২৭ জুন দক্ষিণ ফ্রান্সের রাউসিলনের এল হিদায়া মসজিদে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। জানালা ভেঙে ফেলা এবং আসবাব এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলা হয়। দেয়ালে লাগানো হয় জাতিবাদী লিফলেট। একই মাসের শুরুতে লিওনের ভিলেউরবানে একটি মসজিদের প্রবেশপথে পোড়ানো কোরআন রাখা হয়। দুর্ভাগ্যবশত ফ্রান্সে ভয়াবহ ইসলাম বিদ্বেষ ভাঙচুরের মধ্যেই শেষ হয়নি। ৩১ মে ফরাসি রিভেরার কাছের এক গ্রামে হিচেম মিরাউইকে তাঁর ফরাসি প্রতিবেশী গুলি করে হত্যা করে। আরেকজন মুসলিম ব্যক্তিকে গুলি করা হলেও তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এক মাস আগে লা গ্র্যান্ড-কম্বেবি শহরের একটি মসজিদে এক ফরাসি মালিয়ান নাগরিক আবুবকর সিসেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

ফ্রান্সে ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। এ ব্যাপারে ফরাসি কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে অনিচ্ছুক। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে এ ধরনের যত ঘটনা ঘটেছে, ২০২৫ সালের একই সময়ে তা ৭২ শতাংশ বেড়েছে। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ দায়ী। এর মধ্যে মুখ্য বিষয় হলো ফরাসি রাষ্ট্রের নিজস্ব ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য এবং মুসলিমবিরোধী নীতি।

এ কাজের সাম্প্রতিক পুনরাবৃত্তি ছিল ফরাসি সরকারের ‘দ্য মুসলিম ব্রাদারহুড অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইসলামিজম ইন ফ্রান্স’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ। নথিতে দাবি করা হয়েছে, মুসলিম ব্রাদারহুড ও ‘রাজনৈতিক ইসলামপন্থি চিন্তা’ ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢুকে পড়ছে এবং তা সামাজিক সংহতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সংগঠন ও মসজিদগুলোকে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় মিরাউইকে গুলি করে হত্যা করার কয়েক দিন আগে এবং ফ্রান্সে বসবাসকারী ব্রাসেলসভিত্তিক কালেক্টিভ এগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ইন ইউরোপের কয়েকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের বাড়িতে ফরাসি কর্তৃপক্ষের অভিযানের দুই সপ্তাহ পর। ফ্রান্সে মুসলিমবিরোধী আক্রমণ ও বৈষম্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটা বিশ্বাস করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে– ফরাসি রাষ্ট্র ও সরকারের ‘ইসলামবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদ’ নামক আকাঙ্ক্ষা আসলে ফরাসি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে না।

ফরাসি মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রচারের মধ্য দিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে– কয়েক দশক ধরে এ ধারণা ফরাসি অতি ডানপন্থিরা সমর্থন করে আসছে। কিন্তু ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে মধ্যপন্থি রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া যোগ দিলে এটি মূলধারায় প্রবেশ করে।

২০১৮ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, যিনি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ শব্দটিও গ্রহণ করেছিলেন তিনি ‘ফরাসি ইসলাম’ তৈরির আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা ফরাসি রাষ্ট্রের স্বার্থে মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইচ্ছামতো ও নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে একটি আওয়াজ। এ প্রকল্পের মূলে ছিল ‘সামাজিক সংহতি’ সংরক্ষণের নামে কার্যকরভাবে ভিন্নমত দমন।

পরবর্তী বছরগুলোতে ফরাসি রাষ্ট্র আরও কঠোর নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। ২০১৮ থেকে ’২০ সালের মধ্যে তারা স্কুল, মসজিদসহ ৬৭২টি মুসলিম পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়।

২০২০ সালের নভেম্বরে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইসলাম বিদ্বেষ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহকারী একটি অলাভজনক সংস্থা ‘কালেক্টিভ এগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ইন ফ্রান্স’কে তার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করে। এর পর সংগঠনটি ব্রাসেলসে পুনর্গঠিত হয়। সেই বছরের ডিসেম্বরে তারা ৭৬টি মসজিদকে লক্ষ্য করে ‘ইসলামী বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর অভিযোগ তুলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। 

২০২১ সালে ফরাসি পার্লামেন্ট তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী আইন পাস করে, যার মধ্যে ‘ইসলামী বিচ্ছিন্নতাবাদ’ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে ছিল সরকারি খাতে ধর্মীয় প্রতীকের ওপর নিষেধাজ্ঞার সম্প্রসারণ, গৃহশিক্ষা ও ক্রীড়া সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি গ্রহণকারী সংস্থাগুলোর জন্য নতুন নিয়ম, উপাসনালয়গুলোতে আরও পুলিশিং ইত্যাদি।

২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে ফরাসি সরকার জানিয়েছে, তারা ২৪ হাজারেরও বেশি মুসলিম সংগঠন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছে, যার মধ্যে সাত শতাধিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ৪৬ মিলিয়ন ইউরোর (৫৪ মিলিয়ন ডলার) সমপরিমাণ সম্পদ জব্দ করে। মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির লক্ষ্য অনেক সরকারি বিবৃতি ও উদ্যোগের মতোই নীতি স্পষ্ট করা বা আইনি নির্ভুলতা নিশ্চিত করা ছিল না। এটি মুসলিম পরিচয়কে রাজনীতিকীকরণ, রাজনৈতিক ভিন্নমতকে অবৈধ ঘোষণা এবং মুসলিম নাগরিক সমাজের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের একটি নতুন ঢেউ সহজতর করার পক্ষে ছিল।

প্রতিবেদনে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ আনা হয়। এতে আরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচারণাও সংগঠনটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মুসলিম ব্রাদারহুড ধর্মনিরপেক্ষ নীতিগুলোকে অসম্মানিত করতে এবং রাষ্ট্রকে বর্ণবাদী হিসেবে চিত্রিত করতে ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তৎপর। 

এসবের লক্ষ্য বৈষম্যমূলক আইন ও অনুশীলনের বৈধ সমালোচনা বাতিল এবং মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদকে একটি গোপন ইসলামিক এজেন্ডা হিসেবে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কাঠামো তৈরি করা। এর অর্থ স্পষ্ট, মুসলিমদের দৃশ্যমানতা এবং ভিন্নমত শুধু সন্দেহজনক নয়, বরং বিপজ্জনক– তা দেখানো।

এই প্রতিবেদনে ইসলামপন্থি গাউচিজম বা ইসলাম-বামপন্থি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়েও গভীর আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই ধারণায় ‘ইসলামপন্থি’ ও বামপন্থিদের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট রয়েছে। আর দাবি করা হয়েছে, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলামবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর ‘মার্চ এগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া’ কর্মসূচির ব্যাপারে বলা হয়েছে, এতে বামপন্থিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বলয় থেকে অংশগ্রহণকারীদের আকৃষ্ট করা হয়েছিল।

কট্টরপন্থি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান আইনমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিনের অধীনে কমিশনটি তৈরি করা হয়েছে। ডারমানিন ২০২১ সালে অতি ডানপন্থি নেত্রী মেরিন লে পেনকে ইসলামের প্রতি ‘অত্যধিক দুর্বল’ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। 

এই সবকিছুই– প্রতিবেদন, আইন, পুলিশি অভিযান এবং ফরাসি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বরপূর্ণ আক্রমণ মুসলিম জনসংখ্যার ওপর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার দীর্ঘ ফরাসি ঔপনিবেশিক সিলসিলারই অনুসরণ।

ফরাসি রাজনীতির কেন্দ্রীয় শক্তিগুলো তার ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা রোধ করার জন্য ইসলাম বিদ্বেষের আশ্রয় নিচ্ছে। এটি ক্রমবর্ধমান অতি ডানপন্থিদের ওপর তাদের সংকীর্ণ নির্বাচনী জয়ে সাহায্য করতে পারে, তবে তা স্বল্পস্থায়ী হবে। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হবে বিপর্যস্ত মুসলমানদের ওপর একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়। এখান থেকেই তারা ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্র প্ররোচিত সহিংসতা ও ঘৃণার শিকার হবে।

ড.

ফরিদ হাফেজ: জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ব্রিজ ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব চ ছ ন নত ব দ ইসল ম ব দ ব ষ র জন ত ক র জন য প রক শ র ওপর মপন থ সরক র মসজ দ

এছাড়াও পড়ুন:

পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে: ইসি

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের অনলাইনে নিবন্ধন করে পোস্টাল ব্যালটে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

আজ বৃহস্পতিবার ইসির সভা শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এবার সংসদ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) আর কোনো নির্বাচনে ব্যবহার হবে না।’

এর আগে প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের জন্য তিনটি বিকল্প পদ্ধতি (প্রক্সি ভোট, অনলাইন অথবা পোস্টাল ব্যালট) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছিল ইসি। সেখানে বেশির ভাগ দলই প্রক্সি ও অনলাইন ভোটের বিরোধিতা করেছিল। সর্বশেষ ইসি পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, অনলাইন নিবন্ধনের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে অনলাইনে নিবন্ধন করলে ইসি সরাসরি পোস্টাল ব্যালট সংশ্লিষ্ট ভোটারের কাছে পাঠাবে। ভোটদান শেষে তা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট হবে, আগে যেমন ব্যালট পাঠানো হতো। এবার হবে আইটি সাপোর্টেড, এ জন্য আগেই অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে।’ এ–সংক্রান্ত একটি প্রকল্প নেওয়া হবে, এ জন্য ৪৮ কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে বলেও জানান এই নির্বাচন কমিশনার।

আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘একটা প্রস্তাব আছে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যালট প্রিন্ট করা হবে, আরেকটা প্রস্তাব হচ্ছে ব্ল্যাংক ব্যালট। সেখানে প্রার্থীর নাম লিখে ভোটার পাঠিয়ে দেবে। আমরা যদি মার্কা ব্যালটে ছাপিয়ে দুই মাস আগে ব্যালট পাঠাই, যাতে মার্কায় ভোট দিয়ে দেয়। এসব প্রস্তাব আছে। প্রবাসী ভোটারদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য আলাদা প্রকল্প হবে, আমরা ট্রায়াল প্রসেসে যেতে পারব।’

বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর আগেই জানিয়েছিলেন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। আজকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় স্থানীয় নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। পৃথক কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইভিএমের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।

আজ বেলা ১১ টায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে কমিশনের সভা শুরু হয়। এতে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে সভার সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানানো হয়। সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইন, হলফনামা, ইসি সচিবালয় আইন, দল নিবন্ধন অগ্রগতি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ