১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করে যাওয়ার কথা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন অনেক আগে। সরকার গঠনের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ‘এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ হওয়া উচিত’ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ সম্পর্কে কিছু বলার আগেই তাঁর এ অবস্থান নিয়ে কিন্তু তেমন বিতর্ক হয়নি তখন। ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে’ সরকারের পাশে থাকার ঘোষণায় মানুষ বরং আশ্বস্তই হয়েছিল। সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান এও জানিয়েছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড.
সেই সাক্ষাৎকারের কথা স্মর্তব্য এ জন্য, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন পথযাত্রার এ দুই মুখ্য ব্যক্তির সেই সম্পর্ক দৃশ্যত দুর্বল হয়েছে। ওয়াকার-উজ-জামান সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে অতিসম্প্রতি যা বলেছেন, তাতে পূর্ববর্তী অবস্থান নতুন করে প্রকাশ পেলেও সরকার তা সহজভাবে নেয়নি। সংবাদমাধ্যমে আসা ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের কথাও ভাবছিলেন বলে জানা যায়। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অবশ্য বলেছেন, তারা অর্পিত দায়িত্ব ছেড়ে যাচ্ছেন না।
এর মধ্যে শনিবার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক শুরু হয়েছে। নিবন্ধটি লেখার দিনও কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা। তবে শুরুর দিনই প্রধান তিন দলের সঙ্গে বৈঠকে উঠে এসেছে– এখন কারা কী চায়। উপদেষ্টা পরিষদও এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের দায়িত্ব পালন অসম্ভব করা হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এতে আগ্রহোদ্দীপক, ব্যাখ্যার যোগ্য কিছু শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। এটাকে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের কঠোর প্রতিক্রিয়া বলে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বৈকি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে সরকার কী বলে, সেটা জানার অপেক্ষায় অবশ্য থাকতে হবে।
সেনাপ্রধান যে সময়ের মধ্যে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’-এর কথা বলেছেন, সেটা শেষ হতে এখনও সাত মাস বাকি। তিনি সংস্কারের কথাও তুলেছেন। সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সংবিধানের সম্ভাব্য পরিবর্তন বিষয়েও অভিমত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এদিকে নজর দিতে পারে। সুতরাং বলা যাবে না– সেনাপ্রধান সংস্কারবিমুখ। তিনি যে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার কথা বলেছেন, সেটাও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নেহায়েত কম নয়।
ইতোমধ্যে সরকারের ৯ মাস অতিক্রান্ত। মুহাম্মদ ইউনূস বারবারই বলছেন, সরকার একটি আদর্শ নির্বাচন দিতে চায়। সংস্কার বিষয়েও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সংস্কার আলোচনা চলমান। তবে সেনাপ্রধান বলেছেন, তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। জননিরাপত্তা জোরদারে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী। তারা গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনও বটে। এ অবস্থায় সংস্কার কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ না থাকা-সংক্রান্ত বক্তব্য আলাদা নজর কাড়ে বৈকি।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যে অবশ্য নির্বাচনের সময়সীমাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার যে অবস্থান; ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন নাও হতে পারে। আগামী বছর জুনের পর তারা আর থাকবেন না– এটা অবশ্য স্পষ্ট করেই বলেছেন। ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণ-সংক্রান্ত বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। সেই সিদ্ধান্ত তিনি জানিয়েছিলেন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে। নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনে গড়াতে পারে বলে তাঁর ঘোষণার পর দ্রুত নির্বাচনপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোও তাৎক্ষণিক নেতিবাচক কিছু বলেনি।
পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে মনে হয় না, ঘোষিত রোডম্যাপ নিয়ে বড় জটিলতার সৃষ্টি হতো। আরেকটি শর্ত– প্রধান সব দলের আস্থা সরকার ধরে রাখতে পারলে। এরই মধ্যে সরকার বিএনপির আস্থা হারিয়েছে। শুরু থেকে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষপাতী এ দলটি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তিন মাসের মধ্যে এ দেশে একাধিক সফল নির্বাচন হয়েছে– সেটাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তারা। বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য গুণগতভাবে ভিন্ন। সেটা তাদের অজানা নয়। সেনাবাহিনীও গভীরভাবে জানে। মাঠে থেকেও তারা পরিস্থিতির বিপজ্জনক দিকগুলো অনুধাবন করছে। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া ‘উচিত’ বলে অবস্থান নিয়েছেন সেনাপ্রধান।
সেনাপ্রধানের অবস্থান বিষয়ে লক্ষণীয়, তিনি প্রথম উল্লিখিত ১৮ মাস সময়সীমাতেই রয়েছেন। মাঝে জামায়াত আমিরের মাধ্যমে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে বক্তব্য মিলেছিল। বর্ষার আগেই নির্বাচন করা ভালো বলে মত রয়েছে। শীতে নির্বাচন আয়োজনও আমাদের ঐতিহ্য। এসব দিক বিবেচনা করেও হয়তো সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন সারার কথা বলেছিলেন। তবে ১৯ বা ২০ মাসের মধ্যে নির্বাচন হলেও তিনি অসহযোগিতা করবেন বলে মনে হয় না।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাপ্রধানের সম্পর্কের অবনতি হলো কেন– সেটা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। বাজারে উড়ছে নানা কথা। সেনাপ্রধানের সর্বশেষ বক্তব্য থেকেও কিছুটা হয়তো আঁচ করা যায়। উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে আবার বলা হয়েছে, তাদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির বিষয়ে প্রয়োজনে সবকিছু প্রকাশ করা হবে। রাজপথ থেকেও প্রতিবন্ধকতা তৈরির কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। তবে সরকার মুখ খুললে অন্যান্য পক্ষও নীরব থাকবে না। তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
এরই মধ্যে পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে বলে অনুধাবন করলে সব পক্ষেরই অবশ্য উচিত হবে শান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে সরকারের বৈঠকও জরুরি। সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন বিষয়ে তাদের মত গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর জোরালো সহায়তা ছাড়া আগামী জুনের মধ্যেও সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে বলে মনে হয় না। মনে রাখা যেতে পারে, ৯ মাসেও পুলিশসহ বেসামরিক প্রশাসনকে সক্রিয় করতে পারেনি।
ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হলেও এর মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা যাবে না– তা তো নয়। যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত মনোনিবেশ করতে পারে সরকার। সেনাপ্রধান কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে যে কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের’ ওপর জোর দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধে উক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি যে মত দিয়েছিলেন, সেটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো কিছুই আর ‘গোপনীয়’ নেই। ভূরাজনৈতিক আর জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও প্রবলভাবে সামনে এসেছে। আশা করা যায়, নির্বাচিত সরকার এলেও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সংলাপ সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণে এগিয়ে যাবে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ পর স থ ত র জন ত ক ড স ম বর বল ছ ল ন সরক র র অবস থ ন ম বর র বল ছ ন ১৮ ম স অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
সানেমের জরিপে নতুন বন্দোবস্ত নিয়ে পুরোনো বার্তা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল তরুণদের কতটা ভোট পেতে পারে– এ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম। গত সোমবার প্রকাশিত জরিপটিতে অংশ নিয়েছেন ২০০ তরুণ; সবার বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। জরিপের ফল বলছে, আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পাবে বিএনপি। ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে জামায়াতে ইসলামী। তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থান তৃতীয়; ভোট ১৫ দশমিক ৮৪। এ ছাড়া ওই তরুণরা মনে করেন, বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেলে ১৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ভোট পাবে। অন্যান্য ইসলামিক দলের বাক্সে যেতে পারে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মাত্র ৯ মাস পর পরিচালিত জরিপটির ফল কৌতূহলোদ্দীপক। যে গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনীতিতে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে দাবি করা হলো, তা জরিপে তরুণদের অভিব্যক্তিতে উঠে এলো না কেন? বিএনপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদানের মধ্য দিয়ে তারা তো মনে হচ্ছে, সেই ‘পুরোনো’ বন্দোবস্তকেই সমর্থন জোগালেন। আরেকটি বিষয় হলো, গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও কার্যত নতুন বন্দোবস্তের প্রবক্তা এনসিপির সমর্থন জামায়াতে ইসলামীর নিচে কেন? নিজেদেরই সম্ভাব্য ভোটব্যাংকের মধ্যে এমন অবস্থান জনগণের বাকি অংশের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কী বার্তা দেয়?
নিঃসন্দেহে জরিপটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। প্রথমত, এর নমুনার আকার খুবই ছোট; বিশেষত জরিপে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠী বা এজ গ্রুপের আকার বিবেচনায়। সরকারি পরিসংখ্যানমতে, ১৫-৩৪ বছর বয়সীরা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি। মোট ভোটারের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। দ্বিতীয়ত, যদিও জরিপে শহর-গ্রাম ও জেন্ডার অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ (৫০:৫০); জরিপের জন্য আট বিভাগের দুটো করে জেলা এবং প্রতিটি জেলার দুই উপজেলা বাছাইয়ের সময় বিবেচনা কী ছিল, তা পরিষ্কার নয়। এখানে কিন্তু এমন বহু জেলা-উপজেলা আছে, যেখানকার বাসিন্দারা ব্যাপকভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতের অনুসারী।
অবশ্য জরিপের এই ফলাফল নিয়ে খোদ সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানই কিছু সতর্কবাণী দিয়েছেন। জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, শুধু ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এখানে যে মতামত এসেছে, তা শুধু বাছাই করা তরুণদের মতামত। এটাকে দেশের পুরো জনগোষ্ঠী বা অন্যান্য বয়সের মানুষের মতামত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। বিশেষত রাজনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে তা সংগত হবে না (প্রথম আলো, ৮ জুলাই, ২০২৫)।
এমন প্রশ্নও করা যেতে পারে, জরিপে উঠে আসা মতগুলো কি সংশ্লিষ্ট তরুণরা ভোটার হিসেবে দিয়েছেন? অর্থাৎ তারা কি বলেছেন, নিজেরা আগামী নির্বাচনে আলোচ্য দলগুলোকে ভোট দেবেন? না, জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই তরুণরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট দলগুলো আলোচ্য হারে ভোট পেতে পারে। জরিপ প্রতিবেদনেই তো বলা আছে, মত প্রদানকারী তরুণদের ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এখনও ভোটার হননি। উপরন্তু এই জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এখনও সিদ্ধান্ত নেননি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। মোট কথা, জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের মত কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক, সে প্রশ্নও তোলা যায়।
কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীর ভোট ২১ শতাংশ অতিক্রম করা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলটি বেশির ভাগ নির্বাচনে জোটবদ্ধ ছিল। সেসব নির্বাচনে তাদের ভোট ৫ শতাংশের নিচে ছিল। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে একা লড়ে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে দলটি বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে, ঠিক। এর পর থেকে তার প্রচার-প্রচারণা অবাধে চলছে, এটাও ঠিক। কিন্তু তাতে দলটির ভোট লাফ দিয়ে এতটা বেড়ে যাবে? মনে রাখতে হবে, বর্তমানে অনুকূল পরিস্থিতি পেলেও মহান মুক্তিযুদ্ধকালের ভূমিকা নিয়ে দলটির বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দলটির নেতাদের এখনও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়।
শুধু তা কেন? কত সময়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে– এ প্রশ্নও করা হয়েছিল সানেমের জরিপে। এর উত্তরে ৩৯ শতাংশের বেশি বলেছেন, তারা জানেন না। সাড়ে ২২ শতাংশ বলেছেন, কখনোই না। অন্যদিকে মাত্র ১১ শতাংশের কিছু বেশি বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় আসবে।
যা হোক, পদ্ধতিগতভাবে বা অন্যান্য বিবেচনায় জরিপটির যতই দুর্বলতা থাকুক, অন্তত এনসিপি বিষয়ে তা প্রতিনিধিত্বমূলক। কারণ এনসিপি এ তরুণদেরই দল। তরুণরা তাদের পক্ষে আছেন– এ কথা বলেই দলটির নেতারা দাবি করছেন। পুরোনো দ্বিদলীয় ব্যবস্থার এক পক্ষ আওয়ামী লীগ তো রাজনীতির মাঠছাড়া হয়েছেই; অপরপক্ষ বিএনপিরও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। কিন্তু জরিপটি দেখাল বিপরীত বাস্তবতা।
আসলে এই বাস্তবতা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেরই ফসল। এর বহিরাঙ্গ দেখে বলা যেতেই পারে, তা অতীতের গণঅভ্যুত্থানগুলোর মতো রাজনৈতিক দল বা জোটের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে এ গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন অংশীজনের আলাপ থেকে এটা পরিষ্কার, আপাত দলবিহীন শিক্ষার্থীরা এর সূচনা ঘটালেও এর মূল শক্তি ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত তরুণরা। সন্দেহ নেই, এই গণঅভ্যুত্থানে অতীতের যে কোনো আন্দোলনের চেয়ে শিক্ষার্থী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল। কিন্তু এর আদি পুঁজি জুগিয়েছিল তৎকালীন সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে ভেসে আসা মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে নানা স্বপ্ন ছিল বটে; রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে সেগুলোর মান্যতাও দিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের রাশ যেহেতু ছিল প্রতিষ্ঠিত শেষোক্তদের হাতে; শেষ হাসিটা তারাই হাসতে চলেছে। অন্যদিকে সময় যত গড়িয়েছে ততই শিক্ষার্থী-জনতা জীবনের রূঢ় বাস্তবতার ধাক্কায় নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছে।
এনসিপিও একই বাস্তবতা থেকে স্বতন্ত্র পথ ছেড়ে বিএনপির এ মুহূর্তের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামপন্থি দলগুলোর শক্তির ওপর ভর করে চলার চেষ্টা করছে। এনসিপি নেতারা যে নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াত-হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে প্রায় সহমত পোষণ করছে, তা কাকতালীয় নয়। এ দলগুলো আর যাই হোক, বহুলশ্রুত নতুন বন্দোবস্তের দল নয়– তা নিয়েও কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে?
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল