে মৌসুমি বায়ুর আগমনের ঘটনা ঘটল ১৬ বছর পর। এর আগে ২০০৯ সালে প্রায় একই দিনে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশের উপকূলে।

আবহাওয়াবিদ এবং জলবায়ুবিষয়ক গবেষকদের ভাষ্য, একাধিক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বায়ুর প্রবেশ এবার আগাম হলো। পরিবেশ, জলবায়ু, কৃষি এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে।

মৌসুমি বায়ু কী

দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বায়ুপ্রবাহ হলো মৌসুমি বায়ু। এটা মূলত গ্রীষ্মকালের মৌসুমি বায়ু। এই গরমকালে প্রবল উষ্ণতায় স্থলভাগে বিশেষ করে ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় তাপীয় লঘুচাপের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাবে স্থলভাগের কাছের সমুদ্র অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্প নিয়ে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে।

বাংলাদেশে জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৌসুমি বায়ুর প্রভাব থাকে। দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয় এ সময়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলছিলেন, এই গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। এতে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থলভাগ উত্তপ্ত হয়। আর এই উত্তাপের কারণে সেখানকার বায়ুও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ জন্য ওই সময় তাপীয় লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলভাগ সেই সময় অপেক্ষাকৃত কম গরম থাকে। তাই সেখানে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপযুক্ত জলভাগ এলাকা থেকে বায়ু এশিয়ার স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। এটি মৌসুমি বায়ু।

মৌসুমি বায়ু আগাম আসার কারণ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো.

বজলুর রশিদ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের বৃষ্টি এবং গ্রীষ্মকালের জলবায়ু পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে আজ মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করেছে। ভারতের কেরালাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় স্পর্শ করেছে মৌসুমি বায়ু।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত ১ জুন বাংলাদেশের টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটে।‌ মাঝেমধ্যে দু–এক দিনের হেরফের হয়। তবে এক দশক ধরে মৌসুমি বায়ু জুনের প্রথম সপ্তাহ এমনকি কখনো কখনো জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে আসছে। মৌসুমি বায়ু যত দিন পর্যন্ত থাকার কথা, তারপরও প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে।‌ জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাবেই এমনটা করছে বলে মনে করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

মৌসুমি বায়ুর আগাম আসার কারণ তাহলে কী? কারণ হিসেবে দুটো শর্তের কথা জানালেন সমরেন্দ্র কর্মকার। প্রথম বিষয়টি হলো ‘ম্যাসকারিন হাই প্রেসার’–এর প্রাবল্য। মাদাগাস্কারের কাছে ভূপৃষ্ঠে যে উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়, সেটিই ম্যাসকারিন হাই প্রেসার নামে পরিচিত। এটি যদি খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে কখনো কখনো মৌসুমি বায়ু আগাম চলে আসতে পারে। এই বায়ুপ্রবাহ সোমালিয়ার উপকূল হয়ে উপমহাদেশের দিকে আসে।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলছিলেন, ভারতের মধ্যপ্রদেশ বা এর কাছাকাছি এলাকার তাপীয় লঘুচাপেরও ভূমিকা থাকতে পারে। ভারতের মধ্যপ্রদেশ বা এর কাছাকাছি এলাকায় যে তাপীয় লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, তার শক্তিশালী অবস্থান এর কারণেও কখনো কখনো মৌসুমি বায়ু আগাম চলে আসতে পারে।

মৌসুমি বায়ু মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসে। এর বৈশিষ্ট্য হলো এখানে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে।

মোহাম্মদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘আর্দ্রতার পরিমাণ ৯০ শতাংশের বেশি হয় কখনো কখনো। আর এ বায়ু প্রবাহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত। তিন থেকে পাঁচ মিলিমিটার বৃষ্টি ধারাবাহিকভাবে যদি হতে থাকে তবেই মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।’

আবহাওয়াবিদদের কথা, যদি মৌসুমি বায়ুর আসার স্বাভাবিক সময়ের আগে আরব সাগর বা বঙ্গোপসাগরে কোনো লঘুচাপ বা নিম্নচাপ কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় তবে এর আগমন আগাম ঘটে যেতে পারে। আরব সাগরে এখন একটি নিম্নচাপ রয়েছে। বাংলাদেশে আগামী মঙ্গলবার থেকে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। আবার এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

সমরেন্দ্র কর্মকারের ভাষ্য, আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে এই যে লঘুচাপ এবং নিম্নচাপ পরিস্থিতি, তা মৌসুমি বায়ুর আগাম আগমনে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা যায়।

আগাম আগমনের প্রভাব কী হতে পারে

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মৌসুমি বায়ু একটু আগে চলে আসা মানে যে বৃষ্টি বাড়বে, এমনটা নয়। এর প্রভাবে হয়তো আগামী দু–এক দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এরপর আছে মৌসুমি লঘুচাপ। তার প্রভাবেও কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর পর থেকে টানা কয়েক দিন দেশ প্রায় বৃষ্টিহীন থাকতে পারে।

স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর নতুন করে প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ২০০০ সালে। তবে বিশেষ করে ২০১৯ সাল থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রভাব ব্যাপক মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে দেশে যত মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা এর আগে কখনোই হয়নি। ওই বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এডিস মশার বিস্তার শুরু হয় সাধারণত জুন মাসে। থেমে থেমে বৃষ্টি, অত্যধিক আর্দ্রতা ইত্যাদি ডেঙ্গুর রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশার বিস্তারে ভূমিকা রাখে। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যগত অন্যান্য বিষয় অবশ্যই বিচার্য। কিন্তু বৃষ্টি এবং তাপের বড় সম্পর্ক আছে এডিসের বিস্তারে।

বৃষ্টি হলে বাসাবাড়ি বা আশপাশে নানা খোলা স্থানে পানি জমে যায়। আবার বৃষ্টি বন্ধ হয়ে অত্যধিক তাপ হলে ওই পানিতে জমে থাকা এডিসের ডিমগুলো দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, এবার ডেঙ্গুর রোগবাহী এডিস মশার বিস্তার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে মৌসুমি বায়ু যদি আরও এগিয়ে আসে, তবে মশার বিস্তার আরও দ্রুত ঘটতে পারে। কারণ বিস্তার রোধে যে সামগ্রিক তৎপরতা তার যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

চলতি বছরে এপ্রিল মাসে তেমন তাপপ্রবাহ হয়নি। থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। মে মাসের শুরুতে তাপপ্রবাহ দেখা দিলেও শেষ দিকে এসে বৃষ্টি বেড়েছে। তবে বৃষ্টি বাড়লেও তাপমাত্রা কিন্তু খুব বেশি কমেনি। এ পরিবেশকে এডিসের জন্য খুবই সহায়ক বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন।

কৃষির ওপর প্রভাব

বোরো ধানের উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতির, মানুষের জীবনযাত্রার ওপর একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে আছে। এরই মধ্যে হাওরের ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। দেশের অন্যত্র ধান কাটা প্রায় অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টি এলে ধানের জন্য খুব ক্ষতি হবে না বলেই মনে করেন কৃষিগবেষক মৃত্যুঞ্জয় রায়। তাঁর মতে, মৌসুমি বায়ুর আগেভাগে চলে আসা কিছু সবজির ক্ষেত্রে ভালো হয়েছে। আবার এখন গাছে যে দেরিতে ফলন হওয়া বা নাবি জাতের আম আছে তার জন্য ভালো হতে পারে।

দেশি নাবি জাতের আমের মধ্যে আছে আম্রপালি, ফজলি, বারি-৪, আশ্বিনী। বাংলাদেশের মোট যে আম উৎপাদন হয় তার ৪০ শতাংশ এখন আম্রপালি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক এ কে এম মনজুরের মাওলা প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘নাবি জাতের আমগুলোর এখন বৃদ্ধির সময়। এখনকার বৃষ্টিতে এর আকার যেমন বড় হবে তেমনি এসব আমের গায়ে লেগে থাকা ধুলাবালু এবং কীটনাশক ধুয়েমুছে যাবে। তাতে করে আমের ওজন বাড়বে এবং এর ক্রয় মূল্য ভালো হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।’

ফসলের ক্ষেত্রে মৌসুমি বায়ুর আগাম আগমন তাই ক্ষতির কোনো কারণ হিসেবে না দেখলেও ২ দশক ধরে বৃষ্টির যে অস্বাভাবিক আচরণ তা কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেই চলেছে। টানা দুই এক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে আবার একেবারে বৃষ্টিহীন থাকছে কোনো কোনো সময়। এবারে একটু আগেভাগে মৌসুমি ও চলে আসা এটাই নির্দেশ করছে না যে এবারও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হবে।

আবহাওয়াবিদ এবং কৃষিবিদদেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যেই বৃষ্টির ধরনের যে পরিবর্তন ঘটে গেছে বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বিরূপ প্রভাব আরও দীর্ঘ সময় ধরেই হয়তো রয়ে যাবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব শ ষ কর পর স থ ত র উপক ল বলছ ল ন র আগমন প রব হ র জন য র আগ ম র ওপর জলব য প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মৌসুমি বায়ু ১৬ বছর পর এবার এত আগে এল, কী হতে পারে

চলতি বছর স্বাভাবিক সময়ের এক সপ্তাহ আগেই মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর ধীরে ধীরে সারা দেশসহ পুরো উপমহাদেশজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করবে। ১৬ বছর পর এবার এত আগে দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে।

দেশে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে আসা নিয়ে আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ুবিদদের মধ্যে ভাবনা বাড়ছে।‌ বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে আগমন এবং দেরিতে চলে যাওয়া বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিশেষ করে কৃষি এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।

তবে এবার আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, আজ শনিবার বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে। আজই ভারতের কেরালা উপকূলেও মৌসুমি বায়ুর আগমনের খবর পাওয়া গেছে। সাধারণত মৌসুমি বায়ু ভারতের কেরালা উপকূল স্পর্শ করলে প্রায় একই সময় বাংলাদেশের উপকূলেও তা এসে পড়ে।

এভাবে এত আগে মৌসুমি বায়ুর আগমনের ঘটনা ঘটল ১৬ বছর পর। এর আগে ২০০৯ সালে প্রায় একই দিনে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশের উপকূলে।

আবহাওয়াবিদ এবং জলবায়ুবিষয়ক গবেষকদের ভাষ্য, একাধিক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বায়ুর প্রবেশ এবার আগাম হলো। পরিবেশ, জলবায়ু, কৃষি এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে।

মৌসুমি বায়ু কী

দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বায়ুপ্রবাহ হলো মৌসুমি বায়ু। এটা মূলত গ্রীষ্মকালের মৌসুমি বায়ু। এই গরমকালে প্রবল উষ্ণতায় স্থলভাগে বিশেষ করে ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় তাপীয় লঘুচাপের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাবে স্থলভাগের কাছের সমুদ্র অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্প নিয়ে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে।

বাংলাদেশে জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৌসুমি বায়ুর প্রভাব থাকে। দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয় এ সময়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলছিলেন, এই গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। এতে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থলভাগ উত্তপ্ত হয়। আর এই উত্তাপের কারণে সেখানকার বায়ুও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ জন্য ওই সময় তাপীয় লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলভাগ সেই সময় অপেক্ষাকৃত কম গরম থাকে। তাই সেখানে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপযুক্ত জলভাগ এলাকা থেকে বায়ু এশিয়ার স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। এটি মৌসুমি বায়ু।

মৌসুমি বায়ু আগাম আসার কারণ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের বৃষ্টি এবং গ্রীষ্মকালের জলবায়ু পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে আজ মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করেছে। ভারতের কেরালাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় স্পর্শ করেছে মৌসুমি বায়ু।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত ১ জুন বাংলাদেশের টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটে।‌ মাঝেমধ্যে দু–এক দিনের হেরফের হয়। তবে এক দশক ধরে মৌসুমি বায়ু জুনের প্রথম সপ্তাহ এমনকি কখনো কখনো জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে আসছে। মৌসুমি বায়ু যত দিন পর্যন্ত থাকার কথা, তারপরও প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে।‌ জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাবেই এমনটা করছে বলে মনে করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

মৌসুমি বায়ুর আগাম আসার কারণ তাহলে কী? কারণ হিসেবে দুটো শর্তের কথা জানালেন সমরেন্দ্র কর্মকার। প্রথম বিষয়টি হলো ‘ম্যাসকারিন হাই প্রেসার’–এর প্রাবল্য। মাদাগাস্কারের কাছে ভূপৃষ্ঠে যে উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়, সেটিই ম্যাসকারিন হাই প্রেসার নামে পরিচিত। এটি যদি খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে কখনো কখনো মৌসুমি বায়ু আগাম চলে আসতে পারে। এই বায়ুপ্রবাহ সোমালিয়ার উপকূল হয়ে উপমহাদেশের দিকে আসে।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলছিলেন, ভারতের মধ্যপ্রদেশ বা এর কাছাকাছি এলাকার তাপীয় লঘুচাপেরও ভূমিকা থাকতে পারে। ভারতের মধ্যপ্রদেশ বা এর কাছাকাছি এলাকায় যে তাপীয় লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, তার শক্তিশালী অবস্থান এর কারণেও কখনো কখনো মৌসুমি বায়ু আগাম চলে আসতে পারে।

মৌসুমি বায়ু মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসে। এর বৈশিষ্ট্য হলো এখানে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে।

মোহাম্মদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘আর্দ্রতার পরিমাণ ৯০ শতাংশের বেশি হয় কখনো কখনো। আর এ বায়ু প্রবাহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত। তিন থেকে পাঁচ মিলিমিটার বৃষ্টি ধারাবাহিকভাবে যদি হতে থাকে তবেই মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।’

আবহাওয়াবিদদের কথা, যদি মৌসুমি বায়ুর আসার স্বাভাবিক সময়ের আগে আরব সাগর বা বঙ্গোপসাগরে কোনো লঘুচাপ বা নিম্নচাপ কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় তবে এর আগমন আগাম ঘটে যেতে পারে। আরব সাগরে এখন একটি নিম্নচাপ রয়েছে। বাংলাদেশে আগামী মঙ্গলবার থেকে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। আবার এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

সমরেন্দ্র কর্মকারের ভাষ্য, আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে এই যে লঘুচাপ এবং নিম্নচাপ পরিস্থিতি, তা মৌসুমি বায়ুর আগাম আগমনে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা যায়।

আগাম আগমনের প্রভাব কী হতে পারে

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মৌসুমি বায়ু একটু আগে চলে আসা মানে যে বৃষ্টি বাড়বে, এমনটা নয়। এর প্রভাবে হয়তো আগামী দু–এক দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এরপর আছে মৌসুমি লঘুচাপ। তার প্রভাবেও কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর পর থেকে টানা কয়েক দিন দেশ প্রায় বৃষ্টিহীন থাকতে পারে।

স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর নতুন করে প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ২০০০ সালে। তবে বিশেষ করে ২০১৯ সাল থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রভাব ব্যাপক মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে দেশে যত মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা এর আগে কখনোই হয়নি। ওই বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এডিস মশার বিস্তার শুরু হয় সাধারণত জুন মাসে। থেমে থেমে বৃষ্টি, অত্যধিক আর্দ্রতা ইত্যাদি ডেঙ্গুর রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশার বিস্তারে ভূমিকা রাখে। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যগত অন্যান্য বিষয় অবশ্যই বিচার্য। কিন্তু বৃষ্টি এবং তাপের বড় সম্পর্ক আছে এডিসের বিস্তারে।

বৃষ্টি হলে বাসাবাড়ি বা আশপাশে নানা খোলা স্থানে পানি জমে যায়। আবার বৃষ্টি বন্ধ হয়ে অত্যধিক তাপ হলে ওই পানিতে জমে থাকা এডিসের ডিমগুলো দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, এবার ডেঙ্গুর রোগবাহী এডিস মশার বিস্তার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে মৌসুমি বায়ু যদি আরও এগিয়ে আসে, তবে মশার বিস্তার আরও দ্রুত ঘটতে পারে। কারণ বিস্তার রোধে যে সামগ্রিক তৎপরতা তার যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

চলতি বছরে এপ্রিল মাসে তেমন তাপপ্রবাহ হয়নি। থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। মে মাসের শুরুতে তাপপ্রবাহ দেখা দিলেও শেষ দিকে এসে বৃষ্টি বেড়েছে। তবে বৃষ্টি বাড়লেও তাপমাত্রা কিন্তু খুব বেশি কমেনি। এ পরিবেশকে এডিসের জন্য খুবই সহায়ক বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন।

কৃষির ওপর প্রভাব

বোরো ধানের উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতির, মানুষের জীবনযাত্রার ওপর একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে আছে। এরই মধ্যে হাওরের ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। দেশের অন্যত্র ধান কাটা প্রায় অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টি এলে ধানের জন্য খুব ক্ষতি হবে না বলেই মনে করেন কৃষিগবেষক মৃত্যুঞ্জয় রায়। তাঁর মতে, মৌসুমি বায়ুর আগেভাগে চলে আসা কিছু সবজির ক্ষেত্রে ভালো হয়েছে। আবার এখন গাছে যে দেরিতে ফলন হওয়া বা নাবি জাতের আম আছে তার জন্য ভালো হতে পারে।

দেশি নাবি জাতের আমের মধ্যে আছে আম্রপালি, ফজলি, বারি-৪, আশ্বিনী। বাংলাদেশের মোট যে আম উৎপাদন হয় তার ৪০ শতাংশ এখন আম্রপালি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক এ কে এম মনজুরের মাওলা প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘নাবি জাতের আমগুলোর এখন বৃদ্ধির সময়। এখনকার বৃষ্টিতে এর আকার যেমন বড় হবে তেমনি এসব আমের গায়ে লেগে থাকা ধুলাবালু এবং কীটনাশক ধুয়েমুছে যাবে। তাতে করে আমের ওজন বাড়বে এবং এর ক্রয় মূল্য ভালো হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।’

ফসলের ক্ষেত্রে মৌসুমি বায়ুর আগাম আগমন তাই ক্ষতির কোনো কারণ হিসেবে না দেখলেও ২ দশক ধরে বৃষ্টির যে অস্বাভাবিক আচরণ তা কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেই চলেছে। টানা দুই এক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে আবার একেবারে বৃষ্টিহীন থাকছে কোনো কোনো সময়। এবারে একটু আগেভাগে মৌসুমি ও চলে আসা এটাই নির্দেশ করছে না যে এবারও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হবে।

আবহাওয়াবিদ এবং কৃষিবিদদেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যেই বৃষ্টির ধরনের যে পরিবর্তন ঘটে গেছে বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বিরূপ প্রভাব আরও দীর্ঘ সময় ধরেই হয়তো রয়ে যাবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ